লেখালেখি

করোনার শিকল


করোনার শিকল । মানুষের অসুখ হলে সেটা শরীরে আগে থেকেই টের পাওয়া যায়। কিন্তু করোনার ভাইরাস কোথা থেকে কিভাবে,কোন সুত্রে আসবে সেটা জানা যায় না। যে কোন মুহূর্তে যে কোন ঊপায়ে ভাইরাস ডুকে পড়তে পারে শরীরে। তাই একটাই পথ সাবধানে থাকুন । কিন্তু কিভাবে ?

মাত্র ৩ মাস আগেও যে লং টার্ম হোমে কাজ করেছিলাম সেখানে ৫-৬ জন রোগী থাকেন, যারা হাত নেড়ে খেতে পারে না। ২৯ বছরের মেয়ে স্টেফি গত ২০ বছর ধরে হুইল চেয়ারে জীবন পার করছেন। স্টেফিকে মাত্র এক ঘণ্টা একা রাখা উচিত না, তাহলে স্টেফিকে কে দেখবে? কে যাবে ওকে ধরে ধরে সব কাজ করাতে? তার জীবন কি নিরাপদ, সে কি করে ঘরে থাকবে, তাহলে স্টেফিকে বাচাবে কে? এমন বিলিয়ন বিলিয়ন অবস্থা প্রতি সেকেন্ডে মোকাবেলা করেই করোনার শিকল পড়ে আছি আমরা অনেকেই । এটাই বাস্তবতা , এটাই জীবন।

বাবাকে সেবা করতে কিছু মানুষকে যেতেই হবে, তারা কি করে সাবধান থাকবে? আমার মা আছেন সারাক্ষণ বাবার আশেপাশে কোন ভাইরাস ঠেকাবেন মা, কোভিড নাকি বাবা? কোভিডের শিকল না থাকলে হয়তো এতক্ষণ আকাশে থাকতাম, বাবার কাছে ফিরছি আমরা। হয়তো এই মুহূর্তের যন্ত্রণা অন্যভাবে আসতো এই জীবনে।

৮৩ বছরের অসুস্থ্ বাবা পড়ে আছেন বিছানায় এ মুহুর্তে ঢাকায়, ধানমণ্ডির অতি পরিচিত বাসায়। যে চার কন্যা সন্তানকে জন্ম দিয়ে বাবা সারজীবন গরুর মুখে যেমন খাচা বা ঠুসি লাগানো থাকে, তেমনি বাবার জীবনে হয়তো একটা চাকরির ঠুসি লাগানো ছিলো আজন্ম। অনেক কথা আসছে, পরিবারের মেয়েদের কাছে থেকে, অনেকের কাছে থেকে , ভালো মন্দ সব কথা সবাই চাপা স্বরে নিচু গলায় বলে চলছেন অনবরত। কিন্তু আমার এই শূন্য ঘরে, ভীষন একাকী নিঃসঙ্গ প্রবাস জীবনে বার বার নিজেকে প্রশ্ন করছি কেন বাবা চাকরি করতেন? কেন বাবা সব ছেড়ে কাজ ভালোবেসেছিলেন? আর কি পথ খোলা ছিলো বাবার সামনে? বাবা কি কোনদিন নিজের মুখ থেকে ওই ঠুসি খোলার কথা ভেবেছিলেন?

এই করোনার কালে বাবাকে দেখতে অনেকে আসছেন। আমরা তো যেতে পারছি না। এই চার মেয়ে যাদের মুখে অল্প এক্টু ভাত আর একটা মাথা গোজার মাত্র একটা ঘর জোগাড় করতে আব্বার জীবন থেকে ৮৩ বছর পার হয়ে গেলো। আব্বা হয়তো কোনদিন ভাবেননি-এর চেয়ে ভালো আব্বা আমাদের রাখতে পারতেন কি না? এর চেয়ে ভালো বাবা নিজেও থাকতে পারতেন কি না ? যেমন আমি ভাবতে পারি না- ঝুকি নিতে ভীষন ভয় পাই, বার বার মনে হয় এই তো ভালো আছি- তাই হয়তো আরো ভালো থাকা হয়নি বাবার মতো আমারও? টাকা, বাড়ি কিছুই হয়নি, শূন্য হাতেই –দেনা-পাওনা বিহীন এক অতি সাধারন জীবন।

বড় মামা বলতেন, শোন লুনা- টাকার জন্য লোভ না থাকলে টাকা বানানো যায় না। অনেক টাকা আছে তাই আমার বড়মামার, সেটা কি মামাকে সুখী করেছে? খুব গোপনে জানতে ইচ্ছে করে। যদি তাই হয়ে থাকে তাহলে মামা ছোট একটা নামাজের পাটিকে আশ্রয় করলেন কেন গত ২০ বছর? কেন বড়মামা ঢাকা শহরের বিভিন্ন কোনায় কোনায় তার যেসব এপার্টমেন্ট আছে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতে পারছেন না? বা ওই যে দারুন জনপ্রিয় ইরফান খান- মাত্র ৩৬০ কোটি টাকা রেখে গেছেন, তিনি-ই বা কেন টাকা আর ক্ষমতা দিয়ে মৃত্যু আটকে দিতে পারলেন না?

ঢাকা থেকে গত ৪ দিন আম্মা ভিডিও পাঠাচ্ছেন, আব্বার বর্তমান অবস্থার ভিডিও। কখনো আব্বা নাস্তা করছেন, কখনো বাথরুমে যাচ্ছেন, বা কখনো কেউ আব্বার সাথে কথা বলছেন, আম্মা সেইসব ভিডিও পাঠাচ্ছেন আমাদের চারবোনকে। অসহায় আমরা, অনেক অনেক কষ্টের অপেক্ষার আর বিনিদ্র রজনীর স্বপ্নের সেই আমেরিকা-কানাডার কাগজ আছে চারবোনের হাতেই। সময় আছে, প্লেন ধরার মতো অবস্থাও আছে- কিন্তু করোনা বন্ধ করেছে সব চলাচল। সারা বিশ্বের মানুষ এক অদৃশ্য শিকলে বন্ধী। এটা কোভিড কাল তোমার হাতে কিছুই নেই অপেক্ষা করা ছাড়া।

কি নিয়ে অপেক্ষা করে আছি আমরা চারবোন? আমিই কি কেবল অন-লাইন অফিসের সময় ফাকি দিয়ে বাবাকে ভাবছি? কেবল মন চলে যাচ্ছে বাবার গোটা জীবনের দিকে? কি করে পাড় করলেন বাবা এই দীর্ঘজীবন? মনে করার আপ্রান চেস্টা করছি বাবা আর কি কি ভালোবেসেছিলেন নিজের নিত্যদিনের কাজ ছাড়া? আর কি –ই বা করতে পারতেন এই জীবন জুড়ে ?

সত্যটা কি জানেন পাঠক, বাবার ওরসে আমরা জন্ম নিয়েছিলাম মেয়ে হিসেবেই। বাবাও আমাদের মেয়ে হিসেবেই দেখতেন। পৃথিবী জয় করে , আমেরিকা /কানাডায় নিজেদের মতো করে জীবন চালাবো এমন স্বপ্ন বাবা যে অন্তত কোনদিন দেখেন-নি সেটা আর কেউ না জানুক, আমরা জানি বা বিশেষ করে আমি তো বিস্বাশ করি মনে প্রানে। তবুও এই কয়েকবছর আগে আব্বা নাকি একদিন অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে কাকে যেন বলেছেন, “আমার চার মেয়ে আছে , আমার জন্য ভাবনার দরকার নেই তোমাদের?” জীবনের শেষ বছরগুলোতে কি বাবা ভীষন গৌরব আর অহংকার পুষে রাখতেন আমাদের জন্য? জানা তো হলো না সেই কথা । এমন কত কত প্রশ্ন , ইচ্ছে , কথা বাবাকে ঘিরে মন আচ্ছন্ন হয়ে আছে ।

বেশ কিছু খাড়া পথ পাড় হতে হয়েছে, মনে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃবিজ্ঞান বিভাগে চান্স পাবার সাথে সাথে আরো ৪ টা বিভাগে চান্স পেয়েছিলাম, সাভারের পিএটিসির বাসায় এক অপরূপ বিকেলে অফিস ফেরতা বাবার সাথে আসলেন এক ত্রুণ অফিসার। নাম সুপথ কুমার ঘোষ। বাবা বললেন, না লুনা , ভুগোল বিভাগেই ভর্তি হোক অন্তত কলেজ টিচার তো হতে পারবে। সুপথ আঙ্কেল বাধ সাধলেন, ঘাড় নিচু করে মাথা চুলকে চুলকে বাবাকে বললেন, না স্যার আমার কথাটা রাখেন স্যার। বাংলাদেশে নৃবিজ্ঞান নতুন সাবজেক্ট , এখানে অনেক অনেক বেশী সম্ভবনা, লুনাকে এই সাবজেক্টেই ভর্তি করান স্যার দেখবেন অনেক অনেক জব আসবে সামনে।

আজন্ম ঝুকি নিতে না পারা , গড়পড়তা নিন্ম মধবিত্ত বাবা – একটা বক্স থেকে বের হলেন সেই বিকেলে , হাটা শুরু করলাম অজানা পথে – জীবনের এই অপার নতুন পথের যাত্রার জন্য কার কাছে ঋণ স্বীকার করবো আমি বাবা নাকি সুপথ আঙ্কেল ?

বিয়ে করেছিলাম নিজের ইচ্ছাতেই , বাবা বাধা দেননি, হয়তো ভেবেছেন, লুনার মতো মিছিল /মিটিং করা , ঢাকা শহর চষে বেড়ানোর মেয়ের জন্য বাবা কি পাত্র ঠিক করবেন ? কিন্তু আজকে মনে পড়ছে বাবা,র সেই মুখ – যেদিন আমি সম্পর্ক ছিন্ন করতে যাবো – দপুরে বাবা এক্টু কোরান পাঠ করছিলেন – আগে থেকেই সব প্রস্তুত করা ছিলো – যেহেতু নাইয়ার বাবা আর আমি মিঊচুয়াল ডিভোর্স করেছি তাই আজ ১৯ বছরেও কোন অনুতাপ বা ক্ষেদ নেই- তবুও সেই বিকেলে বাবার কাছে গেলাম, বাবা কোরান পাঠ শেষ এক্টু দোয়া করতে বসবেন হয়তো – বাবাকে জানালাম- বললাম – “আব্বা আমি এই কাজে যাচ্ছি, আজ ফাইনাল কাজ শেষ করে ফিরবো , বাবা কি একবার আমার মুখের দিকে তাকালেন ? বাবা কি এক মুহুরতের জন্য ভাবলেন – মেজো মেয়ে লুনা, যার কোলে মাত্র ১১ মাসের শিশু সন্তান – সে কি পারবে এই পথে একলা হাঁটতে ? তবুও বাবা খুব নীরব স্বরে জানতে চাইলেন –তুমি ভালো করে চিন্তা করছো তো ? বললাম – হ্যা আব্বা তুমি ভেবো না – আমার জন্য দোয়া করো ।আব্বা আবার কোরান তা টেনে নিলেন হাতে । সেই নৃবিজ্ঞান বিভাগের মতোই আব্বা,র সাথে কথা বলেই একটা নতুন জীবন শুরু হলো ৩০ বছর বয়সে – আমিও গ্রুর মতই , বা অনেকটা বাবার মতই নিজের মুখের সাথে পড়িয়ে নিলাম ঠুসি – অদৃশ্য ঠুসি – একলা চলার খাচা ?

আব্বা কি ভীষন একলা ছিলেন ?? আমার বাকী বোনেদের ভাষায় বা অনেকটা আমার মায়ের ভাষাতেও আব্বার নাকি কোন গভীর বোধ ছিলো না- আব্বার নাকি গভীর অনুভুতি ছিলো না – আসলে কি মনে হয় জানেন – যেসব মানুষের ঘাড়ে – সন্তানদের দায় , বাসা ভাড়া, টেবিলে ভাত যোগাড় করা , বা মাসকাবারি বেতনের চিন্তা থাকে, বেতন উপরে জীবন চলে — এইসব ভাবনা বা গভীর বোধ তাদের না থাকাই ভালো – এইসব বোধ /ফোদ তো কষ্ট ছাড়া কিছু দেয় না শেষ অর্থে– তাই না ? এই যে এত সব গভীরতা দিয়ে ২০ বছরের ছেলে নাইয়ে কে বড় করলাম , কি এমন দশদিক ঊদ্ধার করলাম ? নাকি বোধহীন যে বাবা ৮৩ বছর গরুর ঠুসি মুখে দিয়ে আমাদের ভাত কাপড় দিয়েছেন , তার শেষ সময়ে আমরা কি দৌড়ে যেতে পারছি ? জীবনে সঠিক সময়ে কিছু করা বা সঠিক প্রাপ্তি যে একাবারেই হয় না , হতে দেয় না জীবন এটা বুঝতে অনেকটা সময় গড়িয়ে যায় – অনেকে-র গেছে , আরো যাবে- ।

আর কয়টা দিন সময় আছে আব্বার হাতে ? হয়তো অল্প কয়েকটা দিন বা হয়তো বেশ কিছু বছর – কিছুই জানি না , কান্নাও আসছে না এই মুহূর্তে , শেষ করবো লেখা , কি বলবো নিজেকে ? আব্বা কষ্ট না পাক, আব্বা কষ্ট না পাক, আব্বা যন্ত্রনা না পাক- এই ছাড়া আর তো কিছু আসছে না মাথায় , অন্য কোন কাজে মন ও বসে না, কেমন নিঃস্প্রান লাগছে চারপাশ ।

এই তো ২০১৯ এ মার্চ মাসে আব্বার মাথায় হাত রেখেছিলাম আমরা চারবোন -ধানমণ্ডির বাসা ছাড়ার আগে- মধ্যরাত তখন , বাবা বিছানাতেই ছিলেন- তার কয়েক দিন আগেই আব্বা বলেছিলেন – তিনি তার চার-মেয়েকে দেখেছেন – তিনি চলে গেলে আমরা যেনো দেশে ফেরার জন্য তাড়া না করি – খুব অল্প সময়ের ভিতরেই যেনো তাকে মাটিতে শুইয়ে দেয়া হয় – এই কোভিড কি বাবার শেষ কথা পালনের জন্যই পথ রোধ করে দাড়ালো ? আল্লাহ , তুমি আমার বাবার ব্যাথা কমিয়ে দিও খোদা , আমার বাবার যন্ত্রনা কমায়ে দাও আল্লাহ ।

করোনার শিকল-২

ধ্যরাতে সেলফোনের নীলাভ আলো জ্বলে ওঠে, ঢাকা থেকে ফোন। প্রতিমুহূর্তে প্রস্তুত রাখছি নিজেকে, নিজের মনকে। আব্বার যেকোনো খবর যেকোনো মুহূর্তে আসবে। একটাই প্রার্থনা কম কষ্ট পাক আব্বা। বয়স হয়েছে। একটা গোটা জীবন পা করেছেন আব্বা। ৮৪ বছর বয়স একটা সম্পূর্ণ জীবন পার করেছেন, আর কি চাওয়ার আছে? তবু যতক্ষণ বেঁচে আছেন ততক্ষণ হয়তো একটাই কথা বেঁচে তো আছেন।

আসলে একটা কথা আছে বাংলায়, ‘যার যায় সে জানে’। আমার এক বন্ধুর বাবা ১৮ বছর নার্সিং হোমে বেঁচে ছিলেন। শুধু মুখ দিয়ে শব্দ করতে পারতেন। আমেরিকায় ছিলেন। আমাদের ভীষণ পারিবারিক বন্ধু ওরা, এক ছেলে, এক মেয়ে—সবাই আমেরিকায় থাকেন। ১৮ বছর ওদের বাবাকে নার্সিং হোমে নিয়ে ওরা বেঁচে ছিলেন। আমরা দূর থেকে বলতাম, কেন বেঁচে আছেন আঙ্কেল? কেন আল্লাহ বাঁচিয়ে রাখছেন তাঁকে? কিন্তু এই মুহূর্তে ভাবছি, যাদের বাবা, তাদের কাছে তো আঙ্কেল পৃথিবীর সেরা সম্পদ তাই না? ওরা ভাবত প্রতিমুহূর্ত, আমাদের বাবা বেঁচে আছেন আমাদের সঙ্গে। এইভাবেই হয়তো ওদের কাছে ওই ১৮ বছর এখন মাত্র ১৮ মিনিট মনে হয়, তাই না?
বাবাকে গত রাতে (৬ জুন) হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। এই করোনাকালে বাবা হাসপাতাল পেয়েছেন, মাত্র ১ দিনের মাথায় থাকার জন্য কেবিন পেয়েছেন। প্রতি ঘণ্টায় ডাক্তার নিবিড় দেখাশোনা করছেন, মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে মামা দেখাশোনা করছেন। মিলন মামা, ছোটবেলা যে মামার সঙ্গে সঙ্গে বড় হয়েছি আমরা চার বোন। মামা সেই বিরল সৌভাগ্য আর ঝুঁকি নিয়ে বাবার দেখাশোনা করছেন। একটা কথা না বললে নয়, এই মামা ছিলেন আমাদের ছায়া। আমরা রংপুর থেকে ঢাকায় এলাম মামা আমাদের সঙ্গে এলেন। বাবার সরকারি চাকরি, তাই যেখানেই বাসা বদল হতো মামা আমাদের সঙ্গে আছেন অবধারিত। একবার ১৯৮০–৮১ সাল হবে, আমরা কলাবাগানে থাকি, আম্মা মিলন মামাকে বাসা থেকে বের করে দিল, সেকি রাগ আম্মার। তুই আমার বাসায় আর ঢুকবি না মিলন। মামা গিয়ে সিঁড়ি গোড়ায় বসে থাকেন, আমি গিয়ে কলা আর পানি পৌঁছে দিই। মিলন মামা অপেক্ষা করে আছেন আব্বা অফিস থেকে ফিরবে এই সিঁড়ি দিয়ে, তাই হয় শেষ পর্যন্ত আব্বা ফিরলে মিলন মামা কেঁদে পড়ে আব্বার কাছে, ‘দুলাভাই, বুবু বাসায় ঢুকতে দিচ্ছে না।’ আব্বা বলেন, ‘আয় আমার সঙ্গে আয়, ব্যস মীমাংসা হয়ে গেল। মাত্র ৩ মাস আগে এই মামা এখন বাসা নিয়েছে আমাদের পাশের গলিতে। আব্বার এই চরম সময়ে অন্তিম সময়ে মিলন মামা এখন একমাত্র মানুষ। এই মামা এসেছেন এখন আমাদের জীবনে দেবদূতের মতো। কিন্তু মামার নিজেরপরিবার আছে, নিজের জীবন আছে, যেকোনো মুহূর্তে কোভিডে আক্রান্ত হতে পারেন মামা? কেন ঝুঁকি নিচ্ছেন মামা? কেন মামা সেবা করছেন বাবাকে, বাবার মতো বড় দুলাভাইকে কেন আগলে রাখছেন এই মামা? জীবনের কি কোন গোছানো উত্তর আছে কোথাও?

দেশে প্রতিটা মানুষের মনে ভয়ের আতঙ্ক ছড়িয়ে আছে ভীষণভাবে। সেটাই সবচেয়ে স্বাভাবিক, আমার মা দেশে একা, মায়ের বয়স হয়েছে। যেকোন সময় আক্রান্ত হতে পারে আম্মা। কী করব তখন আমরা? কী অসহায় আমরা ছোট একটা জীবাণুর কাছে। সবচেয়ে ছোট বোন যে গত ১৬ বছর আব্বা-আম্মার সব সব দায়িত্ব নিয়েছে হাসিমুখে। আমরা বাকি ৩ বোন বারবার জানতাম শাহিন আছে বলেই আমরা এতটা ভরসা করে বিদেশে আছি। সেই বোন শাহিন গত ৬ মাস টরন্টোতে আটকে গেছে কোভিডের কারণে। কত ইতিহাস রচনা করল কোভিড-১৯? যার যার গেছে একমাত্র তারাই বুঝি বলতে পারবে আজকে এইটুকু তো ভীষণ সত্য। একমাত্র কোভিড আটকে দিল আমাদের সবাইকে। মাঝরাতে ছোট বোন শাহিন জানায়, কারও মুখে কথা নেই, শাহিন বলে, মেজপা টরন্টো থেকে কবে নেক্সট ফ্লাইট বাংলাদেশে যাবে কেউ জানে না। এখন বাংলাদেশে যেতে গেলে অটোয়া বাংলাদেশ হাইকমিশন থেকে আলাদা করে লন্ডনের ভিসা নিতে হবে কারণ প্লেন লন্ডন হয়ে যাবে এদিকে ভোররাতে আব্বাকে খাবারে জন্য টিঊব পরানো হয়েছে। সবাই বলছেন, তোমার বাবা যে এই করোনাকালে হসপিটাল পাচ্ছেন, সেবা পাচ্ছেন, ডাক্তার পাচ্ছেন, মানুষ হাতের কাছে পাচ্ছেন এই জন্য এখনই নামাজ পড়তে বসা উচিত তোমাদের। নিশ্চয় তাই, আজকে বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষের জীবন অনিরাপদ। কেউ বলতে পারবে না সে করোনার শিকার কি না, কেউ বলতে পারবে না আগামীকাল সে কোভিড আক্রান্ত হবে কি না—এমন অবস্থায় বাবাকে যে বিনা চিকিৎসায় চলে যেতে হচ্ছে না, এই তো হাজার হাজার শোকর।
কিন্তু কি জানেন, এই যে লিখছি, এই যে টাইপ করছি, এই যে ব্যথা বহনের ভার লাঘব করছি নিজেকে প্রকাশ করে এইটাই এখন পথ। সরদার ফজলুল করিম স্যার বলতেন, ‘বাবা–মায়েরা একটা জীবন দেয় সন্তানদের, আর কী দেবেন তাঁরা?’
মাঝরাতে খালাতো বোন ডাক্তার প্রীতি ফোন করেছিল বাংলাদেশ থেকে। বলে আপু, এই যে জীবনের এত আয়োজন, কী হবে আপু, এত অল্প সময় বাঁচি আমরা, এত অল্প সময় কেন বাঁচি? এর জন্য কি এত আয়োজন আপু? যেকোনো মানুষ যদি ৫০০ বছর বাঁচতে পারত তাহলে এই জীবনের ব্যাপক আয়োজন সফল হতো—জানেন আপু, গত ৩ মাস নিজের মেয়েকে দেখি না, বাবা-মাকে দেখি না, হোটেলে থাকতে হচ্ছে। কিন্তু এই কোভিডের কারাবাস কবে শেষ হবে কেউ জানি না আমরা।
প্রীতির কথা মাঝরাতে আবার টনক নাড়িয়ে দেয়। এই এক জীবাণু অসহায় করে দিল গোটা দুনিয়া। বিশ্বাস করেন পাঠক, এত দিন বুঝতে পারিনি, বাবা-মা ভালো ছিলেন, আমরা চার বোন বিদেশে আছি, নিরাপদে আছি এখনো। কিন্তু মাত্র দুই দিনে যেন সব ওলট-পালট হয়ে গেল। পথে না বের হলে তো পথ চেনা যায় না তাই না? আব্বা হসপিটালে, আব্বাকে মাঝরাতে খাবারের জন্য নল লাগানো হয়েছে। সবকিছু ডাক্তারদের সাজেশনেই চলছে। কিন্তু এই যে যেতে পারছি না, বাবার কাছে গিয়ে বসতে পারছি না, বিদায়ের আগে বাবার মাথায় হাত দিতে পারছি না, মায়ের কাছে গিয়ে বসতে পারছি না চার বোন এই ভোগান্তির একমাত্র কারণ করোনা। অন্তত আমার চোখে তো আর কোনো বাধা নেই দেশে যাওয়ার, তাহলে কোনো অদৃশ্য শিকলে বাঁধা পড়ল এই জীবন?

কেন বেঁচে আছি—একদিন হয়তো করোনার ভ্যাকসিন বের হব । হয়তো শিগগিরই বের হবে। কিন্তু আমার বাবা ৮৪ বছরের বাবার কি আয়ু আরও ১৮ বছর বা আঠারো মাস, বা আর মাত্র ৬ মাস? কব জীবন থেকে এই করোনা শেষ হবে? আর কত হারানোর পরে জয় হবে মানুষের? মাথা কাজ করে না, অনুভূতি কাজ করে না, বোধ কাজ করে না, একবার বলি বাবা কম কষ্ট পাক, একবার বলি, আহহা যদি রওনা দিতে পারতাম, দেখতে পারতাম আব্বাকে। এক চামচ পানি বা একবার আব্বার মুখটা দেখতে পারতাম। এই যে আব্বা আব্বা করে ১৭ হাজার মাইল দূর থেকে ডাকছি, কার কাছে যাব এখন?

করোনার শিকল ৩

টরন্টো টাইমে এখন বিকেল চারটা। আসুন, পাঠক অন্য কথা বলি, দেখি পারি নাকি?

আমি ১২ বছর বাংলাদেশে গরিব মানুষের সঙ্গে কাজ করে বিদেশে এসেছি, বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) কাজ করেছি মূলত। বাবা সরকারি চাকরি করেছেন ৬০ বছর বয়স পর্যন্ত। আমরা পালিত হয়েছি বাংলাদেশ সরকারের ছায়ায়, সবচেয়ে সুবিধাভোগী মানুষের ভেতরে আমরা বড় হয়েছি। আমার বাবা সেই বলয়ে লালন-পালন করেছেন আমাদের। আজকে এই মুহূর্তে আমার বাবাকে দিয়ে যদি সারা দেশের অনাচার-অব্যবস্থা আর দেশের বিপন্ন স্বাস্থ্যব্যবস্থার কথা বারবার বলি, সেটা মনে হয় কিছুটা দেশের প্রতি অমানবিক হয়, নাকি হয় না?
আব্বার করোনা রিপোর্ট পজিটিভ আসার পরে অবস্থা শতভাগ উল্টে গেছে। এখন আবার সব নতুন করে আয়োজিত হচ্ছে। কারণ, যতক্ষণ শ্বাস আছে ততক্ষণ তো আশা আছে, নাকি সেটাও ছেড়ে দেব? মাথা কাজ করছে না, তাহলে লেখা গুছিয়ে আসে কী করে? কিন্তু এই মুহূর্তে নিজেকে ব্যস্ত রাখার একটাই উপায় জানা আছে, তা–ই করছি আমি। একান্ত মনের সঙ্গে কথা বলছি। আব্বা একা হসপিটালে নিথর হয়ে পড়ে আছেন, এই মুহূর্তে তিনি নিশ্বাস নিতে পারছেন কি না, আমি জানি না। আরও কী অসহায় দিন অপেক্ষা করে আছে আমাদের পরিবারের জন্য, আমাদের চার বোনের জন্য বা একান্ত আমার জন্য জানি না। এই একটা জীবনে বাবাকে নিয়ে এমন লেখা কোনো দিন লিখব, কোনো দিন এমন অনুভূতি হবে, কোনো দিন এমন অসহায় লাগবে—চার–পাঁচ ঘণ্টা আগেও ভাবিনি। কোভিডের এই পুরো সময়টা জুড়ে যত অমানবিক খবর পড়েছি, জেনেছি বা চিন্তা করেছি, আমার এই মুহূর্তের মনের অবস্থা সব খবর ছাড়িয়ে গেছে। দেশে হেন কোনো সেক্টর নেই, যেখানে যোগাযোগ করা হয়নি, হেন কোনো মানুষ নেই যাদেরকে অনুরোধ করা হচ্ছে না। হয়তো একটা ব্যবস্থা হবে, হয়তো কিছু হবে না কিংবা হয়তো এমন কিছু হবে, যা কোনো দিন চিন্তা করিনি, যা কোনো দিন স্বপ্নেও আনিনি।
একটা দেশে যখন সবাই ঝুঁকির মধ্যে থাকে তখন কি শুধু একজনের কথা ভাবা উচিত? বিশ্বাস করেন পাঠক, মাত্র তিন দিনে মনে হয় নিজের সব অনুভূতি বদলে গেল। এত দিন বারবার শুনতাম করোনার রোগী নিয়ে নানান কথা, কিন্তু আজকে তো সেটা আমার বাবা? এখন পথ কোথায়? এই লেখার একজন পাঠক যদি আমাদের পরিবারকে চিনে থাকেন তাঁরা জানেন, ঢাকা শহরের ক্ষমতাবলয়ের সব জায়গায় যোগাযোগ করা হয়েছে, শেষনিশ্বাস অব্দি বাবাকে নিয়ে সব চেষ্টা করা হবে। কিন্তু ওই যে আমার ‘করোনার শিকল ২’ লেখায় বাংলাদেশের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, যিনি প্রশ্ন করেছেন, বাংলাদেশের যেসব পরিবার তাদের স্বামী-বাবা-মা-সন্তান আর ভাইবোনদের করোনার চিকিৎসার জন্য হসপিটাল তো দূরে থাক, কোনো ডাক্তারের দেখাও পায়নি।

মাত্র দুই মাস হয়নি এখনো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় কাজ করা ডাক্তার জিয়া হায়দারের মা চলে গেছেন করোনাকালে। অনেক দিন অব্দি আমি ফেসবুকে দেখেছি, জিয়া ভাই দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিয়ে হাজারো আপডেট দিচ্ছেন, হাজার রকমের প্রশ্ন তুলছেন। মনে মনে বেশ বিরক্ত হয়েছিলাম, ভেবেছি নিজের মা মারা গেছেন বলে কি জিয়া ভাই দেশ উল্টে ফেলবেন নাকি? আজকে এই মুহূর্তে, আমার বাবা পড়ে আছেন হসপিটালে নিথর হয়ে। আমি তাঁর সন্তান, বাবাকে সেবা করার জন্য একটা পরিচিত মানুষ যাবে না, যেতে পারবে না। এ মুহূর্তে আমাদের কাছে সব অনিশ্চিত, জিয়া ভাই কি এমন অনুভূতি থেকেই ফেটে পড়েছিলেন?

নিজেকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্যই মূলত এই লেখা লিখছি। ভাবার চেষ্টা করছি একদিন যে বাবা গর্ব করে মানুষকে বলতেন, তাঁর মেয়েরা দেশের বাইরে আছে, নিরাপদে আছে, ১৬ বছর ধরে নিজেদের প্রস্তুত রেখেছি এমন দিন আসবে যেদিন আমাদের দেশে যাবার পথ থাকবে না, আজকে কি সত্যিই সেই মুহূর্ত? এই করোনা কি আমার মতো হাজারো মানুষের অনুভূতি এক করে দেয়নি?

জিয়া ভাই কি নিজেকে মানাতে পেরেছিলেন যে তাঁর পরিবারে পাঁচজন বিখ্যাত ডাক্তার, কিন্তু তাঁর মা পর্যাপ্ত চিকিৎসা না নিয়ে মারা যাবেন? যে মা পাঁচজন সন্তানকে ডাক্তার বানাতে পারেন, সেই মা কি এই পরিণতির জন্য নিজেকে প্রস্তুত রাখেন?
একদম গ্রাম থেকে উঠে আসা বাবা সরকারি চাকরি শেষ করেছেন সরকারের একজন যুগ্ম সচিব হয়ে। আজন্ম দেখেছি বাবাকে বাংলাদেশ ‘স্যার’ ডাকছেন একজন শিক্ষক হিসেবে, একজন সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে, একজন স্বশিক্ষিত মানুষ হয়ে। শূন্য থেকে যিনি নিজেকে গড়ে তুলেছেন, তাঁর মেয়ে হয়ে কোনো দিন জানতে পারিনি বিপদ কী করে আসে?

আমাদের সেই বাবা, যিনি চার কন্যাসন্তানকে জন্ম দিয়ে হয়তো অনেক রক্তচক্ষু দেখেছেন। তারপর একদিন যখন সেই বাবা-মা এই চার মেয়ের জন্য সবার কাছে সম্মানের হয়েছেন, সেই বাবার শেষ যাত্রা কি এমন হবার কথা ছিল? আমরা কি ভেবেছি, এমন দিন আসবে আমাদের সামনে? কোনো বোধ কাজ করছে না, মাথা শূন্য লাগছে, হালকা লাগছে।

এই লেখার সময় কাল মোট চার ঘণ্টার মতো হবে। মাত্র দেড় ঘণ্টা আগে জেনেছি আব্বা কথা বলেছেন, ভালো আছেন একটু। বাংলাদেশ সময়ে সকাল অব্দি অপেক্ষার পালা শুরু হলো। আমি ঘরের দরজা বন্ধ করে গ্রামের বাড়িতে কাকাদের কাছে শেষ অনুরোধ করেছি। আমার বাবার শরীরটা যেন বাবার নিজ গ্রাম পর্যন্ত পৌঁছে যায়। আব্বাকে নিয়ে আর কোনো ধরনের আয়োজন না হলেও চলবে। অনেক পেয়েছেন বাবা। আজন্ম বাবা ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে জীবন যাপন করেছেন। আব্বাকে কোনো দাবি ছাড়া বাংলাদেশের মাটি বুকে টেনে নিক—এই শেষ দোয়া, এই শেষ চাওয়া।
* উন্নয়নকর্মী। ৮ জুন ২০২০

 

সি/এসএস


সর্বশেষ সংবাদ

দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে cbna24.com

সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

সংবাদটি শেয়ার করুন