শনিবার ঊষালগ্নে সাঙ্গ হলো কমলগঞ্জের মণিপুরি মহারাসলীলা
ঢাক, ঢোল, মৃদঙ্গ, করতাল এবং শঙ্খ ধ্বনির সঙ্গে বর্ণাঢ্য আয়োজনে বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনা ও কঠোর নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে ২০ নভেম্বর শনিবার ঊষালগ্নে সাঙ্গ হলো মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে মণিপুরি সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব শ্রীকৃষ্ণের মহারাসলীলা। কার্তিকের পূর্ণিমা তিথিতে উপজেলার মাধবপুর ও আদমপুরে মণিপুরি সম্প্রদায়ের এ রাসোৎসব অনুষ্ঠিত হয়। শনিবার ঊষা লগ্নে সূর্যোদয়ের সাথে সাথে অনুষ্ঠানের পরিসমাপ্তি ঘটে। অতঃপর যার যার নিজ নিজ গন্থব্যস্থলে চলে যান। মণিপুরি সম্প্রদায়ের এ বৃহত্তম উৎসব উপলক্ষে উভয় স্থানে বসেছিল রকমারি আয়োজনে বিশাল মেলা। রাসোৎসবে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে হাজার হাজার ভক্তবৃন্দসহ দেশী-বিদেশী পর্যটকের ভিড়ে মুখরিত হয়েছিল কমলগঞ্জের মণিপুরি অঞ্চলগুলো। ভিড় সামলাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের হিমশিম খেতে দেখা যায়। এ উৎসবটি মণিপুরি সম্প্রদায়ের হলেও এখন আর তা কেবল মণিপুরিরাই নয়, স্থানীয় বাঙালসিহ জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে অন্য সব সম্প্রদায়ের লোকজনের অংশগ্রহণে উদযাপিত হয়।
দামোদর মাস খ্যাত কার্তিক পূর্ণিমা তিথিতে গৌড়িয় বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বী মণিপুরিদের প্রধান ধর্মীয় মহোৎসব শ্রীশ্রী কৃষ্ণের মহারাসলীলা অনুসরণ। কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুর জোড়া মন্ডপ প্রাঙ্গনে মণিপুরি মহারাসলীলা সেবা সংঘের উদ্যোগে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি সম্প্রদায়ের ১৭৯ তম ও আদমপুর মৈতৈ মণিপুরি সম্প্রদায়ের উদ্যোগে ৩৬ তম মহারাসলীলানুসরন উৎসব উপলক্ষে শুক্রবার (১৯ নভেম্বর) দুপুর থেকে আকর্ষণীয় রাখালনৃত্যের (গোষ্ঠলীলা) সাথে বাতাসা বৃষ্টিতে শুরু হয় মণিপুরি সম্প্রদায়ের প্রধান উৎসব মহারাসলীলার আনুষ্ঠানিকতা। নৃত্য চলাকালীন সময় ভক্তরা ম-পে বাতাসা ছিটিয়ে বাতাসা বৃষ্টি করেন। সেই বাতাসা আবার ভক্তরা কুড়িয়ে নেন। রাসোৎসব উপলক্ষে হাজারো মানুষের মিলনতীর্থে পরিণত হয় মাধবপুর জোড়া ম-প আর আদমপুরের ম-প এলাকা। গত বছর বৈশ্বিক মহামারি করোনা পরিস্থিতির কারণে ঐতিহ্যবাহী এই উৎসব সীমিত পরিসরে করা হলেও এবার স্বাস্থ্যবিধি মনে বৃহৎ পরিসরে অনুষ্ঠিত হয় এ উৎসব।
শুক্রবার সন্ধ্যা ৫টায় মাধবপুর শিববাজার উন্মুক্ত মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় আলোচনা সভা। আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান এমপি। আলোচনা সভায় মণিপুরী রাসলীলা সেবা সংঘের সভাপতি প্রকৌশলী যোগেশ্বর চ্যাটার্জীর সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক শ্যাম সিংহের পরিচালনায় বিশেষ অতিথি ছিলেন মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক মীর নাহিদ আহসান, মৌলভীবাজার পৌরসভার মেয়র ফজলুর রহমান, কমলগঞ্জ উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অধ্যাপক রফিকুর রহমান, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আশেকুল হক, সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার (শ্রীমঙ্গল সার্কেল) শহীদুল হক মুন্সি, কমলগঞ্জ পৌরসভার মেয়র জুয়েল আহমেদ, কমলগঞ্জ থানার ওসি ইয়ারদৌস হাসান, মণিপুরী সমাজকল্যাণ সমিতির সভাপতি আনন্দমোহন সিংহ প্রমুখ। পরে অনুষ্ঠিত হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। রাত ১১টা থেকে শুরু হয়ে শনিবার ভোর পর্যন্ত চলে শ্রীকৃষ্ণের মহারাসলীলানুসরণ। শুক্রবার দুপুরে মাধবপুরে রাসোৎসব ও বিকালে আদমপুরের রাসোৎসব পরিদর্শন করেছেন ভারতের সহকারী হাইকমিশনার নিরাজ কুমার জাসওয়াল।
অপরদিকে, রাসোৎসব ২০২১ উদযাপন পরিষদের উদ্যোগে আদমপুর মণিপুরি কালচারাল কমপ্লেক্স প্রাঙ্গণে মীতৈ মণিপুরি সম্প্রদায়ের ৩৬ তম রাসোৎসব নানা কর্মসূচীর মধ্য দিয়ে পালিত হয়। এখানে রাত সাড়ে রাত ১১টা থেকে শনিবার ভোর পর্যন্ত চলে শ্রীশ্রী কৃষ্ণের মহারাসলীলা উৎসব। ভোরের সূর্যোদয়ের পর পরিসমাপ্তি ঘটে এই মহামিলন অনুষ্টানের।
রাসলীলা উপলক্ষে কমলগঞ্জের তিনটি স্থানে মেলার আয়োজন করা হয়। মেলায় খৈ-মুড়ি, বাতাসা, ছোটদের বিভিন্ন ধরনের খেলনা, পোশাক, ঘর সাজানোর বিভিন্ন উপকরণ ও প্রসাধনী, শ্রীকৃষ্ণের ছোট-বড় বিভিন্ন আকৃতির ছবিসহ বাহারি পণ্য শোভা পায়। এ ছাড়া মাধবপুর শিববাজার এলাকায় মেলা প্রাঙ্গণে বসেছে মণিপুরি সম্প্রদায়ের ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে বইপত্রের কয়েকটি স্টল। বাঁশ ও কাগজ কেটে বিশেষ কারুকাজে রাসের মন্ডপ তৈরি করা হয়েছে। মন্ডপের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে বসে রাসধারী বা রাসের গুরু, সূত্রধারীরা এবং বাদকরা। পাশাপাশি তিনটি মন্ডপে আনুমানিক ২০০ জন বা ততধিক সংখ্যক তরুণী এ রাসলীলায় অংশ নিয়ে থাকে। রাসের সাধারণ ক্রম হচ্ছে- সূত্রধারী কর্তৃক রাগালাপ ও বন্দনা, বৃন্দার কৃষ্ণ আবাহন, কৃষ্ণ অভিসার, রাধা ও সখীদের অভিসার, রাধা ও কৃষ্ণের সাক্ষাৎ ও মান-অভিমান, ভঙ্গীপারেং, রাধার কৃষ্ণ-সমর্পণ, যুগলরূপ প্রার্থনা এবং আরতি।
মহারাসলীলা সেবা সংঘের সাধারণ সম্পাদক শ্যাম সিংহ জানান, মাধবপুর জোড়াম-পে রাস উৎসব সিলেট বিভাগের মধ্যে ব্যতিক্রমী আয়োজন। এখানে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার আগমন ঘটে। বর্ণময় শিল্পসমৃদ্ধ বিশ্বনন্দিত মণিপুরি সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী রাস উৎসবে সবার মহামিলন ঘটে। মণিপুরি ললিতকলা একাডেমির গবেষণা কর্মকর্তা প্রভাস সিংহ জানান, এখানে সব ধরনের সুবিধা বিদ্যমান থাকায় এটি উৎসবে রূপ নিয়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে উৎসবে যোগ দিতে হাজার হাজার ভক্ত অনুরাগী এখানে এসেছেন।
ইতিহাস পর্যালোচনায় জানা যায়, ১৭৭৯ সালে মনিপুরের মহারাজা ভাগ্যচন্দ্র স্বপ্ন দৃষ্ট হয়ে যে নৃত্যগীতের প্রর্বতন করেছিলেন তাহাই রাসোৎসব। ভাগ্যচন্দ্রের পরবর্তী রাজাগনের বেশরিভাগই ছিলেন নৃত্যগীতে পারদর্শী এবং তারা নিজেরাও রাসনৃত্যে অংশগ্রহন করতেন। এর ফলে মণিপুরি সম্প্রদায়ের মধ্যে এ কৃষ্টির ধারাবাহিকতায় কোন ছেদ পড়েনি। অতীতের সেই ধারাবাহিকতার সূত্র ধরেই কোন রুপ বিকৃতি ছাড়াই কমলগঞ্জে উদযাপিত হয়ে আসছে মণিপুরি সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব শ্রীকৃষ্ণের মহারাসলীলা। তুমুল হৈ-চৈ, আনন্দ-উৎসাহ, ঢাক, ঢোল, মৃদঙ্গ, করতাল এবং শঙ্খ ধ্বনির মধ্যদিয়ে রাধা-কৃষ্ণের লীলাকে ঘিরেই এ দিনটি বছরের অন্য সব দিন থেকে ভিন্ন আমেজ নিয়ে আসে কমলগঞ্জ উপজেলাবাসীর জীবনে। রাসলীলায় মনিপুরী নৃত্য শুধু কমলগঞ্জের নয় গোটা ভারতীয় উপমহাদেশের তথা সমগ্র বিশ্বের নৃত্য কলার মধ্যে একটি বিশেষ স্থান দখল করে নিয়েছে। ১৯১৯ সালে সিলেটের মাছিমপুরে মনিপুরী মেয়েদের পরিবেষ্টিত রাস নৃত্য উপভোগ করে মুগ্ধ হয়েছিলেন বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। পরে কবিগুরু কমলগঞ্জের নৃত্য শিক্ষক নীলেশ্বর মুখার্জীকে শান্তি নিকেতনে নিয়ে প্রবর্তন করেছিলেন মণিপুরি নৃত্য শিক্ষা। কমলগঞ্জে প্রায় এক মাস আগ থেকেই চলছিল রাসোৎসবের প্রস্তুতি।
এস এস/সিএ
দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com
সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
আমাদের ফেসবুক পেজ https://www.facebook.com/deshdiganta.cbna24 লাইক দিন এবং অভিমত জানান