ফিচার্ড মত-মতান্তর

ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সবকিছু মানিয়ে চলার অভ্যাসটা গড়ে দেই…

চলুন, ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সবকিছু মানিয়ে চলার অভ্যাসটা গড়ে দেই… ।।  জীবন পাল
 
১. সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে হারিকেন, কুপিবাতির আলোয় প্রতিটি ঘরকে আলোকিত করতে আমি দেখেছি। যদিও হারিকেন, কুপিবাতি জ্বালানোর জন্য যে কেরোসিন সেটা আমাদেরকে কিনতে হতো না। বাবার চাকুরীর সুবাদে সেটা আমরা ফ্রি পেতাম।।রেশন হিসেবে।  স্টাফ কোয়ার্টারে আমার বয়সী ছেলেমেয়েরা রবিবার হলেই যে যার কেরোসিন গ্যালোন নিয়ে ছুটতাম কেরোসিন আনতে। এটা ছিল আমাদের সাপ্তাহিক একটি ডিউটি, রুটিন। তখন দেখতাম সপ্তাহ তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে গেলেও কেরোসিন তেল যেন ফুরাতো না। তাই অতিরিক্ত তেল বিক্রি করে দেওয়া হতো। রেশনে ৪০ কেজি আটা দেওয়া হতো প্রত্যেক স্টাফদের। কিন্তু প্রত্যেকেই সেই লাল আটা বিক্রি করে দিয়ে ভাল মানের সাদা (বর্তমানের নরমাল) আটা কিনে আনতো। প্যাকেট আটা বলতে ময়দা ছিল।
প্রতি শনিবার ছিল বাজার বার। হাটের দিন। মাছ ব্যবসায়ী সহিদ আলীকে দেখতাম কোয়ার্টারের স্টাফদের জন্য আলাদা করে মাছ এনে দিতেন। বড় বড় ডিমওয়ালা ইলিশ মাছ থাকতো স্টাফদের জন্য। শনিবার হাটে এসেই আগে কোয়ার্টারো প্রত্যেক স্টাফদের বাসায় মাছগুলো পৌঁছে দিতেন। রবিবার সকালে এসে টাকা সংগ্রহ করতেন। তখন ডিমওয়ালা ইলিশ মাছ ২৫-৩০ টাকায় পাওয়া যেত। এক বাসায় ইলিশ রান্না করা হলে পাশের বাসা থেকে বুঝা যেত যে ইলিশ মাছ রান্না করা হচ্ছে। তখনের ইলিশের গন্ধটাই ছিল এমন। ঝুল দিয়েই যে কেউ একথালা ভাত খেয়ে ফেলতে পারতো। যতদূর মনে পড়ে তখন চালের কেজি ছিল ১১ টাকা। আমার বড়দা ( বড় ভাই) ৯ টাকা কেজিতে পাশ্ববর্তী বাজার থেকে চাল কিনে আনতো। ১ টাকায় ৪ টা লজেন্স, ১ টাকায় ৪ টা বিস্কুট, ১ টাকায় কলা বিস্কুট, ১ টাকার ডিব্বা আচার (চামচসহ), ৫০ পয়সা দিয়ে আটানি ঝাল চকলেট, ৫০ পয়সায় আটানি বিস্কুট  এগুলো আমাদের সময়ে দোকানের আকৃষ্ট করার মতো ছোটদের প্রিয় খাবার ছিল। পুজো কিংবা উৎসবের দিন ১ টাকা দিয়ে ভিউকার্ড সম্বলিত আচার, মেচের বাক্সের মত বাক্সে ছোট ছোট গোলাকার  চকলেটের প্রতি বাড়তি আকর্ষন থাকতো।  মেলায় কাঠের তৈরি হাত দিয়ে চালানো শব্দওয়ালা গাড়ির প্রতি বাড়তি আকর্ষন থাকতো। থাকতো টিনের তৈরি পিস্তল কেনার প্রতিও বাড়তি টান। 
 
২. বাসায় আসা ফেরিওয়ালাদার কাছ থেকে মা,বোনকে তিব্বত স্নো,ঘামাচির পাওডার,চুড়ি,টিপ, কানের দূল,খোপার চিপটি,মাথার বেন্ট,আয়না,চিরনি কিনতে দেখেছি। যেখানে বাকিতে লেনদেন ছিল। সপ্তাহ শেষে বকেয়া পরিশোধ করে আবার কেনাকাটা হতো। মাথায় ফেরি করে বাসায় আসা শাড়ি বিক্রেতার কাছ থেকে শাড়ি কিনতেও দেখেছি। শুধুমাত্র  ঈদ কিংবা পুজোর উৎসবে সবাই মিলে মার্কেটে ঘুরে ঘুরে কাপড় কিনতে ভীড় করতে দেখেছি। উৎসবের কাপড় উৎসবের দিনের আগে না দেখানোর একটা চল ছিল। অসাম্প্রদায়িক চিন্তা থেকে কোয়ার্টারের সবাই মিলে ঈদ,পুজোর আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে দেখেছি। পুজোর সময় সন্ধ্যে বেলায় সবাই মিলে আরতি দেখতে যাবার যেমন আগ্রহ এবং প্রস্তুতি ছিল। তেমনি চাঁদরাতে সবাই মিলে চাঁদ দেখে আতশবাজি ফোটানো,ঈদের দিন বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে ঈদের নিমন্ত্রণ রক্ষা করা, সবাই মিলে ঘুরতে গিয়ে ৩২ রিলের ক্যামেরায় ছবি উঠে স্মৃতি ধারণ করা এবং সাদাকালো সেই টেলিভিশনের সামনে বসে একত্রে ঈদের অনুষ্ঠান উপভোগ করার মধ্যেও বাড়তি আনন্দ ও মানসিক প্রস্তুতি ছিল। 
সন্ধ্যায় বিদ্যুৎ চলে গেলে আমাদের মধ্যে বাড়তি একটা আনন্দ কাজ করতো। বইপত্র রেখে পড়ার টেবিল থেকে উঠে উঠোনে বের হয়ে চাঁদ/জ্যোৎস্নার আলোয় আশেপাশের আমাদের বয়সী ছেলেমেয়েরা খেলায় মজে যেতাম। আর মায়েদের দেখতাম বেঞ্চ, টুল,মোড়া বারান্দায় বের করে তাদের বয়সী আশেপাশের সবাইকে নিয়ে গল্পে মজে যেতে। বিদ্যুৎ খুব একটা তাড়াতাড়ি আসতো না, সেজন্য আমাদেরকেও খেলাধুলা করতে খুব একটা বারন করা হত না। অতঃপর রাতের খাবারের সময় হয়ে গেলে হারিকেন/কুপিবাতির আলোয় খাওয়া দাওয়ার পর্ব শেষ করে ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে যেতাম।
 
৩. গুরুজন ও বড়দের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা ছিল অনেক বেশি। রাস্তায় দেখলে মাথা নিচু করে পাশ কাটিয়ে চলে আসার একটা রীতি ছিল। ছিল মনের মধ্যে একটা ভয়। ‘রাস্তায় দেখে ফেলেছেন, কি যে মনে করবেন। বাসায় বলে দিবেন নাতো?’ এরকম একটা ভয় মনে কাজ করতো। বড়দের সামনে চা খাওয়াটা একরকম বেয়াদবি হিসেবে বিবেচনা করতাম। এখনের মত অলিতে গলিতে টং দোকানে চায়ের আড্ডা হতনা। কথায় কথায়  রেষ্টুরেন্টে রেষ্টুরেন্টে বন্ধু বান্ধব নিয়ে অমুক পার্টি,তমুক পার্টি দেওয়ার ট্রেন্ড ছিলনা। ডেনিশ,পেটিস,পপ,হাওয়ায় মিঠাই, ঘিচমচম,কটকটি এগুলোর মধ্যেই আমাদের সন্তুষ্টি ছিল। আড্ডা জমতো খেলার মাঠে,মনখুলে গল্প হতো স্কুলের আঙ্গিনায় আর দুষ্টুমি হতো ক্লাসরুমে। পাড়ার সব বয়সী ছেলেমেয়েরা একসাথে খেলাধুলা করেছি। কানামাছি,ডাঙগুলি, সাতচারা,বৌছি,কুুতকুত,ছুঁয়াছুঁয়ি, চুরপুলিশ,বন্দি,গোল্লাছুট, কাবাডি, মাংসচুর, মারবেল, নারিকেলের থালি দিয়ে ভাততরকারী,বালু দিয়ে চাল,আটা হিসেবে কলাপাতার ছাউনি নিয়ে দোকানদারি, কাঠাল পাতা দিয়ে কেনাকাটা এগুলো ছিল আমাদের ছোটবেলার অবসর সময় কাটানোর খেলাধুলা। আমাদের ছোটবেলায় ছেলেমেয়েরা একসাথে মিলেমিশে  খেলাধুলা করলেও কখনও কারো প্রতি খারাপ দৃষ্টি বা চিন্তা আসেনি। কেন জানিনা, সেই সময় এখনের মত খারাপ চিন্তাগুলো কারো মাথায় আসেনি। আসতো না। পাড়ার সবাই যেন সকলের অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করতেন। সেটা নিয়ে কোন পরিবারের দ্বিমত দেখা যেতোনা। শিক্ষক ছিলেন পিতামাতার থেকেও অনেক উপরের আসনে। সন্তানের নামে শিক্ষক বাসায় নালিশ করলে অভিভাবকরা শিক্ষকের সামনে মাথা নত করে থাকতেন। অপরাধীর মত নত অবস্থায় শিক্ষকের কাছেই সন্তানের শাসনের ভার দিয়ে দিতেন। 
 
৪. সন্ধ্যার পর যখন থেকে দেখলাম আমাদের বাড়িসহ আশেপাশের বাড়িগুলো বিদ্যুৎতের আলোয় আলোকিত হচ্ছে, সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে আর বাড়িগুলোতে হারিকেন, কুপিবাতির আলো জ্বলে উঠছে না। তখন মনটা কেমন জানি মনমরা হয়ে গিয়েছিল। মনে হয়েছে কৃত্রিমতার যুগে হয়তো পা বাড়াচ্ছি। 
দিনে দিনে দেখলাম কৃত্রিমতার ছোঁয়ায় আজ আমরা রঙ্গিন হওয়ার সাথে সাথে সবকিছুকেও যেন রাঙ্গিয়ে তুলেছি। যার কারণে নিজের অস্তিত্বটাকে ভুলে গেছি আধুনিকতার ছোঁয়ায়। এখানে ‘ভুলতে বসেছি’ শব্দটা আমি বলতে নারাজ। কেননা, এই শব্দটা ৯০ দশকের পর বিংশ শতাব্দী শুরুর সাথে সাথে বললে মানানসই হতো। এখন সেটা বেমানান লাগবে। এখনের সবকিছুই কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গেছে। সত্যের চাইতে মিথ্যের মূল্যায়ন কিংবা গুরুত্বটা বেশি হয়ে গেছে। প্রকৃত ভালবাসাকে অবহেলা করে মিথ্যে অভিনয়টাকেই বেশি মূল্য দিতে দেখা যাচ্ছে। সবকিছুতে কেমন জানি একটা লোকদেখানো ট্রেন্ড চলে এসেছে। প্রাইভেসি কিংবা ব্যক্তিগত বলতে কিছু থাকছেনা। অন্যায় বা অপরাধকে কেউ ভয় করতে দেখা যাচ্ছেনা। এর বিপরীতে দেখা যাচ্ছে অন্যায়কারী বা অপরাধীকেই সকলে খুব সহজে আপন করে আঁকড়ে ধরে রাখতে পারছে। নিজেকে না শোধরে অন্যের উপর দোষ চাপিয়ে দেওয়ার প্রথাটা এখন চলমান। মিতব্যয়ীতার চাইতে অপব্যয়ের দিকেই আকৃষ্ট হচ্ছে সবাই। লকডাউনের মত এতবড় ক্রান্তিকালেও আমাদের সঠিক শিক্ষা দিয়ে যেতে পারেনি। আদো আমাদের উচিত শিক্ষা হবে কিনা জানিনা। তবে বর্তমান তেল সংকটের কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদনে যে বিরাট সমস্যার সম্মুখীন হয়েছি সেটাকে নিজের মতো এককেন্দ্রিক  চিন্তা দিয়ে চিন্তা না করে, পুরোদেশ,জাতির হয়ে চিন্তা করে  আসুন ক্রান্তিকালের এই সংকট কাটিয়ে উঠতে সম্মিলিত ভাবে সাশ্রয়ী হওয়ার মনমানসিকতা তৈরি করি। এটা শুধু বিদ্যুতের সাশ্রয়ীর কথা বলছি না। দৈনন্দিন জীবনে চলার পথে সবকিছুতে চলুন সাশ্রয়ী হওয়ার মনমানসিকতা তৈরি করি। এতেই হয়তো আমরা ভবিষ্যতের অন্যান্য ক্রান্তিকাল থেকে কাটিয়ে উঠতে পারবো। নিজেদেরকে সবকিছুতে আধুনিক, যান্ত্রিক কিংবা প্রযুক্তির চিন্তা ভাবনা থেকে বের করে চলুন না ফেলে আসা অতীত অভিজ্ঞতার দিকে কিছুটা ফিরে তাকায়। চলুন, নিজেকে ও নিজেদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মটাকে সবকিছুতে মানিয়ে চলার অভ্যাসটা গড়ে দেই।
 
লেখকঃ জীবন পাল, সাংবাদিক 
সংবাদটি শেয়ার করুন