ফিচার্ড বিনোদন

`নো ল্যাণ্ডস ম্যান’ ও ‘ ‘শনিবারের বিকেল’

`নো ল্যাণ্ডস ম্যান ‘ ‘শনিবারের বিকেল‘ || সুব্রত নন্দী

চলচ্চিত্র নির্মাতা মোস্তফা সারওয়ার ফারুকীকে নিয়ে অন্য কোন বিতর্কে না গিয়ে আমি তার দুটি চলচ্চিত্রের উপর আলোকপাত করতে চাই। দক্ষিণ এশিয় চলচ্চিত্র উৎসবে আমরা ফারুকীর ‘নো ল্যাণ্ডস ম্যান’ ও ‘ ‘শনিবারের বিকেল’ এই দুটি চলচ্চিত্রকে সংযুক্ত করেছিলাম। সেই সূত্রে তার দুটি ছবিই আমি খুব আগ্রহ নিয়ে দেখেছি। আরও একটি কারন ছিল যে হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার পটভূমিতে ফারুকীর এই ‘শনিবারের বিকেল’ ছবিটি গত তিন বছর হল চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডের সেন্সর অনুমোদন পায়নি। এমন কি ছিল শনিবারের বিকেলে যে সরকার ছবিটি তিন বছর হল আটকে রেখেছে? নিষিদ্ধ যে কোন কিছুর উপর দর্শকদের কৌতুহল থাকে বেশি আর সে কারনেই হয়ত উপচে পড়া দর্শকদের ঢল নেমেছিল উৎসবের গত শনিবারের বিকেলে। আয়োজক হিসেবে দায়িত্ব কর্ম ফেলে দিয়ে টান টান উত্তেজনার ছবিটি দেখার ভাগ্য হল শুধুমাত্র আমার প্রবাসে থাকবার কারনে।

যদিও ফারুকী চলচ্চিত্রটিকে একটি ফিকশন ছবি হিসেবে দাবী করে বলছেন এটা কাল্পনিক, পরাবাস্তব যা পারেন ধরে নিন, তিনশো দর্শকদের তিনশোভাবে ছবিটি ব্যাখ্যা করুন কিন্তু আমি বলছি হলি আর্টিজান বা কোন ঘটনার সঙ্গেই ছবিটিকে মেলাতে চেষ্টা করবেন না, ছবিটিতে যে বক্তব্য আমি তুলে ধরেছি সেটাই প্রধান বিবেচ্য হওয়া উচিত। ছবিটি মুক্তি না দেয়ার কোন কারন দেখি না, ধর্মীয় উগ্রবাদের বিরুদ্ধে জন সচেতনতা সৃষ্টিতে যদি ছবিটি কিঞ্চিত পরিমান অবদান রাখে তবে অতি ক্ষুদ্র একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে নিজেকে আমি ভাগ্যবান মনে করব।

আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি একটি বিশেষ ধর্মের বিধিবিধানের যদি গভীরে আপনি যান তবে সেগুলো পূর্ণ ঈমানের সঙ্গে পালন করলে আপনাকে নিষ্ঠুর না হয়ে উপায় নেই। অথচ বিগত ১৪ শত বছরে পৃথিবীর একটা বিশাল অংশ বুঝে না বুঝে, চাপে জবরদস্তিতে এই ধর্মের উপর তাদের আনুগত্য রেখেছেন তাদের এই সংখ্যাটাকেও আপনার অস্বীকার বা তাচ্ছিল্য করার উপায় নেই। আর যতদিন পর্যন্ত ওল্ড টেস্টামেন থেকে নিউ টেস্টামিন প্রটোস্ট্যান্টদের মত অ্যামেন্ডমেন্ট বা সংস্কার এই ধর্মটিতে না আসে ততদিন পর্যন্ত গুড মুসলিম ও ব্যাড মুসলিমের তত্ব বা মলমের প্রলেপ দিয়েই আমাদের চলতে হবে। মোস্তফা সারওয়ার ফারুকী যদি এই ছবিতে সেটা করেন তাতে দোষ কি? তবুও যদি মানুষের মধ্যে এতটুকু বোধ জাগ্রত হয় নিরপরাধ মানুষ কখনোই ধর্মের বলি হতে পারে না। কোনভাবেই যুক্তরাষ্ট্রের বোমাবাজির দোহাই দিয়ে ওয়েস্টার্ণ মিলিট্যান্সীর সঙ্গে ধর্মীয় মিলিট্যান্সীকে এক করে দেখার সুযোগ নেই। তাতে বরং ধর্মের পলিটিক্যাল মিলিট্যান্সিটাই নগ্ন হয়ে ধরা পড়ে যায়।

শনিবারের বিকেলে ফারুকী একদিকে জঙ্গিবাদের বিভৎস চেহারাটা সংলাপ হত্যার পর হত্যার মাধ্যমে অ্যাকশনে অতিরঞ্জিত না করে বাস্তবতার নিরিখে সুচারুভাবে পরিস্ফুটিত করে তুলেছিলেন তেমনি একজন প্রকৃত ধার্মিক কখনো অন্যায় অত্যাচার নিরীহ মানুষ হত্যাকাণ্ডের সমর্থন করতে পারেন না এই ‘গুড মুসলিম তত্ত্ব’ উপস্থাপন করার গতানুগতিক ধারার প্রয়াস পেয়েছেন । একজন হিজাবি বা নামাজি মানুষও এইসব জঙ্গিবাদের হাতে যেমন নিরাপদ নন তেমনি একজন ধার্মিক তার নিজের জীবনের বিনিময়ে বেশ কিছু নিরাপরাধ মানুষকে হোটেল থেকে বাইরে বেরিয়ে যাবার সুযোগ করে দিয়েছেন এই ঘটনাগুলোর সন্নিবেশ ছবিটিতে গতি সঞ্চার করেছে। এই ছবিটির সংলাপের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল অস্ত্রধারি এক জঙ্গির উদ্দেশ্যে মামুনুর রশীদের একটি সংলাপ ‘ তোমাকে আমি চিনেছি,তুমি আমার ছেলে জোয়েবের বাল্য বন্ধু নও, তুমি কি নাদের সাহেবের ছেলে নও। তোমাদের নতুন জেনারেশন, কি হয়েছে তোমাদের? আজ তোমরা এটা কি করলা , এতগুলা নিরীহ নিরাপরাধ মানুষকে তোমরা হত্যা করলা?….এই বাংলাদেশে?

পিনপতন নিঃশব্দ নিরাবতায় দর্শক ছবিটি দেখেছে। আমার কাছে মনে হয়েছে মোস্তফা সারওয়ার ফারুকীর জীবনের শ্রেষ্ঠ পরিচালনা এই চলচ্চিত্রটি। এর আগে নো ল্যাণ্ডস ম্যান ‘ ছবিটিতে পাকিস্তানে আহমদীয়া সম্প্রদায়ের মুসলমানদের উপর সুন্নিদের আক্রমণ হত্যা ও তাদের দেশ ত্যাগে বাধ্য করা নিয়ে নিজ দেশে ভিটামাটিহীন এক যুবকের যুক্তরাষ্ট্রে গমন ও সেখানে তার করূন মৃত্যুবরণের ( হত্যা) ঘটনা দিয়ে তৈরি চলচ্চিত্রটি ফারুকী সম্পর্কে আপনাকে তার উদ্দেশ্য ও চ্যালেঞ্জ নিয়ে নতুন করে ভাবনার একটা সুযোগ সৃষ্টি করে দেবে। আমি মনে করি ‘শনিবারের বিকেল’ ছবিটি যদি বাংলাদেশ সরকারের সেন্সর বোর্ড ছাড়পত্র দেয় তবে ছবিটি দেখে এন্টি টেররিজম’ জনসচেতনতা বাড়াতে অনেক অবদান রাখতে সমর্থ হবে।

পুনশ্চ: শনিবারের বিকেল চলচ্চিত্রটি শেষ হবার পর অসংখ্য দর্শকদের কৌতুহলী প্রশ্নের উত্তর দেবার প্রাক্কালে হঠাৎই এক দর্শক প্রশ্ন করে ফারুকীর এই ছবিটি ‘ইসলামোফোবিক” বলে ট্যাগ লাগানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু ফারুকীর আগেই দর্শকরা ‘নো নো’ বলে চিৎকার করে ফারুকীর প্রতি সমর্থন জানান। আমি জানিনা বাংলাদেশে এই ছবিটি প্রদর্শিত হলে জঙ্গি উগ্রবাদের শিকার তিনি হতে পারেন। সেই চ্যালেঞ্জ নিয়েই তিনি ছবিটি বানিয়েছেন । সরকারের উচিত তাকে এই সুযোগটি দেয়ার। তো শনিবারের বিকেল ছবিটির আশু মুক্তি কামনা করছি।

সাংবাদিক ও কৃষিবিদ্ সুব্রত নন্দী-এর ফেসবুক থেকে নেওয়া


সংবাদটি শেয়ার করুন