ভ্রমণ

একজন প্রবাসী বাংলাদেশির জীবন কাহিনী

আমস্টারডাম-থেকে-এথেন্স

পূর্ব প্রকাশের পর…

তৃতীয় পর্ব


একজন প্রবাসী বাংলাদেশির জীবন কাহিনী

৭৪ এর বন্যা থেকে মানবসৃষ্ট দুভিক্ষ,আর ১৯৭৫ সালে   বঙ্গবন্ধু কে সপরিবারে হত্যা, চারি দিকে হাহাকার, চুরি-ডাকাতি, খুন-রাহাজানীতে দেশের মানুষ নিরাপদে ঘুমাতে পারত না !

সেসময় সবেমাত্র আমাদের দেশের লোক মধ্যপ্রাচ্যে যাওয়া শুরু করেছে ! সেসময় ইরান ছিল বেশ ধনী দেশ। তৈল উত্তলনের দিক দিয়ে পারসিয়ান উপকূলের দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম!

১৯৭৭ ইংরেজির সম্ভবত মে কিংবা জুনে ইরানের উদ্দেশ্যে জীবিকা অর্জনের জন্যে বিমান বাংলাদেশ এয়ার লাইনসে  ঢাকা থেকে দুবাই হয়ে বন্দর আব্বাসে আমার এক আত্মীয় থাকত, তার সহযোগিতায় আমার ইরান যাওয়া! অন্যান্য বিভিন্ন দেশের ভিসা থাকলেও ইরানের কোন ভিসা ছিল না !

ঢাকার সেই তেজগাঁও-এর ছোট এয়ারপোর্ট যা আজ ও মনে পরে । জীবনে প্রথম বিদেশ যাওয়া ফলে মোটামুটি সবায় এসেছিল এয়ারপোর্টে, বিশেষ করে মা বেশী কান্নায় ভেঙ্গে পরেছিলেন !সময় ঘনিয়ে এলো বোডিং পাশ নিয়ে ভিতরে ওয়েটিং রুমে চলে গেলা্ম।  বিমান টি ছিল সম্ভবত ডিসিটেন বা ছোট বোয়িং হবে তা আর এখন মনে নেই।  এয়ারপোর্টে হঠাৎ দেখা হয়ে গেল আমাদেরই গ্রামের আমার ক্লাসমেট বন্ধুর বোন মাহমুদার সাথে। সেও যাবে ইরাকে। ওর হাসব্যান্ড থাকে ইরাকে। ভালই হলো একজন মেয়ে সাথী পেয়ে গেলাম, তারপর আবার ক্লাসমেট বন্ধুর বোন!, গল্প  করে দুবাই পর্যন্ত যাওয়া যাবে, দুজনের সিটও পাশাপাশি,  একসময় ওকে পছন্দ করতাম !

আমরা ওয়েটিংরুমে অপেক্ষা করছিলাম, সারপ্রাইজ হঠাৎ দেখতে পেলাম নায়ক রাজ রাজ্জাক ও তার বউ লক্ষীকে, এই প্রথম অতিকাছ থেকে  নায়ক রাজ রাজ্জাককে দেখলাম। আকাশী রংগের সাফারি স্যুট পড়া। যতক্ষন তিনি ওখানে ছিলেন, তাকে দেখেছিলাম শুধু বার বার এদিকসেদিক ঘোরাঘুরি করে নিজেকে দেয়ালের আয়নাতে দেখে নিয়েছিলেন। তার মুখে কিছু  দাগ ছিল ! আমি তাকে সাহস করে বলে ছিলাম, রাজ্জাক ভাই আপনি আমার প্রিয় নায়ক, আপনার কোন ছবি আমি দেখা বাদদেইনি, শুনে হাসলেন আর বলেছিলেন তাইনাকি, ওনার বউও হাসছিলেন , তারপর আমাকে প্রশ্ন করলো তুমি যাচ্ছ কোথায়? বলেছিলাম ইরান হয়ে জার্মানী যাব! Very Good, Good Luck । আমি তাকে জিজ্ঞাস করলাম, আপনি কোথায় যাবেন? মুম্বাই !

ওনার সাথে কথা বলতে বলতে একটু দেরী হয়েগিয়েছিলো। মাহমুদাকে বলেছিলাম তুমি প্লেনে গিয়ে বস, সে আমার আগের বাসে চলে যায়, তখন প্লেন থাকত অনেক দুরে। এনাউন্স আসলো দুবাই যাত্রী যারা বাকি আছে বাসে গিয়ে বসুন। নায়ক রাজ চলে গেলেন vip ভাবে, আমি তারা হুরো করে বাসে গিয়ে বসলাম। প্লেনে গিয়ে আমার সিট খুঁজতে ছিলাম, দুরথেকে ডাক আসলো ভাই এখানে আসেন, আমার সিটে গিয়ে বসলাম, একটু পরে প্লেন উঠলো।  জীবনে প্রথম প্লেন জার্নি, উপরে উঠার সময় একটু ভয় পেয়েছিলাম, বসে বসে মাহমুদার সাথে গল্প করেছিলাম যাকে একদিন পছন্দ করতাম, সে-ই আজ আমার পাশের সিটে বসে ইরাক যাচ্ছে । ভাবছিলাম, ভাগ্য বলে কথা অনেক অনুভুতির সৃষ্টি হলো এবং নিজেকে অনেক ধন্য মনে করেছিলাম সেদিন। এটাই মাহমুদার সাথে মনে হয় শেষ দেখা, আর কোন দিন দেখা হয়নি । আমি প্রবাসী আছি , আর ও শুনেছি ইরাক যুদ্ধে দেশে চলে গেছে! গল্প  করতে করতে রাতের ডিনার চলে এলো, প্রথম প্লেনে খাবারও সমস্যা ছিল, দেশে হাত দিয়ে ভাত খেতাম, এখন নাইফ আর ফর্ক দিয়ে খেতে হবে !  ৪/৫ ঘন্টার জার্নি ! মাঝখানে দুজনে একটু ঘুমিয়েও পরেছিলাম!

হঠাৎ এনাউন্স আসলো কিছুক্ষনের মধ্যে দুবাই ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করবে। ভুলেগেছি ফ্লাইটটা ছিল মুম্বাই হয়ে দুবাই । মুম্বাইতে একঘন্টা দেরী করেছিল। তারপর প্লেন ল্যান্ড করার আগে তখনো সকাল হয়নি, জানালা দিয়ে দেখেছিলাম দুবাই শহরের লাইট যদিও সে সময় দুবাই এত উন্নত ছিলনা, আমার সিট ছিল জানালা আর ওর ছিল আমার বাম পাশে। ও নিজেই ইচ্ছাকরে আমার উপর ঠলেপরে বাহিরের দৃশ্য দেখছিলো! কি আর করা মন খারাপ নিয়েই শুনলাম সবাই সিটবেল্ট বাধছে। অল্পক্ষণ পরেই প্লেন ল্যান্ড করল।  সকাল হয়ে এলো।  চলে গেলাম সিঁড়ি দিয়ে নিচে, লাগেজ কালেক্ট করতে ! আমার জন্য নতুন দেশ, নতুন যাত্রা তারপরেও মন শুধু মাহমুদার কাছে।

সবায় যার যার লাগেজ কালেক্ট করছে, মাহমুদাও ওর লাগেজ কালেক্ট করলো। আমার লাগেজটা আর আসতেছে না, সবায় যার যার লাগেজ নিয়ে চলে গেল, হঠাৎ লাগেজ বেল্টটা থেমে গেল, মনে হলো আর লাগেজ নেই। আমি এয়ারপোর্ট অথর্রিটিকে প্রশ্ন করলাম আর কোন লাগেজ নেই? ওরা বললো না আর কোন লাগেজ নেই। তখন মাহমুদা আমাকে বললো ভাই, আপনি প্লেনে উঠার সময় আপনার লাগেজ কোনটা দেখিয়ে দেন নাই? আমি বললাম না, আমিতো জানিনা কেউ বলেনি, অন্য একজন মহিলাও বলে ছিল প্লেনে উঠার আগে আপনার লাগেজ সনাক্ত করেননাই ! সে সময় বিমানের এ নিয়ম ছিল !

মনটা খারাপ হয়ে গেল, আরও একজন মহিলা এসে বললো সে সবার শেষে প্লেনে উঠেছে, সে একটা ব্রাউন কালারের লাগেজ দেখেছে মাটিতে পড়েআছে, ওটাকে কেউ সনাক্ত করেনাই, ওটা ঢাকাতেই পড়ে আছে । নিজের প্রয়োজনীয় সব জিনিস ছিল লাগেজের ভিতর! সাথেছিল একটা হ্যান্ড ব্যাগ সেখানে একটা শাট, একটা প্যান্ট আর কিছু টুকটাক জিনিস ছিল, কিছু হ্যান্ডি ক্রাফস ছিল ! কি করা যায়, মনটা ভীষণ খারাপ। সন্ধায় বন্দর আব্বাসে ফ্লাই আর ওর হলো আমার একটু আগে। দু’জনে এয়ারপোর্ট fast food খেলাম। পরে কি করা যায় ভাবছি, হাঁটতেছি এয়ারপোর্ট লবি দিয়ে, হঠাৎ দেখতে পেলাম  আমাদের গ্রামের নুরু ভাই আসতেছে হেঁটে!  নুরু ভাই সে সময় বিমানের চীফ ইন্জিনিয়ার ছিল। সেসময় ওনাকে দেখে আমি আমার লাগেজের ব্যাপারে বলতেই, ওনি বললেন আমাদেরতো দুবাইতে কোন অফিস নেই, তুমি PIA এর অফিসে যাও, বাংলাদেশ বিমান তখন PIA এর অফিসের মাধ্যমে কাজ করে, আমি আমার লাগেজ লস্ট ক্লেম করলাম, তিন হাজার টাকা !

তারপর মাহমুদাকে বিদায় দিলাম, ও চলেগেল ইরাক এয়ারলাইন্সে, চলেযাবার সময় আমাদের বাঙালি পরিবারের যে একটা মায়ামহব্বত আছে সেটা ফুটে উঠেছিল  দুজনের মাঝে ! আজ আর নয় আবার আসব চতুর্থ  পর্বে…।  দুবাই থেকে ইরানের বন্দর আব্বাস দিয়ে ভিসা ছাড়া কি ভাবে ইরান প্রবেশ করেছিলাম আর তখন কি হয়েছিলো… !

 রশিদ খান, ব্যবসায়ি ও কমিউনিটি নেতা।

‘ একজন প্রবাসী বাংলাদেশির জীবন কাহিনী ’  একজন প্রবাসীর জীবনযুদ্ধের ধারাবাহিক ঘটনা প্রবাহ! আপনিও লিখতে পারেন প্রবাস জীবনের স্মৃতি নিয়ে… সিবিএনএ২৪ডটকম আপনার স্মৃতিচারণের অপেক্ষায়। চোখ লাখুন, সঙ্গে থাকুন সিবিএনএ-এর সঙ্গে।

সিএ/এসএস


সর্বশেষ সংবাদ

দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com

সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

সংবাদটি শেয়ার করুন