বিশ্ব

মুখে মাস্কের কালশিটে দাগ, চোখে ক্লান্তি; তবুও লড়াই চলছে!

মুখে-মাস্কের-কালশিটে-দাগ

ইউরোপে ১০কোটি মানুষ গৃহবন্দী ।। করোনায় ইরানে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে ৭২৪ ।।তুরস্কে ২১০০ ওমরাহ যাত্রী কোয়ারেন্টাইনে, আক্রান্ত ৬ ।। করোনা যেন ‘আজরাইল’ হয়ে এসেছে বয়স্কদের জন্য! করোনার দেবদূত- মুখে মাস্কের কালশিটে দাগ, চোখে ক্লান্তি; তবুও লড়াই চলছে!

ইতালির পর স্পেনও পুরো দেশকে কোয়ারেন্টাইন করায় ইউরোপে এখন ১০কোটি মানুষ গৃহবন্দী হয়ে পড়েছেন। আগামী ৪৮ ঘন্টায় দেশটিতে বিদেশগমণ সহ ভ্রমণেও আরো কঠোর নিষেধাজ্ঞা আসছে।

বিশ্বব্যাপী ইতিমধ্যেই ১ লাখ ৫৫ হাজার মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। মারা গেছেন ৫,৮০০ জন। গত একদিনেই মারা গেছেন ৪৪০জনেরও বেশি।

ইউরোপে ইতালির পর স্পেনেই সবচেয়ে বেশি মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। স্পেনের সরকার ঘোষণা করেছে, খাদ্য ও ওষুধ কেনা এবং চিকিৎসা ও জরুরি কাজ ছাড়া আগামী ১৫ দিন সব মানুষকে নিজ ঘরেই অবস্থান করতে হবে। ইতিমধ্যেই দেশটিতে ৬,২৫১ জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন এবং মারা গেছেন ১৯৩ জন।

আর ইতালিতে ইতিমধ্যেই করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ২১ হাজার ১১৫ জন। আর মারা গেছেন ১৪,৪১ জন।

ফ্রান্সে করোনাভাইরাসে মৃত্যু হয়েছে ৯১ জনের। দেশটিতেও ক্যাফে, রেস্টুরেন্ট, সিনেমা হল এবং বেশিরভাগ দোকানপাট বন্ধ রয়েছে। বিমান, ট্রেন এবং বাস চলাচলও রবিবার থেকে কমিয়ে আনা হবে।

অস্ট্রিয়ার সরকার বলেছে, আগামী বৃহস্পতিবার থেকেই জনগণের চলাচলের স্বাধীনতা সীমিত করে আনা হবে। পাশপাশি কম প্রয়োজনীয় দোকানপাট, রেস্টুরেন্ট, বার, খেলার মাঠ এবং ক্রীড়া ভেন্যুগুলো বন্ধ করে দেওয়া হবে। ৮৮ লাখ মানুষের দেশটিতে ৮০০ জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন।

অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনা যুক্তরাজ্য, নেদারল্যান্ডস, ইউক্রেন এবং রাশিয়া থেকে কাউকে সেখানে প্রবেশ করতে দিচ্ছে না।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও শনিবার থেকে গ্রেট ব্রিটেন এবং আয়াল্যান্ড থেকে তাদের দেশে প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছে। এর আগে ইতালি সহ আরো বেশ কয়েকটি ইউরোপীয় দেশ থেকেও যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ নিষিদ্ধ করে আমেরিকা।

যুক্তরাজ্যও রবিবার থেকে খুব জরুরি দরকার ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণে না যেতে পরামর্শ দিচ্ছে।

এদিকে ইরান জানিয়েছে গত ২৪ ঘন্টায় তাদের দেশে ১১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। যা একদিনে ইরানের সর্বোচ্চ মৃত্যুর ঘটনা। ইরানে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ১৪ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। আর মৃত্যু হয়েছে ৭২৪ জনের। চীন ও ইতালির পর বিশ্বে সবচেয়ে বেশি করোনাআক্রান্ত ইরান।

সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান

করোনায় ইরানে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে ৭২৪

করোনাভাইরাসে চীনের পরে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে ইতালি ও ইরান। গত ২৪ ঘণ্টায় ইরানে আরও ১১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। এখন পর্যন্ত দেশটিতে করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা ৭২৪। আক্রান্ত হয়েছে ১৩ হাজার ৯০০ জন।  করোনার থাবায় প্রাণ গেছে ইরানের বেশ কয়েকজন শীর্ষ রাজনৈতিক ও সরকারি কর্মকর্তাও।

আজ রোববার (১৫ মার্চ) করোনা পরিস্থিতির সর্বশেষ অবস্থা নিয়ে ইরানের সরকারি কর্মকর্তাদের এক ব্রিফিংয়ে এই তথ্য জানানো হয়েছে। করোনাভাইরাসে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত দেশগুলোর মধ্যে ইরান অন্যতম।

ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হয়ে দেশটির মৃত্যুর সংখ্যা ক্রমে বাড়ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় দেশটিতে ১১৩ জন মারা গেছেন। রোববার পর্যন্ত দেশজুড়ে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭২৪ জনে।

ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, এখন পর্যন্ত ১৩ হাজার ৯০০ লোক এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। দেশের ৩১টি প্রদেশের সবকটিতেই এই সংক্রমণ দেখা গেছে।

মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে আক্রান্ত হওয়া ৯ হাজার ৭০০ কোভিড-১৯ রোগীর অধিকাংশই ইরানের। মূলত শিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশটির কারণেই অঞ্চলটিতে ভাইরাস এতটা মারাত্মক রূপ নিয়েছে।

টম হ্যাঙ্কসের সঙ্গে সেলফি তুলে করোনায় আক্রান্ত নারী

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত মার্কিন অভিনেতা ও চলচ্চিত্র পরিচালক টম হ্যাঙ্কস এবং তার স্ত্রী অভিনেত্রী রিটা উইলসন। অস্ট্রেলিয়ায় তাদের চিকিৎসা চলছে। তাদের নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনো কারণ নেই বলে জানিয়েছেন তার ছেলে চিট হ্যাঙ্কস। কিন্তু তাদের সংস্পর্শে যারা গিয়েছেন তাদের নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার অনেক কারণ রয়েছে।

টম হ্যাঙ্কসের সঙ্গে সেলফি তোলা এক নারীর শরীরে করোনাভাইরাস সনাক্ত হয়েছে। দ্য নিউজের খবরে বলা হয়েছে,কিছু দিন আগে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করা একটি ছবিতে দেখা গেছে যে হ্যাঙ্কস এবং উইলসন সিডনির একটি রেস্তোঁরায় একজন অস্ট্রেলিয়ান বিউটিশিয়ানসহ একটি গ্রুপের সঙ্গে ছবি তুলতে পোজ দিচ্ছিলেন। এবার করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন তাদেরই একজন। ফলে বাকীদের মাঝেও করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়েছে।

ওই নারীদের পুরো দল করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন না, শুধু ওই বিউটিশিয়ান আক্রান্ত হয়েছেন সেটি এখনও পরিস্কার নয়।

বিশ্বব্যাপী কাঁপন ধরিয়ে দেওয়া করোনাভাইরাস মানুষ থেকে মানুষের শরীরে খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। তাই এই দুই জনের সংস্পর্শে যারা গেছেন বা তাদের হাত দেওয়া জিনিসপত্রে যারা হাত দিয়েছেন তাদের নিয়ে ঝুঁকি রয়েছে। তারাও হতে পারেন করোনায় আক্রান্ত।

অস্ট্রেলিয়ার গোল্ড কোস্টে ছবির শুটিংয়ের সময় অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। করোনাভাইরাস আক্রান্ত হলে যা যা লক্ষণ দেখা যায়, সেগুলো প্রকাশ পেতেই দু’জনে চিকিত্সকের দ্বারস্থ হন। মেডিক্যাল পরীক্ষায় তাদের শরীরে করোনাভাইরাসের অস্তিত্ব মিলেছে।

তাদের সঙ্গে যে তারকারা ছিলেন তারা কি করোনার আক্রান্ত হওয়ার শঙ্কা মুক্ত? আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম বলছে, তাদের সঙ্গে যারা ছিলেন তারাও রয়েছেন করোনার ঝুঁকিতে। বাজ লুহরমান, রুফাস সোয়েল, অস্টিন বাটলার, অলিভিয়া ডিজেঞ্জে, ম্যাগি গিলেনহালও করোনা আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন বলে বলা হচ্ছে। কারণ  টম হ্যাঙ্কসের সংস্পর্শে ছিলেন তারাও। তারা যেকোনো সময় করোনার ভয়াল থাবার মুখে পড়তে পারেন।

তুরস্কে ২১০০ ওমরাহ যাত্রী কোয়ারেন্টাইনে, আক্রান্ত ৬

সৌদি আরব থেকে ওমরাহ পালন করে আসা ৬ জনের শরীরে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের উপস্থিতি সনাক্তের পর ২১০০ জনকে কোয়ারেন্টাইনে নিয়েছে তুরস্ক। দেশটির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ওমরাহ পালন শেষে কয়েক হাজার তীর্থযাত্রী দেশে ফিরেছেন। তাদের মাঝে ৬ জনকে করোনা পজেটিভ পাওয়া গেছে। ফলে দেশজুড়ে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হওয়ায় সৌদি ফেরত সবাইকে কোয়ারেন্টাইনে রাখা সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

রোববার (১৫ মার্চ) টেলিভিশনে সম্প্রচারিত ছবিতে দেখা গেছে যে, বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে আঙ্কারার রাস্তায় শিক্ষার্থীদের বহনকারী বাসের পাশ দিয়ে হেটে যাচ্ছেন ওমরাহ পালন করে আসা যাত্রীরা।

তুরস্ক এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাসে আক্রান্তের ঘটনা মাত্র ছয়টি। সাম্প্রতিক দিনগুলিতে এর বিস্তার ঠেকাতে, স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, দর্শকদের ছাড়াই খেলাধুলার অনুষ্ঠান পরিচালনার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এবং অনেক দেশের সঙ্গে বিমান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

এর আগে দেশটিতে একজন ব্যক্তির শরীরে করোনা শনাক্তের পর তুরস্কের সরকার সংক্রমণ রুখতে ১৬ মার্চ থেকে দেশটির সব স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় থাকবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।

তুর্কি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, আপাতত খেলাধূলা চলবে তবে মাঠে কোনও দর্শক থাকতে পারবে না। আর সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নির্দিষ্ট অনুমতির ভিত্তিতে দেশের বাইরে যেতে পারবে।

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়েপ এরদোয়ানের সভাপতিত্বে দেশটি কর্মকর্তাদের পাঁচ ঘণ্টার এক বৈঠকের পর এসব সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এরদোয়ানের মুখপাত্র ইব্রাহিম কালিন বলেছেন, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুল ১৬ মার্চ থেকে এক সপ্তাহ পর্যন্ত বন্ধ থাকবে। এর পরের সপ্তাহ একটি অনলাইন প্লাটফর্ম ও টিভির মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের পাঠদান অব্যাহত রাখবে  শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তিন সপ্তাহ বন্ধ থাকবে বলেও জানান কালিন। মঙ্গলবার তুরস্কে একজন করোনায় আক্রান্ত রোগী পাওয়ার পর এমন পদক্ষেপ নিলো দেশটির কর্তৃপক্ষ।

কালিন বলেন, ওই রোগীর অবস্থা স্থিতিশীল আছে এবং তার পরিবারের সদস্যরা সুস্থ আছেন, তবে তাদের কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, এপ্রিলের শেষ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া কোনও ফুটবল ম্যাচেই দর্শক থাকতে পারবে না। এদিকে এরদোয়ানের বিদেশ সফরও অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করা হয়েছে।

করোনা যেন ‘আজরাইল’ হয়ে এসেছে বয়স্কদের জন্য!

করোনাভাইরাসের ছোবলে এখন সবচেয়ে খারাপ অবস্থা ইতালির। পুরো ইতালি স্থবির হয়ে পড়েছে। শহরগুলো পরিণত হয়েছে ভুতুড়ে নগরীতে। পুরো দেশ যেন এক আতংকের নগরী। গৃহবন্দী হয়ে পড়েছে দেশটির সাড়ে ৬ কোটিরও বেশি মানুষ। আগামী ৩ এপ্রিল পর্যন্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মিউজিয়াম, থিয়েটার, সিনেমা, স্টেডিয়াম, কনসার্টসহ জনসমাগমের স্থানসমূহ বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।

হাসাপতালগুলো উপচে পড়ছে করোনাভাইারাসের রোগীতে। ডাক্তার সহ দেশটির চিকিৎসা পেশায় কর্মরত মানুষদের মধ্যেও করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ায় এবং আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে চলায় পরিস্থিতি আরো ভয়ানক হয়ে উঠছে।

এমন পরিস্থিতিতে জনবল ও চিকিৎসা সরঞ্জামের অভাবে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ৮০-র বেশি বয়সী রোগীদেরকে বাড়তি চিকিৎসা না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ডাক্তারদেরকে পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে যাদের বাঁচার সম্ভাবনা বেশি শুধু তাদেরকেই যেন চিকিৎসা দেওয়া হয়। ফলে বয়স্ক রোগীদের চেয়ে তরুণদেরকেই বেশি চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।

কোনো রোগীর বয়স যদি ৮০-৯৫ হয় এবং তার শ্বাসকষ্ট তীব্র আকার ধারন করে তাহলে ধরে নেওয়া হচ্ছে যে তিনি আর বাঁচবেন না। ফলে তাকে নিয়ে চিকিৎসকরা আর বেশি সময় ব্যয় করছেন না এবং তাকে আইসিইউ-তে নিয়েও চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে না।

ইতালিতে হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ-তে মোটা বিছানার সংখ্যা মাত্র ৫০৯০টি। কিন্তু বর্তমানে এর চেয়েও অনেক বেশি সংখ্যক করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীকে আইসিইউ-তে নেওয়া প্রয়োজন। দেশটিতে ইতিমধ্যেই করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ২১ হাজার ১১৫ জন। আর মারা গেছেন ১৪,৪১ জন।

তবে  প্রাইভেট ক্লিনিক, নার্সিং হোম এবং তাবুতেও আইসিইউ বেডের সংখ্যা বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। এছাড়া ডাক্তার এবং নার্সের সংখ্যা বাড়ানোরও চেষ্টা করছে সরকার।

ইতালিতে সবচেয়ে বেশি করোনা আক্রান্ত হয়েছে লম্বার্ডি অঞ্চলে। সেখানকার ডাক্তারদেরকে পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে যাদের বাঁচার সম্ভাবনা বেশি শুধু তাদেরকেই চিকিৎসা দিতে। ফলে বয়স্ক রোগীদের চেয়ে তরুণ যাদের বাঁচার সম্ভাবনা  বেশি তাদেরকেই চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।

বার্গামোর একটি হাসপাতালের একজন অ্যানেস্থেশিয়া বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক জানান, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত কোনো রোগীর বয়স যদি ৮০-৯৫ হয় এবং তার শ্বাসকষ্ট তীব্র আকার ধারন করে তাহলে ধরে নেওয়া হচ্ছে যে তিনি আর বাঁচবেন না। এবং তাকে নিয়ে চিকিৎসকরা আর বেশি সময় ব্যয় করছেন না।

লম্বার্ডির পাশের প্রদেশ পিডমন্টেও পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারন করেছে। সেখানে একদিনেই ১৮০ জন আক্রান্ত হয়েছে এবং মারা গেছে ২৭ জন।

তুরিন এলকার ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্টের একটি নথি ডেইলি টেলিগ্রাফের হাতে এসেছে। যেখানে বলা হয়েছে, আইসিইউ-র বেডের সংখ্যা যেহেতু কম সেহেতু যাদের বাঁচার সম্ভাবনা কম তাদেরকে সেখানে চিকিৎসা না দেওয়াই ভালো সিদ্ধান্ত হবে।

পিডমন্ট অঞ্চলের নাগরিক নিরাপত্তা বিভাগের তৈরিকৃত নথিতে বলা হয়েছে, ‘নিবীড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ-তে)  ৮০ বছর বা এর বেশি বয়সী কাউকে চিকিৎসা দেওয়া হবে না। এবং যাদের করোনা ভাইরাসের পাশাপাশি আরো ৫টি বা এর বেশি স্বাস্থ্যগত সমস্যা আছে তাদেরকেও আইসিইউ-তে নেওয়া হবে না।’ এর পাশাপাশি কোনো রোগীর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা না থাকলে তাকেও আইসিইউ-তে চিকিৎসা দেওয়া হবে না।

এক ডাক্তার বলেন, যুদ্ধের সময় যেভাবে বয়স এবং বাঁচার সম্ভাবনা অনুযায়ী অসুস্থদের চিকিৎসা দেওয়া হয় এখন সেই নিয়মই অনুসরণ করা হচ্ছে।

পুরো ইতালিজুড়েই এই নিয়ম বাস্তবায়ন করা হবে বলে জানা গেছে।

সূত্র: ডেইলি টেলিগ্রাফ

করোনার দেবদূত

মুখে মাস্কের কালশিটে দাগ, চোখে ক্লান্তি; তবুও লড়াই চলছে!

মুখে মাস্কের কালশিটে দাগ, চোখে ক্লান্তি; তবুও লড়াই চলছে!

করোনার ছোবলে এখন সবচেয়ে খারাপ অবস্থা ইতালির। চীনের চেয়েও ভয়াবহ অবস্থা সেখানে। শহরগুলো পরিণত হয়েছে ভুতুড়ে নগরীতে। গৃহবন্দী হয়ে পড়েছে দেশটির সাড়ে ৬ কোটিরও বেশি মানুষ। হাসাপতালগুলো উপচে পড়ছে করোনা রোগীতে। ডাক্তার-নার্সসহ দেশটির চিকিৎসা পেশায় কর্মরত মানুষেরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাতদিন সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। আক্রান্তের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে চলায় হিমশিম খাচ্ছেন তারা।

দিন কয়েক আগেই ঝকঝকে একটি ছবি পোস্ট মিলানের একটি হাসপাতালের সুন্দরী নার্স অ্যালেসিয়া বোনারি। কোথাও হয়তো ঘুরতে গেছিলেন, খাচ্ছিলেন পছন্দের কোনও খাবার। চোখে-মুখে অদ্ভুত এক ঝকঝকে, শান্ত মাধুর্য। ইনস্টাগ্রামে নিজে সেই ছবিটি পোস্ট করে অসংখ্য প্রতিক্রিয়াও পেয়েছিলেন তরুণী নার্স। কে জানত, মাত্র কয়েক দিনেই আমূল বদলে যাবে তার জীবন! এতটাই সে বদল, যা কালশিটের মতো দগদগে ছাপ এঁকেছে অ্যালেসিয়ার মুখের সুন্দর চামড়ার উপরেও!

গত কয়েক সপ্তাহে মারণ করোনাভাইরাসের প্রকোপে তোলপাড় হয়ে গিয়েছে ইতালি। মাত্র কয়েক দিনে মৃতের সংখ্যা ছুঁয়েছে প্রায় ১৩০০। আক্রান্ত প্রায় ২০ হাজার। হঠাৎ এমন পরিস্থিতি তৈরি হওয়ায় রীতিমতো দিশেহারা সে দেশের চিকিৎসক ও নার্সরা। রাতারাতি ২৪ ঘণ্টার জন্য মোতায়েন হয়ে গেছেন তাঁরা হাসপাতালগুলিতে। হু হু করে রোগী আসছে, পরীক্ষা করে ধরা পড়ছে করোনাভাইরাস পজ়িটিভ। চিকিৎসা সেবা দিতে দিতে হাঁফ ফেলার সময়ও নেই তাঁদের। সেই সঙ্গে নিজেও সংক্রামিত হতে পারেন, এই মানসিক চাপ তো সর্বক্ষণ রয়েছেই।

কয়েক দিন আগে কাজের ফাঁকে কয়েক মুহূর্তের জন্য ফেস মাস্কটা মুখ থেকে নামিয়ে একটি সেলফি তুলে ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করেন অ্যালেসিয়া। মাস্ক পরে থেকে থেকে দাগ বসে গেছে মুখের চামড়ায়। চোখে অপরিসীম শ্রান্তি। ক্লান্ত চেহারায় ছাপ ফেলেছে একটানা পরিশ্রম। হবে না-ই বা কেন। করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে লড়ছেন তাঁরা। এই মুহূর্তে গোটা পৃথিবীর স্বাস্থ্য সেবায তাঁদের ভূমিকা ঈশ্বরসম। কিন্তু অনেকেই হয়তো জানেন না, তাঁদের লড়াইটা ঠিক কতটা! অ্যালেসিয়ার ছবিটি যেন সেই উত্তরই দিয়ে দিচ্ছে। ছবিটা বলছে, করোনাভাইরাসের আক্রমণে হওয়া কোভিড-১৯ মহামারির বিরুদ্ধে লড়তে লড়তে তাঁরা শারীরিক ও মানসিক ভাবে বিধ্বস্ত। মন ভেঙে যাচ্ছে তাঁদের। তবু একটা বারের জন্যও নিজেকে বিশ্রাম দেওয়া যাচ্ছে না পেশাদারি দায়বদ্ধতার স্বার্থে।

অ্যালেসিয়া ছবিটির সঙ্গে লেখেন, ‘আমি একজন নার্স। আমি এই মুহূর্তে হেল্থ এমার্জেন্সির একজন সৈনিক। আমি ভয় পাচ্ছি। আমি আমার কাজে ভয় পাচ্ছি, কাজের বাইরে কোথাও যেতে ভয় পাচ্ছি। আমি ভয় পাচ্ছি, হয়তো আমার মাস্কটা আমার মুখকে ভালভাবে ঢাকতে পারেনি, কিংবা হয়তো আমি নিজের অজান্তেই নিজেকে স্পর্শ করে ফেলব নিজের ময়লা গ্লাভস দিয়ে। হয়তো আমার চোখের লেন্সের ফাঁক দিয়ে কিছু ঢুকে গেল। আমি শুধু ভীত নই, আমি ভয়াবহ ক্লান্ত। টানা ছ’ঘণ্টা বা তারও বেশি সময় আমি না পারি এক ফোটা পানি খেতে, না পারি টয়লেটে যেতে। আমি একা নই, আমার সমস্ত সহকর্মীরও এই অবস্থা। কিন্তু এতে আমরা কাজ থামাতে পারব না। কারণ দিনের শেষে আমি আমার পেশা নিয়ে গর্বিত। এই পোস্ট যদি কেউ পড়েন, আমি তাঁকে অনুরোধ করব, নিঃস্বার্থ ভাবে কোনও কিছু চেষ্টা করলে, দয়া করে হতাশ হবেন না। আর এমনও হতে পারে, আমি নিজে করোনাভাইরাসে অসুস্থ হয়ে পড়লাম বা আমার কারণে অন্য কেউ সংক্রামিত হল। কিন্তু কী করব, আমি তো নিজেকে কোয়ারেন্টাইন করে রাখতে পারব না! আমায় তো কাজটা করতেই হবে। এই সবটুকুই আপনাদেরই জন্য।’

চীনের পরে ইতালিতেই করোনাভাইরাসের ছোবল সবচেয়ে গুরুতর। মাত্র কয়েক সপ্তাহে যেন মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে দেশটি। করোনাভাইরাসের সংক্রমণে প্রতিদিন সেখানে আক্রান্তের সংখ্যা গড়ে একশো জন করে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার  মতে, এই পরিসংখ্যান চীনের থেকেও বেশি মারাত্মক পরিস্থিতি তৈরি করতে চলেছে। এমনই দ্রুততায় করোনা ছড়াচ্ছে, যে সামাল দেওয়াই কার্যত অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এই অবস্থায় অ্যালেসিয়ার এই পোস্টটি দ্রুত ভাইরাল হয়ে যায় অনলাইনে। প্রশংসা, অভিনন্দন, কুর্নিশে ভরিয়ে দেন সকলে। একবাক্যে সতলেই স্বীকার করেন, এই পরিস্থিতিতে চিকিৎসক, নার্স ও চিকিৎসাকর্মীরা যেন দেবদূতের মতোই কাজ করছেন ইতালিতে। নিজদের প্রাণ বিপন্ন করছেন তাঁরা। তাঁদের এই স্বার্থত্যাগ ছাড়া আরও কত খারাপ হতো পরিস্থিতি, তা যেন কল্পনাও করা যায় না।

সংবাদটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

18 − eleven =