আপনি বাংলাদেশের পক্ষে ভোট দেবেন নাকি পূর্ব-পাকিস্তানের পক্ষে?
শিতাংশু গুহ, নিউ ইয়র্ক ।। ক’দিন আগে বলেছিলাম, এবার নির্বাচন হবে অবাধ ও সুষ্ঠূ, নির্বাচনের পর বিতর্ক হবেনা বা সবাই ফলাফল মেনে নেবেন, এবং শেখ হাসিনা আবার ক্ষমতায় আসবেন। অনেকের কাছে এ হিসাবটা মেলানো বেশ কষ্টকর। কেউ কেউ জানতে চাচ্ছেন, কিভাবে সম্ভব? কিছু মানুষ ‘গালাগালি’ দিচ্ছেন। রাজনৈতিক মঞ্চের হিসাবটা বড়ই জটিল, এজন্যেই হয়তো বলা হয়, রাজনীতিতে স্থায়ী শত্রু-মিত্র নেই? রাজনৌতিক আদর্শের কথা ভাবছেন? না, ওটি এখন কোথাও নেই, যেকোন মূল্যে ক্ষমতায় যাওয়া বা থাকাই এখন আদর্শ! তবু যখন প্রশ্ন উঠবে, বা ইতিমধ্যে প্রশ্ন উঠেছে যে, আপনি বাংলাদেশের পক্ষে ভোট দেবেন নাকি পূর্ব-পাকিস্তানের পক্ষে?
সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনগুলো মোটামুটি সুষ্ঠূ হয়েছে বা হচ্ছে, বিএনপি এতে অংশ নিচ্ছেনা বটে, কিন্তু আওয়ামী লীগ বিরোধী প্রার্থীদের ভোট দিচ্ছে, ভেতরে ভেতরে প্রচারণা চালাচ্ছে, ফলাফল সবার জানা। ছয় মাস আগে যাঁরা জোর দিয়ে বলতেন যে, আওয়ামী লীগের জয়ের কোন সম্ভবনা নেই, এখন তারাই বলছেন, আওয়ামী লীগের বিকল্প নেই। এদের যুক্তি হচ্ছে, বাংলাদেশের মত একটি দেশে, যেখানে সেনাবাহিনী, পুলিশ, প্রশাসন সবাই সরকারের পক্ষে এবং জনগণ বিভক্ত, সেখানে নির্বাচনের ফলাফল সরকারি দলের পক্ষে যেতে বাধ্য। বিএনপি সমর্থক ভাসমান জনতা, জামাতের ক্যাডার ভিত্তি হয়তো উৎসাহ-উদ্দীপনা সৃষ্টি করতে পারে, নির্বাচনের ফলাফলে খুব একটা প্রভাব ফেলতে পারেনা।
বাংলাদেশে সাধারণ ভোটারদের একটি ‘আজব’ মনস্তাত্বিক দর্শন আছে, এঁরা নিজের ভোটটি ‘নষ্ট’ (!) হতে দিতে রাজি নন! অর্থাৎ যাঁরা জিতবে, ভোট তারাই পাবেন। বাংলাদেশের মানুষ ঐতিহ্যগতভাবে ‘এন্টি-গভর্মেন্ট’, আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে রাগ-ক্ষোভ তাই বেশি। সরকার যেমন যথেষ্ট ভাল কাজ করেছে, অপকর্মের তালিকা ততটা ছোট নয়! ১৯৭৩-১৯৭৫-এ যাঁরা জাসদ-এর রাজনীতি দেখেছেন, তাঁরা জানেন, ঐসময় জাসদ ফুলে-ফেঁপে উঠেছিলো, কারণ তখন রাজাকার, আলবদর, স্বাধীনতা বিরোধী, মৌলবাদী গোষ্ঠী, পাকিস্তানপন্থী সবাই জাসদে ঢুকে ‘দেশপ্রেমিক’ সেঁজে গিয়েছিলো। বর্তমান আওয়ামী লীগের অবস্থাও অনেকটা একই? সবাই এখন আওয়ামী লীগ! সবাই এখন বঙ্গবন্ধু-প্রেমিক।
টঙ্গীর নির্বাচন সুষ্ঠূ হয়েছে। টঙ্গীর নির্বাচন থেকে কি আওয়ামী লীগ শিক্ষা নেবে? মজার ব্যাপার হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র থেকে সরকার যে ৩জনকে খুব কাছে টেনে নিয়েছে, এদের কেউ যৌবনে ছাত্রলীগ বা আওয়ামী লীগ করেনি। এই ৩জনের ১জন বাদে বাকি দু’জন ব্যর্থ। দেশেও একই অবস্থা, জামাত থেকে এসে যিনি আওয়ামী লীগের কোন না কোন ইউনিয়ন বা মহকুমার প্রেসিডেন্ট-সেক্রেটারি হয়েছেন, তাঁর দলীয় আনুগত্য তো ছাত্রলীগের একজন কর্মীর মত হবার কথা নয়? দোর্দন্ড প্রতাপশীল শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীকে যখন ফেলা যাচ্ছিলো না, তখন একদল ‘স্তাবক’ সেই কাজটি করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু’র জন্যে একই কথা প্রযোজ্য। বঙ্গবন্ধু’র বৃদ্ধ পিতা মারা যাওয়ার পর মুস্তাক আহমদ যত কেঁদেছিলেন, বঙ্গবন্ধুও ততটা কাঁদেননি।
বঙ্গবন্ধু নিহত হবার সময় দলের যে অবস্থা ছিলো, এখনো অবস্থাটা প্রায় একই? তফাৎ হচ্ছে, বঙ্গবন্ধু সবাইকে বিশ্বাস করতেন, রাজনৈতিক পোড় খাওয়া শেখ হাসিনা কাউকেই বিশ্বাস করেন না! দলের অবস্থাটা তিনি জানেন বলেই এখন দলকে ‘ট্র্যাক-এ’ আনার চেষ্টা করছেন। ইতিমধ্যে সুফল পেতে শুরু করেছেন। স্থানীয় নির্বাচনগুলো এর প্রমান। বিএনপি ফ্যাক্টর নয়, বিএনপি-জামাত চেষ্টা করছে গণ-অসন্তোষ নিজেদের পক্ষে টানতে, যা স্বাভাবিক। বিএনপি’র ভাবছে, আমেরিকা তাদের উদ্ধার করবে। এটি ভ্রান্ত ধারণা, বাইডেন গিয়ে তারেককে ক্ষমতায় বসিয়ে দেবেনা, খালেদা জিয়াকে মুক্তি দেবেনা। নুরু-কিবরিয়া ঝগড়ার মত দেশবাসী ফখরুল-রিজভী’র ‘বাহাস’ দেখবেন না?
মোদীর আমেরিকা সফরে বোঝা গেছে যে, শেখ হাসিনা’র সরকারের বিরুদ্ধে যা হচ্ছে, তা একই সাথে মোদীরও বিরুদ্ধে, সুতরাং এই দুই নেতা-নেত্রী একত্রে তা প্রতিহত করবেন, সেটাই স্বাভাবিক। দক্ষিণ এশিয়ায় স্থিতিশীলতার পক্ষে দু’জনকেই জিতে আসতে হবে। ইসলামী শক্তির একটি অংশ এবার সরকারের সাথে আছে, এঁরা ভোট না দিলেও বিরোধিতা করবে না? সফলতা-ব্যর্থতা নিয়েই একটি সরকার চলে! এতকাল আওয়ামী লীগের ব্যর্থতা নিয়ে আলোচনা হলেও এখন সফলতা আলোচনায় আসছে। আদর্শিকভাবে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি’র মধ্যে হয়তো এ সময়ে তেমন বিশাল পার্থক্য নেই, কিন্তু বঙ্গবন্ধু’র সাথে জিয়ার তুলনা যেমনি চলেনা, শেখ হাসিনা’র সাথে তেমনি খালেদা জিয়ার তুলনা অর্থহীন। শেখ হাসিনা ছাড়া বাংলাদেশ অচল, খালেদা জিয়া-তারেক রহমান থাকা পর্যন্ত বিএনপি’র কোন ভবিষ্যৎ অন্ধকার!
শেখ হাসিনার বিকল্প নেই। আওয়ামী লীগের বিকল্প বিএনপি নয়! সরকার এবার নির্বাচনটি সিরিয়াসলি নিয়েছে। সরকারের লোকজন সর্বত্র পৌঁছাচ্ছেন। ডিজিটাল আইনের প্রতি ক্ষোভ আছে, আইনমন্ত্রী বলেছেন, ‘শিগগিরই সংশোধন আসছে’। হিন্দুরা সুরক্ষা আইন ও কমিশন চাচ্ছে, হয়তো সেটি পাবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রামু গেছেন। আওয়ামী নেতারা মুখে কিছুটা লাগাম টেনেছেন। অর্থাৎ ইতিবাচক অনেক কিছু ঘটছে, আরো ঘটবে। ঘটুক। বাংলাদেশ জিতুক। পূর্ব-পাকিস্তান হারিয়ে যাক। মিডিয়ায় দেখলাম, ধর্ম প্রতিমন্ত্রী হজ্ব করতে গিয়ে হারিয়ে গিয়েছিলেন, সুসংবাদ যে তাঁকে পাওয়া গেছে। নির্বাচনের আগে যদি আওয়ামী নেতাকর্মীরা হারিয়ে না যান, বা তাঁরা মাঠে থাকেন, তাহলে জয় পাওয়া খুব একটা কঠিন হবেনা। # [email protected];