দেশের সংবাদ পরিবেশ ও জীব বৈচিত্র্য ফিচার্ড

কমলগঞ্জের ছনখোলা এলাকাকে বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল হিসেবে সংরক্ষণ

কমলগঞ্জের ছনখোলা এলাকাকে বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল হিসেবে সংরক্ষণ করতে বনবিভাগের উদ্যোগ সহযোগীতা চেয়ে জেলা প্রশাসককে চিঠি
 
মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার সীমান্তবর্তী কুরমা চা-বাগানের ০৮নং সেকশনের একটি অংশের নাম ‘ছনখোলা’। ১০ একর আয়তনের ছনখোলা এলাকাটি ঘাস ও ছন আচ্ছাদিত গো-চরণভূমি। শুষ্ক মৌসুমে এখান থেকে স্থানীয় জনগোষ্টী কিছু ছন সংগ্রহ করলেও বছরের অধিকাংশ সময় গবাদি-পশু চারণ ভূমি হিসেবে পরিত্যক্ত থাকে। সম্প্রতি কুরমা চা-বাগান কর্তৃপক্ষ ঘাস-গুল্ম ও ছন আচ্ছাদিত স্থানটি সম্পূর্ণ পরিষ্কার করেছে। এতে মুনিয়াসহ অনেক বিরল ও বিপন্ন পাখির আবাসস্থল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ অবস্থায় ছনখোলা এলাকাকে জাতীয় স্বার্থে বন্য প্রাণীর আবাসস্থল হিসেবে সংরক্ষণ করা প্রয়োজন হয়ে পড়েছে বলে মনে করে বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ। স্থানটি সংরক্ষণে ‘মুনিয়া পাখির অভয়াশ্রম’ ঘোষণা করতে মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসকের সহায়তা চেয়ে বন বিভাগের বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ থেকে অনুরোধ করা হয়েছে।
 
বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের মৌলভীবাজারে অবস্থিত সিলেট বিভাগীয় কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ন্যাশনাল টি কোম্পানির (এনটিসি) কুরমা চা-বাগানের ৮ নম্বর সেকশনের ১০ একর ছনখোলা এলাকা জীববৈচিত্র্যের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান। ছনখোলাকে মুনিয়া পাখির অভয়াশ্রম ঘোষণার বিষয়ে সহযোগিতা চেয়ে ২০২১সালের ১৯ ডিসেম্বর মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসককে চিঠি দিয়েছেন বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ সিলেটের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. রেজাউল করিম চৌধুরী।
 
জেলা প্রশাসকের কাছে প্রদানকৃত চিঠিতে বলা হয়েছে, ছনখোলা এলাকাটি ঘাস ও ছন আচ্ছাদিত একটি গোচারণ ভূমি। শুষ্ক মৌসুমে এই এলাকা থেকে স্থানীয় লোকজন কিছু ছন সংগ্রহ করলেও অধিকাংশ সময় গবাদিপশুর চারণভূমি হিসেবে পরিত্যক্ত থাকে। কয়েকজন প্রকৃতিপ্রেমীর মাধ্যমে জানা যায় স্থানটি বেশকিছু বিচিত্র ও মূল্যবান বন্যপ্রাণীর বিচরণক্ষেত্র। পরে ২০২১ সালের ২২ ও ২৭ জানুয়ারি বন বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. রেজাউল করিম চৌধুরী দিনব্যাপী সেখানে অবস্থান করেন। এ সময় তাঁরা বিভিন্ন জাতের পাখি ও স্তন্যপায়ী প্রাণীর বিচরণ দেখতে পান। সচরাচর অন্য স্থানে দেখা মেলে না এমন পাখি সেই স্থানে তারা দেখতে পেয়েছেন। এসব পাখির মধ্যে আছে- বিভিন্ন জাতের মুনিয়া, গোল্ডেন ক্রিষ্টিকোলা, লাল রঙা আভাদাভাত (লাল মুনিয়া), সাইবেরিয়ান স্টোনচাট, বাটন কোয়েল এবং কয়েক প্রজাতির পেঁচা। এছাড়া স্তন্যপায়ী প্রাণীর মধ্যে খরগোশ ও শেয়াল ছিল।
 
বিরল ও বিপন্ন বন্যপ্রাণীর অভয়াশ্রম হিসেবে ঘোষণার বিষয়ে জেলা প্রশাসকের হস্তক্ষেপ চেয়ে চিঠিতে বলা হয়েছে, মুনিয়াসহ বিরল ও বিপন্ন প্রজাতির পাখি ও বন্য প্রাণী স্থানীয়ভাবে বিলুপ্তি থেকে রক্ষার স্বার্থে এনটিসিকে ২০২১ সালের ৩ মার্চ বন বিভাগের পক্ষ থেকে একটি চিঠি দেওয়া হয়েছিল। ছন আচ্ছাদিত এই ভূমি সংরক্ষণ ও চা-গাছ লাগানোর মাধ্যমে ওই স্থানের কোনোরূপ পরিবর্তন না করার বিষয়ে চিঠিতে বলা হয়েছিল। তবে সম্প্রতি চা-বাগান কর্তৃপক্ষ ছনখোলা সংরক্ষণ না করে সম্পূর্ণ পরিষ্কার করেছে। মুনিয়াসহ বিরল ও বিপন্ন প্রজাতির পাখি ও বন্যপ্রাণী স্থানীয়ভাবে বিলুপ্তি থেকে রক্ষার স্বার্থে ১০একরের ছনখোলা এলাকাকে মুনিয়া পাখির অভয়াশ্রম হিসেবে ঘোষণার বিষয়ে জেলা প্রশাসকের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। জেলা প্রশাসকের সহায়তার মাধ্যমে ছনখোলাকে অভয়াশ্রম ঘোষণা করা হলে স্থানটি বাংলাদেশের এস.ডি.জি-১৫ এর লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখবে বলে দেশের খ্যাতিনামা সকল বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞদের অভিমত। এ ছাড়া চিঠিতে কুরমা চা বাগানের ৮নং সেকশনের ১০একর ছনখোলা এলাকাকে বিরল ও বিপন্ন বন্য প্রাণীর আবাসস্থল হিসেবে সংরক্ষণের বিষয়ে জেলা প্রশাসকের দপ্তর থেকে এনটিসিকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদানের জন্য অনুরোধ করা হয়েছে।
 
স্ট্যান্ড ফর আওয়ার এনডেঞ্জার্ড ওয়াইল্ডলাইফের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও বন্যপ্রাণী আলোকচিত্রী খোকন সিংহ সিবিএনএকে বলেন, বাংলাদেশে গোল্ডেন হেডেড ক্রিস্টিকোলার একমাত্র প্রজননক্ষেত্র হলো ছনখোলা। দেশে আর কোনো দ্বিতীয় প্রজননক্ষেত্র এখনো পাওয়া যায়নি। পাখিটি খুবই বিরল। শীত মৌসুমে বিভিন্ন বিরল প্রজাতির পাখির দেখা পাওয়া যায় এখানে। এছাড়া লাল রঙা আভাদাভাত (লাল মুনিয়া) পাখিটি দেশের আরো কয়েকটি জায়গায় ক্ষুদ্র পরিসরে থাকলেও এই এলাকাতে প্রচুর পরিমাণে রয়েছে। এখানে প্রতি ঝাঁকে ১৫০-২০০টি পাখি থাকে।
 
কমলগঞ্জ জীববৈচিত্র্য রক্ষা কমিটির সভাপতি মঞ্জুর আহমেদ আজাদ মান্না বলেন, এই স্থানে বিরল ও বিপন্ন প্রজাতির বিভিন্ন জাতের পাখি ও প্রাণীর বিচরণ রয়েছে। এই স্থানটি সংরক্ষণ করলে পাখি ও প্রাণীগুলো বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পাবে।
 
বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ সিলেটের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. রেজাউল করিম চৌধুরী সিবিএনএ প্রতিবেদকে বলেন, ‘চা-বাগান কর্তৃপক্ষ স্থানটির গুরুত্ব বুঝতে পেরে এখন একমত হয়েছে, তারা ছনখোলায় আর চা-বাগান বা বনায়ন করবে না বলে জানিয়েছে। এই অবস্থায় থাকবে। কিন্তু এর আগেও বিষয়টি এনটিসিকে বলা হয়েছে। তারপরও তারা সম্প্রতি বাগান করার জন্য ছনখোলা এলাকার এ জায়গাটির  পরিষ্কার করে। এবার জেলা প্রশাসককে বিষয়টি জানানো হলো। স্থানটি আমাদের মন্ত্রণালয় থেকে অভয়াশ্রম ঘোষণা করা হবে। এ বিষয়ে জেলা প্রশাসকের সহায়তা প্রয়োজন।’
 
এ বিষয়ে আলাপকালে মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক মীর নাহিদ আহসান মঙ্গলবার দুপুরে মুঠোফোনে সিবিএনএ প্রতিবেদককে বলেন, ‘চিঠির বিষয়ে বিভাগীয় বন কর্মকর্তা সঙ্গে কথা হয়েছে। বিষয়টি বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সম্পাদিত হবে। বিষয়টি প্রক্রিয়াদিন আছে।’
সংবাদটি শেয়ার করুন