ভ্রমণ

ভয়াবহ বিমান ভ্রমণের অভিজ্ঞতা ও অনুষঙ্গ ৪

বিল্লাহ ভাই

চতুর্থ পর্ব

ভয়াবহ বিমান ভ্রমণের অভিজ্ঞতা ও অনুষঙ্গ ৪ ।। এবার দেশে যাওয়ার আগেই আমি ভিএজি,বি সহকর্মি জহুরুল ইসলামকে দিয়ে স্মৃতিস্তম্ভের একটি নকশা করিয়ে নিয়েছিলাম। সেটি সংশ্লিষ্ট সবাই পছন্দ করেন। স্মৃতিস্তম্ভটির নির্মানপ্রক্রিয়ায় যুক্ত হন জামালপুর ও শেরপুরের আরো কয়েকজন বিশিষ্ট সমাজকর্মি। বেলটিয়া হাইস্কুল জমি দিতে এগিয়ে আসেন এবং নির্মানপ্রক্রিয়া দেখাশোনা করেন নিবেদিতপ্রাণ সমাজকর্মি ও জাদুঘরের অন্যতম প্রধান সংগঠক হিল্লোল সরকার (Hillol Sarker) ও তাঁর সহকর্মিরা। আমার ভাইবোনেরা সর্বাত্মক আগ্রহ ও দায়িত্ব নিয়ে এগিয়ে আসেন। কাজ এগিয়ে চলে দুর্দান্ত উৎসাহে। কিন্তু এবারেও দেশে যাওয়ার পর আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি। অল্প জ্বর, কিন্তু ছেড়ে যায় না একেবারে। আমার ইমিউন সিস্টেম খুব দুর্বল এখন। তাই সামান্য জ্বরেই কাবু হয়ে পড়ি। সেজন্য ২৭ নভেম্বর জামালপুরে গিয়ে আমি আয়োজকদের সাথে বৈঠক করতে পারলেও ০৩ ডিসেম্বর জামালপুর জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানকে দিয়ে স্মৃতিস্তম্ভের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করানোর অনুষ্ঠানে আমি উপস্থিত থাকতে পারিনি। তবে স্থির হয় ১৬ ডিসেম্বর স্থানীয় এমপিকে দিয়ে স্মৃতিস্তম্ভটি উদ্বোধন করা হবে এবং আমাদের পরিবারের সদস্যরা সেখানে উপস্থিত থাকবেন।

এদিকে ১০ ডিসেম্বর খুররমের শাহাদাৎ বার্ষিকী উপলক্ষে কাকিলাকুড়া হাইস্কুলে আলোচনা সভা এবং জেএসসি লেভেলে আব্বা ও আম্মার নামে দুটি স্থায়ী মেধাবৃত্তির ঘোষণা দেয়ার কর্মসূচী ছিলো। আমাকে সেখানে যেতে হলো, কিন্তু বেশিক্ষণ সেখানে থাকা সম্ভব হয়নি। দ্রুত আসতে হয়েছে জামালপুরে একটি বিশেষ পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটায়। মূল নকশার সাথে স্মৃতিস্তম্ভের নির্মীত কাঠামোর নাকি গড়মিল দেখা দিয়েছে! ইতোমধ্যে জানা গেছে স্থানীয় এমপি সাহেব ১৬ ডিসেম্বর আসতে পারবেন না – ঢাকায় সরকারি অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে হবে তাঁকে – আসবেন পরদিন। শুনে মেজাজটা আমার খাট্টা হয় উঠলো। আমার ফিরতি ফ্লাইট ১৯ ডিসেম্বর। আমি আমার অসন্তুষ্টি প্রকাশেও কুণ্ঠিত থাকলাম না। যাহোক, আমার অবস্থাটি বিবেচনায় এনে আয়োজকগণ পরে দুটি আলাদা অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত নেন। প্রথমটি ১৬ ডিসেম্বর বিকেলে বেলটিয়া স্কুলে শহীদ খুররম স্মরণে আলোচনা সভা এবং দ্বিতীয়টি হবে ১৭ ডিসেম্বর সকালে স্থানীয় এমপি কর্তৃক আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন ও আলোচনা সভা। তবে আমি সেখানে না থাকলেও চলবে – পরিবারের অন্যেরা যাবেন।

আরও পড়ুনঃ ভয়াবহ বিমান ভ্রমণের অভিজ্ঞতা ও অনুষঙ্গ ৩

সে অনুযায়ী ১৬ ডিসেম্বর ২০১৯, বেলা ১টার দিকে শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক ডঃ সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের (Syed Sakhawat Husain) গাড়িতে উঠে ময়মনসিংহ থেকে জামালপুরের দিকে রওনা দেই। আগের পরিকল্পনা আনুযায়ী স্মৃতিস্তম্ভের উদ্বোধন করার কথা ছিলো ১০ ডিসেম্বর। কিন্তু নির্মাণকাজ শেষ করা যায়নি। পরে ১৬ তারিখ দিন ধার্য করায় ডঃ হোসেন বড়ো চাপের মধ্যে পড়ে যান। কারণ, সেদিন তাঁর অন্যান্য কর্মসুচীতে উপস্থিত থাকার কথা। তথাপি তিনি জামালপুরের অনুষ্ঠানটিকেই বেশি গুরুত্ব দেন। দিনভর অনুষ্ঠান থাকলেও সেদিন তিনি দুপুরের পর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের আর কোনো অনুষ্ঠানে যোগ না দিয়ে চলে আসেন আমাকে নিয়ে জামালপুরে যাওয়ার জন্য। পথে জানতে পারলাম তিনি দুপুরে খাওয়ারও সুযোগ পাননি। আরো পরে জানতে পারলাম আজ তাঁর/তাঁদের বিয়ে বার্ষিকী। আমি অবাক হয়ে ভাবলাম এমন দেশপ্রেমে পরিপূর্ণ মুক্তিযোদ্ধা আর কয়জন অবশিষ্ট আছেন আমাদের মাঝে! নিজের ও পরিবারের এমন গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানের দিনে সবকিছু পেছনে ফেলে কয়জন মানুষ আছেন না খেয়ে এক জেলা থেকে অন্য জেলায় যাবেন মুক্তিযুদ্ধের সন্ধানে! সেদিন তিনি এক মূল্যবান বক্তব্য দেন স্মরণ সভায়। অন্য বক্তাদের কেউ কেউ তাঁর কথাগুলিকে পরে উদ্ধৃতও করেন। অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে সকলের আন্তরিকতা দেখে আমি অভিভূত হয়ে যাই। দেখে মনে হয়েছে তাঁরা হারিয়ে যাওয়া এক অতি আপনজনকে ফিরে পেয়েছেন – আবেগে আন্দোলিত হয়েছে তাঁদের হৃদয়। আর আমি নিজের মাঝে অনুভব করেছি দায়মুক্তির এক অনাবিল প্রশান্তি।

কানাডা প্রবাসীদের বিভিন্ন রকমের অনুষ্ঠানে ভিডিও দেখতে হলে 

জামালপুরের ১৭ ডিসেম্বরের অনুষ্ঠানে আমি যাইনি। তবে সবকিছু ভালোভাবেই সম্পন্ন হয়েছে। এরই মধ্যে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় রাজাকারদের তালিকা প্রকাশ করে এবং সে তালিকায় অমার্জনীয়ভাবে বেশ কিছু খাঁটি মুক্তিযোদ্ধার নামও দেখা যায়। এর জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীরা কোনো দায়িত্ব নিতে চান না। এমনভাবে তাঁরা কথা বলেন যেন এটি কোনো ব্যাপারই নয়! ভাবি, কানাডায় এমন ঘটনা ঘটলে পরিণাম কী হতো। নিশ্চিত করে বলা যায়, পুরোদিন পার হওয়ার আগেই মন্ত্রীরা দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে সরে যেতেন। কিন্তু আমাদের দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ভিন্ন চরিত্রের। কেউ কোনো কিছুর দায়িত্ব নিতে চান না। দায়িত্ববান ব্যক্তিরা দায়িত্বের বোঝাটি এদিক ওদিক ঠেলাঠেলি করতেই পছন্দ করেন বেশি। প্রকাশিত রাজাকারের তালিকা নিয়ে যখন নানা কথা চলছে, তখনই জানা গেলো আব্দুক খালেক খসরুর নামও আছে রাজাকারদের তালিকায়। এটি দেখে আমার মাথা আর ঠিক থাকলো না। এই দুর্দান্ত মুক্তিযোদ্ধাটির সাথে আমার দুঃসময়ের কতো গুরুত্বপূর্ণ স্মৃতি! ——– চলবে।

লেখকঃ সভাপতি ভিএজি,বি

সংবাদটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

five × four =