সাহিত্য ও কবিতা

সন্দেহ ||||  কাকলী আহমেদ

সন্দেহ ||||  কাকলী আহমেদ

আমার দেবর ও আমরা এক বাসাতেই থাকি। আমি, আমার বর বিপুল, মেয়ে, দেবর ও জা। বিয়ের পর থেকে বিপুলের ছোট ভাই রবিন আমার সঙ্গেই ছিল। আমার শ্বশুর-শাশুড়ি গত হয়েছেন অনেক বছর। আমার বর বিপুল পুরো পরিবারের অনেক দায়িত্বকর্তব্যই পালন করেছে। ওর ছোট দুই বোনকে বিয়েশাদি দিয়ে তারপর নিজে বিয়ের পিঁড়িতে বসেছে।

বিয়ের পর থেকে রবিন আমার সঙ্গেই। লেখাপড়া শেষ করে গত বছর রবিন বিয়ে করেছে। আমার জা শিউলি ভীষণ সুন্দরী। অনেক বড়লোকের মেয়ে। আমার সঙ্গে বয়সের অনেক পার্থক্য বলে দুজনের সম্পর্কটা একটু গুরুগম্ভীর। আমাকে বড় ভাবী বলেই ডাকে ও। আমি নিজে ইচ্ছে করে শিউলির সঙ্গে খুব খোলামেলা সহজ হওয়ার চেষ্টা তেমন করিনি কখনো।

আমার কন্যা নিশুকে শিউলি ভীষণ ভালোবাসে। দুই বছরের নিশু বলতে গেলে পুরোটা সময় ওদের কাছেই থাকে। শিউলি একটা কলেজে মাস্টার্স করছে। প্রতিদিন ক্লাস না থাকলেও সপ্তাহে দুই-তিন দিন হয়তো যায়। সে সময়টুকু নিশু আমার কাছেই থাকে। শিউলি ঘরে থাকলে পুরো সময় সে চাচির ঘরেই সময় কাটায়।

শিউলির যেদিন ক্লাস থাকে, সেদিন ওর মায়ের বাড়ি থেকে গাড়ি আসে। শিউলি খুব সুন্দর সুপরিপাটি হয়ে কলেজে যায়। কলেজে যাওয়ার সময় নিশু ‘চাম্মা’ ‘চাম্মা’ বলে চিৎকার করে কাঁদে।

আমাদের বাড়িতে কাজে সাহায্য করার জন্য একটা ছেলে আছে, নাম খোকন। খোকনকে দিয়েছিল আমার এক বান্ধবী। তেরো-চৌদ্দ বছরের ছেলেটা ঢাকায় কখনো কাজ করেনি। আমার বাসাতেই প্রথম কাজ করতে আসা। কিন্তু নরসিংদীর এক হোটেলে কাজ করত বলে ঘরের কাজ বেশ তাড়াতাড়িই সে ধরে ফেলেছিল। রান্নার কাজে ভালোই আমাকে সাহায্য করতে পারত।

খোকন এ বাড়িতে আছে আজ দুই বছর। সুন্দর ডাগর ডাগর নয়নের ছেলেটা। আমাকে সে খালা বলে ডাকে। কী জানি কী কারণে আমার ভেতরে এক মাতৃরূপ বোধ করি ও খুঁজে পেয়েছে। আমার অসম্ভব অনুরক্ত। যেকোনো কাজের আজ্ঞা দিলেই করার জন্য ছুটে যায়। আমার সঙ্গে সঙ্গে অনেক কাজেই সে হাত লাগায়। গ্রাম থেকে আসা ছেলেটার ভেতর অনেক মায়া আমার জন্য। অল্পেই আমি সেটা বুঝতে পারি। আমিও মাতৃস্নেহেই তাকে বড় করতে থাকি দরিদ্র ঘরের ছেলেটাকে। দিন গড়াতে থাকে আর খোকনও আমাদের পরিবারের এক সদস্য হয়ে ওঠে।

দিনগুলো ভালোই যাচ্ছিল। মেয়ে আমার আধো আধো বোলে সারা বাড়ি মাত করে রাখে। বিপুল সারা জীবন কাজপাগল এক মানুষ। নিজের অফিসের কাজ নিয়েই থাকে। সরকারি অফিসে কাজ করেও প্রতিদিন অফিস শেষ হওয়ার দুই-তিন ঘণ্টা পর পর্যন্ত অফিসেই কাজ করে। কাজের চাপ নাকি, কাজের প্রতি অতিরিক্ত আনুগত্য আমি ভেবে পাই না। বিয়ের পর প্রথম প্রথম খুব খারাপ লাগত। এখন সয়ে গেছে।

ঘরে মেয়েকে নিয়েই সময় কাটাই। বেশিভাগ সময় নিশু ওর চাচা-চাচির কাছেই থাকে। কেবল খাওয়া আর ঘুম বাদে সব সময়টুকু সে ওদের  সঙ্গে। আমার জা-এর সঙ্গে দরকারি কথা ছাড়া তেমন কোনো কথাবার্তাই আমার হয় না। তবে পারিবারিক অনুষ্ঠানগুলোতে আমরা একসঙ্গেই যাই। তখন দূর থেকে কেউ আমাদের দেখে বুঝতেই পারে না, আমরা এক বাসায় বসবাস করেও যোজন যোজন দূরে থাকি।

শিউলির মা-বাবা দুই-এক দিন পরপরই মেয়েকে দেখতে আসেন। এত এত ফলমূল, মিষ্টতা আর নানা রকমের বেকারি আইটেমও নিয়ে আসেন। খালাম্মা-খালু অত্যন্ত সজ্জন ব্যক্তি। ড্রইংরুমে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলাপ চলে। আমিও তাদের সময় দিই। নিশু শিউলির মা-বাবাকে ফ্রক দুলিয়ে নাচ দেখায়। ওনারা হেসে কুটিপাটি। প্রতিদিনই ওনারা এলে আমি রাতে খেয়ে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করি। কিন্তু ওনারা কখনোই খেয়ে যান না। হালকা নাশতা-চা দিয়েই আপ্যায়ন করি। খোকন এ বিষয়ে বড়ই উদ্যোগী। নানা-নানুকে দেখলেই নানা রকম নাশতা দিয়ে আপ্যায়নে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

শিউলির মা কিছু সময় ড্রইংরুমে আমাদের সবার সঙ্গে গল্প করে শিউলির রুমে চলে যান। আমি খালুর সঙ্গে বসে কথা বলি। খুব ভালো মানুষ। অনেক জ্ঞানী। এখনো ইংরেজি নভেল, বাংলা উপন্যাস পড়েন। সারা পৃথিবীর খবরাখবর রাখেন। অত্যন্ত জ্ঞানী এই ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলায় কখনো ক্লান্তি আসে না। শিউলি তার মায়ের সঙ্গে একা কী কথা বলে, বুঝে উঠতে পারি না। হয়তো নিজেদের পারিবারিক কোনো গোপন বিষয় নিয়ে কথা বলে।

বেশি রাত গড়িয়ে গেলে চটজলদি রান্নার আয়োজন করে খালাম্মা-খালুকে খুব কষ্টে রাজি করিয়ে খাইয়ে দিই। কিন্তু বেশিভাগ দিনই ওনারা বিকেলে এসে বেশ কিছু সময় থেকে চলে যান।

শিউলির মা-বাবা চলে গেলে বিদায় জানিয়ে ঘরে ঢুকে আমি কেমন এক বিষণ্নতায় ভুগি। নিজের বাবা-মায়ের কথা মনে হয়। পুরান ঢাকার সেই আরমানিটোলায় ওনারা থাকেন। শহরের আরেক প্রান্ত। মন চাইলেই আমার বাড়িতে আসতে পারেন না। গাড়ি নেই ওনাদের। তার ওপরে বয়সও অনেক। দুজনেই বুড়ো হয়ে গেছেন। মন টানলেও শরীর সায় দেয় না। মেয়ে-নাতনিকে দেখতে মন চাইলেও আসতে পারেন না। সংসারের প্রতিদিনের ঝামেলা ঠেলে আমিও তেমন যাই না বা যাওয়া হয়ে ওঠে না। আসলে মেয়ে বিয়ে দিলে বোধ করি মা-বাবার সঙ্গে একধরনের বিচ্ছেদই ঘটে। একধরনের দূরত্বই বুঝি তৈরি হয়ে যায় মেয়ে ও মা-বাবার সঙ্গে। আমি আরো বুঝতে পারি শিউলির সঙ্গে আমার দূরত্ব এ কারণেই। ধনাঢ্য পরিবারের মেয়ে হওয়ার কারণে আমি ভেতরে ভেতরে একধরনের মানসিক দূরত্বে বসবাস করি। শিউলির আর আমার বেড়ে ওঠা পুরো উল্টো। শিউলির দৈনন্দিন জীবনযাপনের অনেক কিছুই আমার কাছে বিলাসিতা। কিন্তু শিউলি আসলে এমন বিলাসভূষণেই বড় হয়েছে। শিউলি আমার  সঙ্গে সহজ হতে চাইলেও আমাদের দুজনের জীবনদর্শন পুরোপুরি বিপরীত। শিউলির সঙ্গে প্রচ্ছন্ন দূরত্ব থাকা সত্ত্বেও ভালোই যাচ্ছিল আমাদের দিনগুলো।

এক শুক্রবার বিয়ের দাওয়াত ছিল। শিউলির খালাতো বোনের বিয়ে। খুব নিকট স্বজনের বিয়ে বলেই শিউলির উৎসাহের শেষ নেই। আমাকেও বলে রাখল আমি যেন পারলারে যাই চুল বাঁধতে। সে নিজেও যাবে। শিউলির খালা আমাকে আর ওকে বিয়েতে পরার জন্য দামি শাড়ি দিয়েছেন। নিশুকে খুব সুন্দর পার্টি ফ্রক। শিউলির উৎসাহের শেষ নেই। ভাশুরকেও সে খুব ফিটফাট হয়ে যাওয়ার কথা বলেছে। ছেলের হলুদ, মেয়ের হলুদ সব অনুষ্ঠানেই আমরা যাই । বিয়ের দিন শিউলি আমাকে জোর করে পারলারে নিয়ে গিয়ে ওর ইচ্ছেমতো চুল সেট করাল। নিজেও খুব সুন্দর করে চুল বাঁধল। কিনে আনা ফুল দিল চুলে। আমাকেও কানের এক পাশে ক্লিপ দিয়ে ফুল আটকে দিল। অনেকটাই পার্টি সাজে পারলার থেকে খুশিমনে বের হলাম। শিউলির মা গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন। আমরা খুব সুন্দর সাজগোজ করে গাড়িতে করে বিয়েতে গেলাম।

এত কাছের মানুষের বিয়ে বলেই আমি খোকনকে নিয়ে যেতে চাইলাম। আমার বর অফিস থেকে বিয়েতে চলে যাবে। শিউলি মুখ গম্ভীর করে মানা করল। ওর যাওয়ার দরকার নেই। আসার সময় ভাইজান থাকবে গাড়িতে তো জায়গা হবে না। আমি হতবিহ্বল হয়ে ওর দিকে কিছু সময় তাকিয়ে থাকলাম।

শিউলির সঙ্গে আসলে আমার এখানেই পার্থক্য। মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে হওয়ার কারণে আমার চিত্ত খোকনকে ছেড়ে যেতে কাঁদছে। কিন্তু শিউলির খোকনের চিন্তা একবারও মাথাতেই আসার কথা না। আমি মুখ ভার করে কিছু সময় বসে থেকে রওনা দিলাম। পুরো রাস্তা শিউলির সঙ্গে আমার তেমন কোনো কথাই হলো না। যদিও সে রাস্তাতে ওর খালাতো বোনের কত বড়লোকের বাড়িতে বিয়ে হয়েছে, সে গল্পেই মশগুল হয়ে রইল। নিশু চাচ্চুর কোলে বসে খিল খিল করে হাসতে থাকে। আমরা বিয়ে বাড়িতে ঢুকি।

অনেক রাতে বাড়ি ফিরি। বিপুলসহ একসঙ্গেই বিয়ে থেকে বাড়ি ফিরি। শিউলি বোনের বিয়েতে খুবই মজা করেছে। সারা মুখে-চোখে আনন্দের ফুলকি।

বাড়ি ফিরে আমরাও বর, কনে, খাবার, গহনা এগুলো নিয়েই গল্প করি। রাত অনেক হয়ে যাওয়ায় একসময় ঘুমিয়েও যাই।

পরের দিন খুব সকালে রবিন, বিপুল অফিসের জন্য নাশতা খেয়ে বের হয়ে যায়। আমি একাত-ওকাত করে বেশ দেরিতে ঘুম থেকে উঠি।

নিশুও আজ অনেকক্ষণ ঘুমিয়েছে। আমি ওঠার সঙ্গে সঙ্গে সেও উঠে পড়ে। সকাল সাড়ে দশটা বাজে। দুপুরের রান্না করতে হবে। এ বাড়ির রান্নার ভার আমার ওপর। বিয়ের পর থেকে শিউলি আগ বাড়িয়ে কখনো রান্না করতে চায়নি। হয়তো মাঝেসাঝে বিকেলের নাশতা বা স্পেশাল দুই-একটা আইটেম ও করে। আমিই মূলত রান্না করি। খোকন সবকিছু রেডি করে দেয়।

ভাবী, আমার একটু কথা আছে তোমার সঙ্গে। শিউলি আমার ঘরে ঢুকে আমার খাটে বসে উদ্বিগ্ন গলায় কথাগুলো বলে। পুরো মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ। ওকে কেমন অস্থির দেখাচ্ছে। বলো, কী হয়েছে? কী বলতে চাও?

ভাবি কাল আমি আমার বিয়ের ঝুমকা জোড়া বের করেছিলাম। ভেবেছিলাম মেরুন কালারের শাড়ির  সঙ্গে ওটা মানাবে ভালো। কিন্তু পরে ভালো দেখাচ্ছিল না বলে পার্লের সেট পরে গেলাম। তাড়াহুড়োতে আর আলমারিতে উঠিয়ে যেতে পারিনি। ড্রেসিং টেবিলের ওপরেই রাখা ছিল। গতকাল রাতে ক্লান্ত থাকায় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আজ গহনা ওঠাতে গিয়ে দেখি এক জোড়া ঝুমকার একটা আছে। আরেকটা নেই।

মানে? আমি চমকে ওর দিকে তাকালাম। খুঁজে দেখো ভালো করে, এদিক-ওদিক আছে মনে হয়। শিউলির কপালে চিন্তার ভাঁজ ফুটে উঠেছে। না, ভাবী আমি পুরো বাসা খুঁজেছি। কোত্থাও নেই।

ঝুমকা হারানোর ঘটনা শিউলি ইতোমধ্যে রবিনকে বলেছে ফোনে। সেও শিউলিকে বলেছে খুব ভালো করে খুঁজে দেখতে। বাসায় আর কেউ আসেনি। আমরা বের হয়ে যাওয়ার পর কেবল খোকন পুরো বাসায় একা ছিল। শিউলি বলল, সে রাতে ওদের বিছানা করেছে। লেপ দিয়েছে। আমি পুরোটাই হতবিহ্বল। কিন্তু ঝুমকা নিল কে।

ঝুমকা হারানোর ঘটনা বাসার সবাই জেনে গেল; একমাত্র খোকন ছাড়া। খোকনকে জিজ্ঞেস করা হয়নি। আমি শিউলিকে বলেছি, আমি জিজ্ঞেস করব। আর যেহেতু আরেকটা আছে, সেটা দেখিয়েও জিজ্ঞেস করা যাবে।

দিন গড়িয়ে রাত এল। শিউলির ধারণা, এই ঝুমকা খোকন ছাড়া আর কেউই নেয়নি। আমি চুপ মেরে আছি। খোকনের সপক্ষে বা বিপক্ষে কিছুই বলছি না। এত বছর আছে ছেলেটা অসততার চিহ্নমাত্র দেখিনি। আজ হঠাৎ করে এত বড় একটা জিনিস নিয়ে নেবে, ঘটনাটা আমার বিশ্বাস হয় না।

ঘর থেকে চিৎকার-চেঁচামেচি শুনে রান্নাঘরে গেলাম। শিউলি দাঁড়িয়ে আছে। রবিন খোকনকে ধমাধম কিল, চড়, ঘুষি মারছে। রবিনের চোখ, মুখ দিয়ে অগ্নি-স্ফুলিঙ্গ ছুটে বের হচ্ছে। ‘বল কানের দুল কোথায় রেখেছিস। বের করে দে। নয়তো তোকে জেলের ভাত খেতে হবে।’ খোকন দুই হাত দিয়ে মার ঠেকানোর চেষ্টা করছে। আর চিৎকার করে ব্যথায় কাঁদছে। পরিস্থিতি বেসামাল দেখে আমিও বুঝে উঠতে পারছি না কী করব।

আসলেই তো ঘরে খোকন ছাড়া আর কেউ ছিল না। সন্দেহ করলে তো ওকেই করতে হয়। ঝুমকা পরেও যায়নি শিউলি। আর বিয়ের গহনা বলে কথা। খোকনকে মারার আগে ওকে জেরাও করেছে। আমি অবশ্য এসবের ভেতর ছিলাম না। চুপচাপ এমন মানবেতর দৃশ্য দেখা আমার পক্ষে সম্ভব না।

ঘটনার আকস্মিকতায় আমি স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম।

একটা ঘটনাই পুরো বাসার পরিস্থিতি পাল্টে দিল। রবিন এমনিতেই খুব বদরাগী। তার ওপর নিজের বউয়ের এমন ক্ষয়ক্ষতিতে খোকনকে ছেড়ে দেওয়ার পাত্র সে না।

ঘর থেকে শুনতে পেলাম জোরে জোরে মারধরের শব্দ। খোকন ব্যথায় চিৎকার করছে আর বলছে, ‘আমি নেই নাই। মামা আমি কিছু জানি না।’ খোকন যতই অস্বীকার করে, ততই রবিন আরো জোরে তার ওপর কিল-ঘুষি, চড়-থাপ্পড়, লাথি মারতে থাকে। আমি নিজের ঘরে বসে দুই হাতে কান চেপে ধরে বসে থাকি। খোকনের কান্না আর আর্তচিৎকার সহ্য করা আমার পক্ষে সম্ভব না। যদিও অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, ঝুমকা খোকনই নিয়েছে।

বিপুল ঘরে আসার ঘণ্টাখানেক পর রবিন পুরো ঘটনা খুলে বলে। খোকনকে সে পুলিশে দেবে এমন কথাও বলে। আমার বর বড়ই ঠাণ্ডা মাথার ও ধিরস্থির ধরনের মানুষ। সব শুনে সে বলে, তোমাদের অসাবধানতার কারণেই এমনটা হয়েছে। তবে এটাও ঠিক খোকনের অসাধুতা প্রকাশ পেয়েছে, তাকে আর রাখা যাবে বা। আমি ওর বাবাকে ডেকে ওকে কালই বিদায় করে দেব। শিউলি আর রবিনের এই রফা পছন্দ হলো না বোঝা গেল। কিন্তু বড় ভাইয়ের কথার ওপর কিছু বললও না।

পরের দিন খুব ভোরে শিউলি কাপড়চোপড় নিয়ে বাপের বাড়ি চলে গেল। রবিন অফিস শেষ করে ও-বাড়িতে যাবে এমন ইঙ্গিত দিয়ে গেল।

বেলা ১১টার দিকে খোকনের বাপ এলে ওকে বিদায় করলাম। কী কারণে বিদায় করেছি, এটা বলতে গিয়ে আমার গলা কাঁপছিল। এত বছর ছেলেটা আমার কাছে, কখনো কোনো দিন পাই-পয়সা কোনো কিছুই এদিক-ওদিক করেনি। অথচ চুরির দায়ে তাকে এ বাসা ছেড়ে যেতে হচ্ছে, ভাবলেই আমার শরীর কাঁটা দিয়ে ওঠে।

সময়ের সঙ্গে কিছুই আর ঠিক হয় না। মাসখানেক বাদে শিউলি ফেরত আসে। আমার সঙ্গে তার কথা বন্ধ। রবিন নিজেও খুব ভাবগাম্ভীর্য নিয়ে থাকে। আমাদের সঙ্গে তাদের এক রকম দূরত্বই তৈরি হয়ে গেল এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে। আন্দাজ করতে পারি, হয়তো এ বাসা থেকে তারা আলাদাও হয়ে যাবে অচিরে।

খোকনের পরিবর্তকও কেউ নেই। ছুটা বুয়া এসে কিছু কাজ করে দিয়ে যায়। বাকি কাজ আমাকেই করতে হয়। নিশুর যত্ন, দেখাশোনা সব একা আমাকেই সামলাতে হয়। তবে নিজে কাজ করায় ঘরের অনেক কিছুই বহুদিন পর নাড়াচাড়া পড়ে।

নিশুও বড় হচ্ছে নিজের মতো, খেলনা নিয়েই ব্যস্ত সে। কখনো হাঁড়ি-পাতিল, কখনো পুতুল খেলায় ব্যস্ত। আমার ও জায়ের শীতল সম্পর্ক তো তাকে ছোঁয় না।

আগের মতো সবকিছু চললেও সব যেন কেমন থমথমে। শিউলি এই বাড়িতে সব সময়ই ছিল আলগা আলগা। তেমনই আছে এখনো। যে যার ঘরে তার মতো করেই সময় কাটে। একসঙ্গে বসে পারিবারিক সময় কাটানো আর হয় না। বোধ করি ঢিলে হয়ে যাওয়া সম্পর্ক জোড়া লাগা এত সহজে হয় না।

রাতে আমরা একসঙ্গে সবাই খেতে বসেছি। কারো মুখে কোনো কথা নেই। ঝুমকা চুরির এক ঘটনা রক্তের সম্পর্ককে এভাবে শীতল করে দিতে পারে, ভাবলে অবাক হই। মুখ নিচু করে যে যার খাওয়া খাচ্ছি। অবশ্য ওই ঘটনার পর এমনই হয়ে গেছে। চুপচাপ থমথমে আবেগহীন দিনযাপন।

মা, মা দেখো। আরেকটা কানের দুল দরকার। তুমি তিনে দিবা। মস্ত বড় পুতুল হাতে দৌড়ে আসে নিশু। বিরাট বড় প্রায় ওর সমান পুতুলটাকে পাঁজাকোলা করে আমার ডাইনিং চেয়ারের কাছে আসে। পুতুলকে চুমু দিয়ে পুতুলের এক কানে ঝুমকা লাগিয়ে অন্য খালি কান দেখিয়ে বলে, এ কানে আরেকটা দুল পলবে তো ও। তুমি তিনে দাও না তো!

আমরা সবাই হাঁ করে তাকিয়ে দেখি নিশুর পুতুলের এক কানে সেদিনের সেই হারিয়ে যাওয়া ঝুমকা।


লেখক পরিচিতি: কাকলী আহমেদ ১৯৬৭ সালে খুলনায় জন্মগ্রহণ করেন। প্রকৃতিপ্রেমে চির মগ্ন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক ও মাস্টার্স করে বাংলাদেশ ব্যাংকে মহাব্যবস্থাপক পদে কর্মরত। ভালবাসেন কবিতা ও গল্প লিখতে।

-সারাক্ষণ

 

সংবাদটি শেয়ার করুন