সেই নবজাতক পেল দুধমা
ময়মনসিংহের ত্রিশালে সড়ক দুর্ঘটনায় বাবা-মা-বোন হারানো নবজাতককে দুধ খাওয়াচ্ছেন হাসপাতালে ভর্তি থাকা এক প্রসূতি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সেই দুধমা যেন নিজের সন্তানের মতোই ভালোবাসা ঢেলে দিচ্ছেন জন্মের পরপরই এতিম হওয়া কন্যাশিশুটির প্রতি।
গতকাল রবিবার দুপুরে ময়মনসিংহ নগরের চরপাড়া এলাকার বেসরকারি লাবিব হাসপাতালে গেলে এই চিত্র দেখা গেছে। ওই হাসপাতালের দ্বিতীয় তলায় চিকিৎসকদের নিবিড় পর্যবেক্ষণে রয়েছে শিশুটি।
পালাক্রমে একজন করে নার্স সেখানে সার্বক্ষণিক অবস্থান করছেন। বর্তমানে শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. কামরুজ্জামান এবং অর্থোপেডিক চিকিৎসক ডা. সোহেল রানার তত্ত্বাবধানে রয়েছে নবজাতকটি।
হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শাহ জাহান জানিয়েছেন, শিশুটির এক হাত ভেঙে যাওয়ায় আরো ১০-১২ দিন চিকিৎসাধীন থাকতে হতে পারে। এই চিকিৎসা এবং সেবা বিনা মূল্যে দেওয়া হচ্ছে বলে তিনি জানান।
মো. শাহ জাহান জানিয়েছেন, জেলা প্রশাসন এবং সমাজসেবা বিভাগ থেকে শিশুটির খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। অনেকেই শিশুটির দায়িত্ব নিতে চাচ্ছেন। এমনকি বিদেশ থেকেও অনেকে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। তিনি জানিয়েছেন, শিশুটির পরিবারই এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে।
তবে হাসপাতালে উপস্থিত শিশুটির মামা আরিফ (৩৫) বলেন, আত্মীয়স্বজন যাঁরা আছেন তাঁরা সবাই মিলেই শিশুটিকে দেখবেন।
এদিকে গতকাল ত্রিশালের রায়মণি এলাকায় শিশুটির দাদাবাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, দাদা সত্তরোর্ধ্ব মোস্তাফিজুর রহমান বাবলু হাউমাউ করে কাঁদছেন। উঠানের পাশে কবরের দিকে তাকিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন, ‘এইহানে সাতজনের কবর। তাগর পাঁচজনই মরছে অ্যাকসিডেন্টে। এই সড়কই আমার ভাই, দুই ছেলে, ছেলের বউ আর নাতিরে কাইড়া নিছে। ’
তিনি জানান, ১৯৯৫ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান তাঁর ছোট ভাই ফজলুল হক। ২০০৪ সালে বাড়ির সামনে মহাসড়কে দুর্ঘটনায় মারা যান তাঁর ছোট ছেলে শামসুল হক। এবার বড় ছেলে, ছেলের বউ ও নাতনি মারা গেলেন।
তবে বেঁচে যাওয়া নাতনিকে আগলে রাখার কথা জানান বাবলু। তিনি বলেন, ‘আমার যত কষ্টই হোক, আমি যত দিন বেঁচে আছি তাকে লালন-পালন করব। ’ পরিবারের পুরুষ সদস্য বলতে এখন বেঁচে আছেন একমাত্র বাবলু।
আরও পড়ুনঃ ট্রাকচাপায় পেট ফেটে নবজাতকের জন্ম, বাবা-মা নিহত
মারা যাওয়া জাহাঙ্গীর আলম, তাঁর স্ত্রী রত্না বেগম ও মেয়ে সানজিদার কবরের পাশে অনবরত বিলাপ করছিলেন জাহাঙ্গীরের মা সুফিয়া আক্তার। আর বাকরুদ্ধ হয়ে বাবা-মা-বোনকে খুঁজছিল জাহাঙ্গীর-রত্না দম্পতির ১০ বছর বয়সী মেয়ে জান্নাত ও সাত বছর বয়সী ছেলে এবাদত। জান্নাত স্থানীয় ব্র্যাক স্কুলে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। এবাদত স্থানীয় মক্তবে যাওয়া-আসা করে।
জাহাঙ্গীরের বাবা মোস্তাফিজুর রহমান বাবলু ও মা সুফিয়া আক্তার দুজনই শারীরিক প্রতিবন্ধী। তাঁরা জানান, দরিদ্র পরিবারে মোস্তাফিজই ছিলেন উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তাঁকেসহ তিনজনকে একসঙ্গে হারিয়ে আরো অসহায় হয়ে পড়েছেন তাঁরা। এখন নবজাতকসহ জাহাঙ্গীরের তিন সন্তানের ভবিষ্যৎও অনেকটা অনিশ্চয়তার মুখে।
নবজাতকের বড় বোন জান্নাত আক্তারের (১০) কাছে জানতে চাইলে কাঁদতে কাঁদতে বলে, ‘দাদা-দাদি ও আমি মিলে তাকে পালব।’
গত শনিবার বিকেল পৌনে ৩টার দিকে ত্রিশালের কোর্ট ভবন এলাকায় রাস্তা পার হওয়ার সময় ট্রাকচাপায় প্রাণ হারান অন্তঃসত্ত্বা রত্না বেগম (৩২), তাঁর স্বামী জাহাঙ্গীর আলম (৪০) এবং তাঁদের ছয় বছরের মেয়ে সানজিদা। মারা যাওয়ার আগে প্রসব হওয়ায় বেঁচে যায় রত্মার গর্ভের সন্তান। পরে নবজাতকটিকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
ত্রিশাল থানার ওসি মাইন উদ্দিন জানান, ওই ঘটনায় একটি মামলা হয়েছে। ঘাতক ট্রাকটি আটক করে থানায় নিয়ে আসা হয়েছে। চালককে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
ময়মনসিংহে লাবিব হাসপাতালে গতকাল নবজাতক ছোট বোনকে দেখতে যায় বাবা-মা-বোন হারানো শিশু জান্নাত ও এবাদত।
-কালের কণ্ঠ