মহান বিজয় দিবস ও কিছু কথা |||| বিদ্যুৎ ভৌমিক
১৬ ডিসেম্বর হল গৌরবউজ্জল মহান বিজয় দিবস। গভীর শোক, বিনম্র শ্রদ্ধা ও পরম ভালবাসার সাথে সমগ্র জাতি স্মরণ ও উদযাপন করছে ৪৯তম গৌরবউজ্জল মহান বিজয় দিবস। প্রবাসেও উদযাপিত হচ্ছে ৪তম গৌরবউজ্জল মহান বিজয় দিবস । ব্রিটিশ শাসনাধীন দুইশ বছরের দাসত্ব এবং পাকিস্তানী কুশাসনের ২৪ বছরের শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে নিজেকে মুক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস নেয়ার দিন হল গৌরবউজজল বিজয় দিবস। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ৭ই মার্চ বাংগালী জাতির প্রতি ভাষণের মাধ্যমে স্বাধীনতার যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হওয়ার আহবান জানিয়েছিলেন ।
৪৯ বছর আগে এই দিনেই অর্থাৎ ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হয়েছিল নয় মাসের যুদ্ধ শেষে মহান বিজয় ও মুক্তির গান। ভারতের সাহায্য ও সহযোগীতায় দীর্ঘ নয় মাসের নিরন্তর মুক্তির লড়াইয়ের পর বিজয়ী হয় বাঙালী জাতি। অবশেষে ত্রিশ লাখ মানুষের জীবন ও দুলক্ষ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে বাংগালী জাতি চূড়ান্ত বিজয়কে ছিনিয়ে এনেছিল একই বছরের ১৬ ডিসেম্বর । ছিনিয়ে আনা হয় লাল-সবুজ পতাকাসংবলিত স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। ১৬ ডিসেম্বর একদিকে গৌরবউজ্জল বিজয়ের – বাঁধভাঙ্গা আনন্দের দিন। একই সঙ্গে লাখো স্বজন হারানোর শোকে ব্যথাতুর-বিহ্বল হওয়ারও দিন। আমার প্রাণপ্রিয় পিতাও মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় শহীদ হয়েছিলেন । মিত্র বাহিনীর ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচন্ডআক্রমণে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোষর ও সহযোগী রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীকে পর্যুদস্ত হয়ে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণে বাধ্য হয় ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিকেলে মিত্র বাহিনীর কাছে । বিশ্ব মানচিত্রে আলোর ঝর্ণাধারায় প্রজ্বলিত হয়ে উঠেছিল এক নতুন দেশ যার নাম হল স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ। রক্ত লাল পতাকায় সিঞ্জিত হয় বাঙালীর চেতনা । অহঙ্কার, আত্মমর্যাদা ও বিজয়ের গৌরবে আমাদের গৌরবান্বিত হওয়ার দিন হল মহান বিজয় দিবস ১৬ ডিসেম্বর ।
৪৯ তম বিজয় দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশের মাননীয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির উদ্দেশ্যে একটি চমৎকার, মনমাতানো ও গতিশীল ভাষণ দেন । মাননীয়া প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে ধর্ম নিয়ে বিভ্রান্ত সৃষ্টিকারীদের উদ্দেশ্যে কঠোর হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করে বলেছেন, “১৯৭১’র পরাজিত শক্তির একটি অংশ মিথ্যা, বানোয়াট, মনগড়া বক্তব্য দিয়ে সাধারণ ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের বিভ্রান্ত করতে ইদানিং মাঠে নেমেছে। সমাজে অশান্তি সৃষ্টি করতে চাচ্ছে। জাতির পিতা ১৯৭২ সালে বলেছিলেন ধর্মকে রাজনীতির হাতিয়ার না করতে। কিন্তু পরাজিত শক্তির দোসররা দেশকে আবার ৫০ বছর আগের অবস্থায় ফিরে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখছে। রাজনৈতিক মদদে সরকারকে ভ্রুকুটি দেখানোর পর্যন্ত ধৃষ্টতা দেখাচ্ছে। বাংলাদেশের মানুষ ধর্মপ্রাণ, ধর্মান্ধ নয়। ধর্মকে রাজনীতির হাতিয়ার করবেন না। প্রত্যেককে নিজ নিজ ধর্ম পালনের অধিকার রাখেন। বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান – সকল ধর্মের-বর্ণের মানুষের রক্তের বিনিময়ে এ দেশ স্বাধীন হয়েছে। এ বাংলাদেশ লালন শাহ, রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুল, জীবনানন্দের বাংলাদেশ। এ বাংলাদেশ শাহজালাল, শাহ পরান, শাহ মকদুম, খানজাহান আলীর বাংলাদেশ। এই বাংলাদেশ শেখ মুজিবের বাংলাদেশ; সাড়ে ষোল কোটি বাঙালির বাংলাদেশ। এ দেশ সকলের। এ দেশে ধর্মের নামে আমরা কোন ধরনের বিভেদ-বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে আমরা দিব না। ধর্মীয় মূল্যবোধ সমুন্নত রেখে এ দেশের মানুষ প্রগতি, অগ্রগতি এবং উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাবেন।“
মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে অর্জিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর এই ভাস্কর্য নির্মাণ এক ও অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ । দেশব্যাপি উগ্র ধর্মান্ধ রাজনৈতিক শক্তি ও রাজনৈতিক মোল্লাদের বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য অপসারণ করার হুমকি, নারী বিদ্বেষী প্রচারনা, বিভিন্ন স্হানে মন্দির ভাংচুর সহ ধর্মীয় সংখালঘুদের উপর নির্যাতন , মুক্তিযুদ্ধ-সংবিধান-জাতীয় ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি-সভ্যতা বিরোধী কর্মকান্ড সরকারকে কঠোর হস্তে দমন করার জন্য মাননীয়া প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন জানাচ্ছি । যারা জাতির পিতাকে অবমাননা ও অমান্য করে তারা স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্বের বিরোধী। এই সব অগণতান্ত্রিক, অসাংবিধানিক কার্যকালাপ ও উগ্র মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সব ধর্মের মানুষ ঐক্যবদ্ধভাবে উগ্র মৌলবাদী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতেই হবে।
৪৯তম মহান বিজয় দিবসের শপথ হউক, যে অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠনের স্বপ্ন নিয়ে এ দেশের সাধারণ মানুষ অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিল, জীবনপণ শপথ নিয়েছিল, ছিনিয়ে এনেছিল আমাদের মহান স্বাধীনতা ও মহান বিজয় দিবস তা বাস্তবায়ন করার দায়িত্ব সরকার, রাজনীতিবিদ, সুশীল সমাজ সহ আমাদের সকলের । মহান বিজয় দিবসের ৪৯তম বার্ষিকীতে আমাদের আরও শপথ হউক মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি প্রতিরোধ করা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুন্নত রাখা, সর্বোপরি দেশের ভিতরে ও বাহিরে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মকে ২৫ মার্চের নারকীয় হত্যাযজ্ঞ, মহান মুক্তিযুদ্ধ,মহান স্বাধীনতা দিবস ও মহান বিজয় দিবস সম্পর্কে জানানোর দায়বদ্ধতা সরকার, রাজনীতিবিদ, সুশীল সমাজ সহ আমাদের সকলের । দেশমাৃকার উন্নতি বৃহত্তর স্বার্থে ও একই সাথে গনতন্ত্র ও মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনা সমুন্নত রাখার বৃহত্তর স্বার্থেই স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সব শক্তি এবং রাজনৈতিক দলকে ঐক্যবদ্ধভাবে যুদ্ধাপরাধী, মৌলবাদ, জঙ্গীবাদ ও তাদের দোসরদের আস্ফালন রুখে দাড়িয়ে দেশে প্রকৃত গনতন্ত্র, মানবিকতা, ন্যায় বিচার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করতে হবে ।
বিদ্যুৎ ভৌমিক, কলামিষ্ট, লেখক ও সিবিএনএ’র উপদেষ্টা] মন্ট্রিয়ল, ক্যানাডা
এস এস/সিএ
দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com
সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন