ধর্ষণের বিরুদ্ধে কবিতা / একটি একক দীর্ঘ কবিতা
আমিই সেই |||| পুলক বড়ুয়া
হোক সে নাবালিকা-কুমারী-ষোড়শী-অষ্টাদশী
অনাঘ্রাতা-বিবাহিতা
হতে পারে গরীব, প্রান্তিক, জনজাতি
হতে পারে কতকিছু—সংখ্যালঘু-সংখ্যাগুরু
সুন্দরী-কুৎসিত-অর্থবান-নিঃস্ব
ধর্ষণের আবার রূপ কী রঙ কী
ধর্ষণের আবার ক্ষণ কী
তার আবার মাপকাঠি আছে নাকি
তার আবার প্রকৃতি
চরিত্র
তার স্বরূপ তো একটাই
ধর্ষণই দর্শন
সে তো সেই
এ তো এই
ও তো ওই
তাকে চিহ্নিত করি—একবাক্যে একশব্দে
তার আর অন্য কোনো পরিচয় নেই
যে কোন বয়সী যে কোন রমণী হোক
ধর্ষিত বা ধর্ষিতা যাই বল না কেন
পু্রুষ হিসেবে তার সামনে আমার মাথা
হেঁট হয়ে আছে
পু্রুষ হিসেবে তার সামনে আমার মাথা
নিচু হয়ে গেছে
পু্রুষ হিসেবে তার কাছাকাছি যেতে
আজ আমি পরাঙ্মুখ
আমার অভিমুখ এখন আমার প্রতি
সবকিছু বুমেরাং হয়ে গেছে, আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ়
একজন পুরুষ হিসেবে আমি
বিপরীত লিঙ্গের কাছে
সমগ্র স্ত্রী জাতির কাছে
অর্ধেক লজ্জিত অর্ধেক মৃত
আমি আজ আর জীব নই, নির্জীব
আজ আমার জীবন নেই, আমি জীবন্মৃত
আমি পুরোপুরি পরিত্যাক্ত, অবাঞ্চিত
এই অসদুপায়ের দায়
কান্ডজ্ঞানহীনের মতো এড়াতে পারি না
দায়িত্ব নিয়ে স্বীকার করছি
আমাকে কবুল করতেই হবে
আমার কৃতকর্মের কথা
আমি স্বজ্ঞানে বলছি
আমার বলতে দ্বিধা নেই কোনো
আমার বলতে দ্বিধা নেই আজ
ভেতরে বাইরে আমি
আমাকে নিজেকে দিগম্বর করেছি
আমার পায়ের নখ থেকে করোটি-কুন্তল অবধি
আমার সমস্ত অপরাধের ঘা ও ক্ষত লেগে আছে
সমস্ত চিহ্নিত চিহ্ন
আমাকে বানিয়েছে আসামি
অমানুষ হিসেবে মানুষের কাছে আমি আজ স্বীকৃত-নিন্দিত
তিলে তিলে আর আজ আমি
নিশ্চুপ থাকতে পারি না
আমার মুখ লুকিয়ে রাখতে অক্ষম
দুর্মুখে কুলুপ এঁটে যে থাকে থাকুক
আমি কুপুরুষ হতে পারি
আমি তো কাপুরুষ হতে শিখিনি
কখনো কাপুরুষ হতে পারিনি
আমি কাপুরুষ নই
আমি অপৌরুষেয় পুরুষ
আমি মানে আমি—একমেবাঅদ্বিতীয়ম—
সবেধন নীলমণি—আমিই সেই—উত্তম পুরুষ
আমি ভালোবাসি নির্বিচার
উত্তম মধ্যমের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি
আমি মাফ চাই না
আমাকে দোষের দহনে দাহ কর
আমি কোনো দায়মুক্তির
দলবাজিতে ভিড়ে যাইনি
আমাকে দুর্দমনীয়—স্বাধীন নয়—
সর্বোচ্চ-স্বেচ্ছাচারী-চরম দন্ড দাও
আমার চরিতাভিধান থেকে
উড়ে গেছে, ছিঁড়ে ফেলেছি
ক্ষমা চাওয়ার-পাওয়ার পাতাটি
তাকে পাঠিয়েছি জোরপূর্বক-স্বেচ্ছানির্বাসনে
তোমাদের-তোমার-ওদের
বুকের দুর্বহ-জগদ্দল সদয়-পাথর
আমি সাদরে মাথা পেতে নেব
আমার দিকে তীব্র শরের মতো নিক্ষিপ্ত হোক
জঘন্য থুথু, কালিমাখা জুতো
একবিন্দু কাপুরুষ নই
বিন্দুমাত্র পলায়নবাদী নই
মহাপুরুষ তো নই-ই
বুকে-পিঠে সয়ে-বয়ে বেড়াবো
কি যে দ্রুত-শ্রুত-মধুর এবং
সবচেয়ে প্রিয় মনে হবে মারমার কাটকাট
সকলের অশ্রাব্য তর্জন-গর্জন
তোমাদের তীব্র নগ্নভাষ
প্রেতের নাচের মতোন শরীর ঘিরে
আশরীর শরীরী-নর্তনকুর্দন
অশরীরী নয়, আশরীর আওয়াজ
যার যা প্রাপ্য, কী সুন্দর—দেখ—
একজন অসভ্য-বিশুদ্ধ-বেয়াদব আমি—এবং আমিই
এই আমি বেশুমার বেতমিজ
রা-শূন্য বীতমানব-দানব এক
প্রতিবাদ-শূন্য এ
প্রতিরোধ-শূন্য এই
প্রতিশোধ-শূন্য ওই
তোমাদের হাতে একদম একা
নিজেই নিজেকে
আমার আমাকে
বলি দিয়ে এলাম
যাবতীয় বদলার কলকব্জার মুখে
বদলে যাওয়া আমাকে
অশ্লীল আমাকে
অপাঙক্তেয় আমাকে
অভাজন আমাকে
এই উন্মুক্ত আকাশের নীচে
হে বিপন্ন ভদ্রমহোদয়গণ, হে প্রিয় সুধীবৃন্দ,
ভাইসব, সমবেত সব্বাইকে আমার
অন্তিম-অভিবাদন
অশেষ শেষ-স্বাগতম
অনেক খোলাখুলি স্বাগত জানাতে পেরে
যারপরনাই কী যে আনন্দ লাগছে
ধন্যবাদ, জনাব, প্রতিহিংসাগণ
আমার মুখের তালা-খোলার চমৎকার
হে চাবিকাঠিবৃন্দ, নাগরিকবৃন্দ,
ভাঙচুরের সমস্ত কলকাঠিগণ, কুশীলবগণ
তোমাদের তথাকথিত শুভবাদী অসংখ্য প্রয়াস
লোক-দেখানো যাবতীয় লোকজ-তান্ডব
আমার অভাবিত অগণিত হে কিল-ঘুষি-লাথিগণ
হে প্রিয় খাপখোলা নাঙা তরবারিবৃন্দ
ওহে যতসব থানা-পুলিশ-আদালতহীন
দুনিয়ার দুঃশীল আইন-কানুন
উদ্যত-উদ্ধত-জঙ্গিমুদ্রা
নৃত্যপর আশু ভঙিমা
ভাই শোনো, আমাকে রদ কর
একটি বদবার্তাকে বধ কর
গণপিটুনির মতো গণআদালতে
দ্রুতগণবিচারের হাতে নিজেই নিজেকে
অগ্রিম-সোপর্দ করে উৎসর্গ করে এসেছি আজ
তোমরা আমার মামলা ত্বরা শেষ কর
আমাকে গুঁড়িয়ে দাও
তার আগে কিছুতেই দমবো না
ধুলোয় মিশিয়ে দাও
আমি ধূসর হব
দেহের সমস্ত অপদার্থ নাড়ি-নক্ষত্র
পায়ের নিচে পিষে যেতে দেব
আমার হাতে নেই ক্ষমাভিক্ষার পাত্র
অতিদ্রুত ক্ষমাহীন হোক তোমাদের হাত-পাগুলো
কোনো অপমানেই কোনো কারণেই
আহত হয়না এ অধম
সভ্যতার এ অদম্য পুরুষ
এ অসভ্য জানোয়ার
এ জান্তব বিক্ষত-ক্ষত-হত নর
যে মেয়েটি কুমারী, অথচ, গর্ভবতী
যে মেয়েটি কুমারী, কিন্তু, গর্ভপাত
ওই রক্তের দাগ আমার অক্ষর-টিপসই
আমার আঙুলের নির্লজ্জ স্বাক্ষর-ছাপ …
আমি সেই গুপ্ত হত্যাকারী
আমি সেই বিশ্বাসঘাতক
ওই সদ্যজাতমৃত-নষ্টভ্রষ্টভ্রূণের
অসম্পূর্ণ জনক, প্রতারক পিতা
আমি সেই লম্পট, খলনায়ক
আমি সেই নেপথ্য কালপুরুষ
প্রবঞ্চক ফেরারী প্রেমিক, অপ্রস্তুত পুরুষ
আমিই সেই আগাম আগামীর খুনি
অকাল মৃত্যুর হোতা
আমি সেই সুন্দরের শ্রেষ্ঠ সর্বনাশ
ওই যে পরম
ওই যে পবিত্র
ধর্মাধর্ম, কালাকাল
ওই যে অতীত-বর্তমান
ওই যে ভবিতব্য
ওই যে কাছের-দূরের
ওই যে গ্রাম ও শহরের গল্প
ওই যে মানবজাতির সঙ্গ, সংঘ
ওই যে মানুষের স্বাধিকার
বিজ্ঞান ও সভ্যতার প্রাধিকার
আধুনিক সংকট
ধন্য-গন্য-নগন্য
দুনিয়ার তাবৎ জাতিসমূহ
সকলের কাছে আমি এক
নতমুখ সন্তান
বিধ্বস্ত পিতা
লজ্জিত স্বামী
সকলের কাছে আমি এক
কালের কলি-কলঙ্ক-তিলক
আমি সেই চির অপ্রিয় পুরুষ
আমি সেই অন্ধ-অন্ধকার
কালরাত্রি
বিষন্ন বিষাদ
সর্বহারা
গরীব হলেও গরিমা থাকে মানব অগৌরবের হয় না
অমানুষ হলে মানুষ গৌরবগরীব—পাশব-দুর্বৃত্ত :
খুব সামান্য হলেও, সাধারণ হলেও
অসামান্য, অসাধারণ ক্ষতিকারক পদার্থ
তাই, ভূতলেও আমার এখন ঠাঁই নাই
ভূপৃষ্ঠে আমার ঠাঁই নাই
নাই—আমি থেকেও—শূন্য
খতম হয়ে গেছি সেই কবে
অতলে তলিয়ে গেছি মহাপ্রলয়ের আগে
আমি ঝড়ে ওপড়ানো মুখ থুবড়ে
শেকড় ওল্টানো বুকভাঙা হাহাকার
এখন আমার কেউ নেই
কোথাও কেউ নেই
নীরব-নিভৃত-নির্জন কোনো কঙ্কালও না
কেবল একাকী দাঁড়িয়ে
আমাকে ঘিরে অনেক
কিন্তু, আমার পাশে কেউ নেই
সবাই বৈরী-বিমুখ
যদি বঙ্গবেহায়াকে দেখতে চান আমাকে দেখুন
মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে
আমি কী আগন্তুক আমি কী অচিন
নাকি অন্য কেউ
ভিন গ্রহের কেউ
আগে আর কখনও এখানে আসিনি
আমি যেন কাউকে চিনি না
কখনও এখানে ছিলাম না
সত্যি সত্যি বড় একা লাগছে
একদম একা
আমিই এখন আমার দুর্বিনীত-সখা
জনান্তিকে একান্ত সাহস
সম্পূর্ণ একাকী প্রহৃত হতে
প্রবিষ্ট ও প্রস্তুত
সুপুরুষ
আমি সেই আদ্যপান্ত ত্রাস
আমি সেই আদ্যপান্ত নাশ
পায়ের নখ থেকে মাথার চুল অবধি প্রতি অঙ্গে
স্বরচিত পাপ, অভিশাপ
আমাকে অন্তরীণ কর
আমার অন্তিম মুহূর্ত
শেষ অবসান চাই
আমার চোখ মুখ হাত বেঁধে
অবাধ্য আমাকে নিয়ে যাও
অবাধ বধ্যভূমিতে
অঙ্গ থেকে অঙ্গ প্রত্যঙ্গ থেকে প্রত্যঙ্গ খুলে তুলে
নাও থেৎলে দাও
কীভাবে আমাকে আমার কাছ থেকে
তোমাদের কাছ থেকে এই
অসহ দুনিয়া থেকে
ছিন্ন করবে, কিস্যু জানি না
আমার বলার মতো কিছু নেই
কোনো অনুযোগ নেই
শরমে আমার মাথা কাটা যায় না
শরমে আমার মাথা কাটা যাবে না
আমাকে শিরশ্ছেদ কর
নত মম শির
আমি মাথা পেতে দিলাম
আমি নির্বিকার, আমি ভাবলেশহীন
আমি সবকিছু মেনে নিলাম, সমস্তকিছু
প্রভু, তুমি সেই আলো, আমি সেই নিরালোক
আমি দিব্যি ঘুমুব, আমি দিব্য গুম হব
ফায়ারিং স্কোয়াড … … …
ক্রস ফায়ার … … …
আমাকে সার্চ করছে
আমাকে খুঁজছে
আমি শুয়ে পড়ব
আমি শুয়ে পড়ছি
আমার অনাত্মা
শরতের ছেঁড়াখোঁড়া মেঘের মতন
পেঁজা তুলোর মতোন
অদৃশ্য হাওয়ার কাঁধে শেষবস্ত্রে সোয়ারী হবে
(জগদীশ্বরের হাতে তো কতো জাদু!)
আমার দম আটকে আসছে
শোনো, আমি সেই ইতর
আমি সেই সেরা পশু, নরপশু
আমি সেই গোপন তরল
আমি সেই নিষিদ্ধ গরল
আমিই সেই সুনামি
একে একে সবই ভেসে উঠছে
আমি সেই আদম
আমি সেই দুশমন
আমি সেই শয়তান
আমি নপুংসক নই
আমাকে অনধিকার-যৌনচর্চাচ্যুত কর
আমাকে সরাও আমাকে হঠাও
আমি কোনো প্রায়শ্চিত্ত করি না
আমার কোনো স্বীকারোক্তি নেই
আমার কোনো সবিনয় নিবেদন নেই
এসবের নিকুচি করেই এসেছি
এ আমার প্রার্থনা নয়
আমি এক অসমাপ্ত অভিশম্পাত
আমি এক অমীমাংসিত অভিশাপ
আমি সেই মনোনীত মনোযোগ
আমি সেই অসংখ্য অভিযোগ
আমি সেই কাঙ্ক্ষিত কাঙাল, বদমাশ বদনসীব
আমাকে আমার বরাদ্দ পাওনাটুকু
ঠিক মতো নিতে দাও
আমি তাকে পণ্য হিসেবে গণ্য করেছিলাম
এ ছিল আমার স্বরচিত পর্ণোগ্রাফি
তার বিরুদ্ধে তোমরা প্রতিবাদী হও
তার বিরুদ্ধে তোমরা প্রতিরোধ গড়ে তোল
কিন্তু, আমি চাই তোমরা কেবল
ক্ষিপ্ত নও, প্রতিশোধ নাও
কে কবে কেন কোথায় …
এ মুহুর্তে এটা কোনো গবেষণার বিষয়বস্তু না
উন্মুক্ত আলো-হাওয়া সাক্ষী
এখানে বিচার হোক, এখনই
সরাসরি আঘাত কর, আমাকে হামলা কর
পুলিশের নথি, পত্রিকার পাতা, প্রতিষ্ঠানের পরিসংখ্যান—এসব দিয়ে, ধুয়ে কেউ কি পানি খাবে
প্রকাশ পাক বা না পাক—টের পাওয়া মাত্র
তোমরা ঝাঁপিয়ে পড়
ধ্বংসের প্রকৃতচিত্র, অপরাধবিজ্ঞান—
এসব কেতাবি কথা রাখ—বাদ দাও—
এতসব যুক্তি-তর্ক—ছেঁদো কথা
কীসের তদন্ত : আক্রমণ কর
আমি তত্ত্বকথা, বুলি-কপচানো কম বুঝি, মানি না
আমি নিপাত হব, ধ্বংস হব, হাওয়া হব,
ঔদ্ধত্য নয়, এটাই
আমার নিপাট-বিধ্বস্ত-বাস্তবতা
একে ঢেকো না
হতাশা-নৈরাজ্য-অনাচারের বাতাবরণে
একে আচ্ছাদিত করো না
ধর্মীয়-জাতিগত বৈষম্যে
এখানে খুঁজো না ধর্মীয়-সামাজিক কারণ
অন্তর্গত রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়ন
যৌন অবদমন
নিছক রাজনৈতিক কোনো ফায়দা
এ স্রেফ খামখেয়ালিপনা-যৌনবিকার-ফ্যান্টাসী না
শায়েস্তা কর, তারপর কথা
তোমরা যা খুশি—তাই কর
তোমাদের যা ইচ্ছে—তাই কর
আমিও করেছি আমিও করেছি আমিও করেছি
বিলম্বিত হলেও—হে আসন্ন—হে প্রিয় পতন—
তোমাকে অবিলম্বে আলিঙ্গন করছি
তোমাকে স্বাগত জানাচ্ছি, আমাকে
শাস্তি দাও
স্বস্তি দাও
শান্তি দাও