প্রতীকী ছবি
আগে কখনই পারিবারিক সহিংসতার শিকার হননি, এবার লকডাউন পরিস্থিতিতে প্রথমবারের মতো নির্যাতনের শিকার হয়েছেন এমন নারীর সংখ্যা গত এক মাসে ছিল এক হাজার ৬৭২। এপ্রিলে পারিবারিক সহিংসতার শিকার হওয়া ৪৫৬ শিশুর মধ্যে ৪২৪ জন এর আগে কখনই নির্যাতনের শিকার হয়নি। এ ছাড়া গত মাসে বাল্যবিবাহ হয়েছে ৩৩টি। একই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে পুরুষ নির্যাতনের ঘটনাও।
দেশের ৫৮ উপজেলার ৬০২টি গ্রাম ও ৪টি সিটি করপোরেশনের ১৭ হাজার ২০৩ জন নারী ও শিশুদের সঙ্গে কথা বলে গত বুধবার এ জরিপ প্রকাশ করে বেসরকারি সংস্থা মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন (এমজেএফ)। জানা গেছে, নারী-শিশু নির্যাতনের অভিন্ন চিত্র দেশের অন্য জেলাগুলোয়ও।
নারীর সঙ্গে বাড়ছে পুরুষ নির্যাতনও বর্তমানে নারী ও পুরুষ নির্যাতনের জন্য গৃহবন্দি জীবনে একঘেয়েমি, অস্থিরতা, টেনশন, কর্মহীনতা ও অভাবকেই দায়ী করছেন মানবাধিকার কর্মী ও বিশিষ্টজনরা। তাদের মতে, বর্তমান কঠিন পরিস্থিতিতে এক ধরনের পুরুষদের কাছে স্ত্রীরা হয়ে উঠেছেন তাদের রাগ দেখানোর সহজ জায়গা। একটু বেশি সময় নিয়ে মোবাইল ফোনে কথা বলার মতো ছোটখাটো বিষয়েও কটূক্তি থেকে শুরু করে মিথ্যা অপবাদ এমনকি শারীরিক নির্যাতনেও অবতীর্ণ হচ্ছে কিছু পুরুষ। আগে থেকেই যারা স্ত্রীর ওপর নির্যাতন চালাতেন বর্তমানে গৃহবন্দি অবস্থায় সেসব স্বামী নির্যাতনের আরও নতুন নতুন ছুতো খুঁজে হামলে পড়ছেন সহধর্মিণীর ওপর। এ প্রবণতা বেশি দেখা যাচ্ছে মদ্যপায়ীদের মধ্যে।
আবার বেকার অবস্থায় আর্থিক দৈন্যদশা ছাড়াও গৃহবন্দি অবস্থায় দীর্ঘক্ষণ শুয়ে-বসে কাটানো, মোবাইলে গেমস খেলার মতো তুচ্ছ ঘটনায়ও স্বামীদের শারীরিক না হলেও মানসিক যন্ত্রণা দিচ্ছেন নারীদের কেউ কেউ। স্বামীর গায়ে হাত তুলছেন কেউ কেউ। এভাবে চলতে থাকলে লকডাউন উঠে যাওয়ার পর বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনা বেড়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশ ম্যানস রাইটস ফাউন্ডেশনের (বিএমআরএফ) চেয়ারম্যান শেখ খায়রুল আলম গতকাল বলেন, পুরুষশাসিত এ সমাজে নিজ ঘরেই নির্যাতিত পুরুষের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। তাদের কেউ শারীরিক, কেউ মানসিক, কেউ আর্থিক বা সামাজিকভাবে নির্যাতিত হচ্ছেন। বর্তমান লকডাউন পরিস্থিতিতে স্ত্রী কর্তৃক নির্যাতিত পুরুষের সংখ্যা বেড়েছে ৪৫ শতাংশ। ছোটখাটো বিষয়েও স্বামীকে সহ্য করতে পারছেন না স্ত্রী। গতকাল বৃহস্পতিবারও রাজধানীর রামপুরা থেকে একটি এবং নারায়ণগঞ্জ ও কুমিল্লার দেবীদ্বার থেকে ৩ জন নির্যাতিত পুরুষ ফোনে করণীয় বিষয়ে জানতে চেয়েছেন।
রামপুরা থেকে অভিযোগকারী একজন গার্মেন্টস ব্যবসায়ী। রামপুরায় ২৮ হাজার টাকা ভাড়া ফ্ল্যাটে স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে থাকেন তিনি। লকডাউনের আগে ভালোই চলছিলেন। করোনা পরিস্থিতির কারণে তার ব্যবসায় ধস নামে। কিন্তু তার স্ত্রী আগের মতো চাহিদা অনুযায়ী টাকা না পেয়ে প্রায়ই মানসিক নির্যাতন করে আসছিলেন। গত বুধবার এ নিয়ে ঝগড়া বাধলে দুই সন্তানকে ফেলে বিবাহ বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেন ওই ব্যবসায়ীর স্ত্রী। সংসার বাঁচাতে এখন কী করবেন তা জানতে চেয়েই ফোন করেছিলেন ওই ব্যবসায়ী।
খায়রুল আলম আরও জানান, মূলত সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, নৈতিক স্খলন, লোভ-লালসা, উচ্চবিলাসিতা, পরকীয়া, মাদকাসক্তি, অর্থনৈতিক দৈন্যতা, বিশ্বায়নের ক্ষতিকর প্রভাব, অবাধ আকাশ সংস্কৃতির প্রবাহসহ নানা কারণে পুরুষ নির্যাতনের ঘটনা বাড়ছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সন্তানের ভবিষ্যৎ, সামাজিক মর্যাদা, চক্ষুলজ্জা, থানা পুলিশ আর উল্টো মামলার ভয়ে বাধ্য হয়ে নীরবে সব সহ্য করে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন ভুক্তভোগীরা। তা ছাড়া পুরুষ নির্যাতন প্রতিরোধে সুনির্দিষ্টভাবে কোনো আইন নেই। নারী ও শিশু নির্যাতন বিচারে ট্রাইব্যুনাল থাকলেও পুরুষদের জন্য এখনো তা করা হয়নি বলে ভুক্তভোগীরা সঠিক আইনি সেবা পাচ্ছেন না।
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম বলেন, করোনা ভাইরাসজনিত লকডাউন পরিস্থিতিতে নিজ ঘরে সুরক্ষা ও নিরাপত্তার পরিবর্তে দেশের অনেক স্থানে নারী ও মেয়ে শিশুরা নানা ধরনের সহিংসতার শিকার হচ্ছে, যা উদ্বেগজনক। দুর্বৃত্তায়নের পাশাপাশি গৃহবন্দি জীবনে অস্থিরতা, টেনশন ও অভাবের কারণে এখন বেড়ে গেছে নারী-শিশু ধর্ষণ ও পারিবারিক সহিংসতা ঘটনা। লকডাউন পরিস্থিতিতে গত মাসে স্বামীর দ্বারা শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৮৪৮ জন, মানসিক নির্যাতনের শিকার ২ হাজার ৮ জন, যৌন নির্যাতনের শিকার ৮৫ জন এবং অর্থনৈতিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ১ হাজার ৩০৮ নারী। এর বাইরে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৪ জন, হত্যা করা হয়েছে এক জনকে এবং যৌন হয়রানি করা হয়েছে ২০ নারীকে। গৃহ সহিংসতার শিকার এসব নারীরা করোনা ভাইরাস পরিস্থিতির কারণে আইনি সহায়তা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন। আবার অনেককে উদ্ধার করার চেষ্টা করা হলেও করোনার কারণে আশ্রয়কেন্দ্রে জায়গা মিলছে না। গত মাসে পারিবারিক সহিংসতার শিকার শিশুদের শতকরা ৯২ জন বাবা-মা বা আত্মীয়দের দ্বারা নির্যাতনের শিকার হয়েছে।
এমজেএফের প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর অর্পিতা দাস বলেন, আমরা এক হাজার ৬৭২ নারীকে পেয়েছি যারা লকডাউনের আগে কখনই নির্যাতনের শিকার হননি। এটা প্রমাণ করে লকডাউনের মধ্যে নির্যাতন বাড়ছে। আর এ নির্যাতনে স্বামীরাই প্রধানত জড়িত। কারণ তাদের কোনো কাজ নেই। অধিকাংশের আয় নেই। খাবার নেই। তারা বাইরে যেতে পারছেন না, আড্ডা দিতে পারছেন না। এ সব কিছুর জন্য তারা আবার নারীকেই দায়ী করছেন। নারীকে দায়ী করার এ মানসিকতার পেছনে নির্যাতনের প্রচলিত মানসিকতাই কাজ করছে। এর বাইরে শ্বশুর-শাশুড়ি এবং পরিবারের অন্য সদস্যদেরও ভূমিকা রয়েছে। করোনার কারণে দরিদ্র মানুষের হার বেড়ে যাওয়া এবং বাল্যবিয়েবিরোধী প্রচার এবং তৎপরতা কমে যাওয়ার কারণে লকডাউনের মধ্যে বাল্যবিয়ের হার বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কাও প্রকাশ করেন তিনি। সূত্রঃ আমাদের সময়
সিবিএনএ/এসএস
দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে cbna24.com
সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন