মুক্তিযুদ্ধ

স্বাধীনতাত্তোর আমার শৈশবের দিনগুলি- ৪ | সুশীল কুমার পোদ্দার

স্বাধীনতাত্তোর-আমার-শৈশবের-দিনগুলি-৪

স্বাধীনতাত্তোর আমার শৈশবের দিনগুলি- ৪ | সুশীল কুমার পোদ্দার


পূর্ব প্রকাশের পর…

আমাদের সিরাজগঞ্জ শহরটা জীবন জীবিকার উপর নির্ভর করে এক একটা পট্টিতে বিন্যস্ত। খলিফা পট্টি, বানিয়া পট্টি, মনোহারী পট্টি, ফড়িয়া পট্টি, গাড়োয়ান পট্টি এমনি কতো নাম। আজ অনেক নামই অতীত ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে। আমাদের মাড়োয়ারি পট্টিও এমনি এক অতীতের ইতিহাস। শুনেছি একসময় সাধারণ মানুষের এই জনপদ দিয়ে জুতো পড়ে হেটে যাওয়া ছিল নিষিদ্ধ, ছাতা মাথায় দেওয়া ছিল গুরুতর অপরাধ। আজ জীবন জীবিকার পরিবর্তনে পট্টিগুলো শুধুমাত্র নামের তকমা বহন করছে।

আমাদের পট্টির মোড়ে একটি অর্ধ জীর্ণ লন্ডী। নাম তার বিন্দুবাসিনী। তার গা ঘেঁষে ছোট্ট এক চায়ের স্টল। সেখানে পাওয়া যেতো এক আনায় প্রায় অর্ধ ডজন টোপা বিস্কুট। অদূরে রাস্তার ধারে এক চর্মসার চর্মকার মাথা নিচু করে জুতো সেলাই করে যেতো। ধারালো বাটালী দিয়ে টায়ার কেটে সে হরেক রকম জুতো বানাতো। বাবার সাথে তার ছিল অত্যন্ত সখ্যতা। তাই আমিও তার স্নেহের পাত্র ছিলাম। সময় পেলেই ওকে টায়ারের মাঝে লুকিয়ে থাকা অত্যন্ত মজবুত একধরনের সুতো বেড় করে আনতে সাহায্য করতেম। ও মোম দিয়ে সেই সুতো একটা লাঠিতে জড়িয়ে রাখতো। বিনিময়ে ও আমাকে শিখিয়েছিল কেমন করে ভোমরা দিয়ে জুতো সেলাই করতে হয়। জীবনে কোন শিক্ষায় বৃথা যায় না। আজও সে শিক্ষা কাজে লাগে বিচিত্র গৃহস্থালি কাজে।

তখনকার দিনে মানুষের তেমন কাজ ছিল না। তাই ছিল শুধু অহেতুক কৌতূহল বোধ। ছোট্ট কোন ঘটনার একটু ধুয়ো কিম্বা একটু গন্ধ পেলেই ভিড় করে দাড়িয়ে থাকতো। সেদিন রাস্তার ধার ঘেঁষে মাটি খনন করছে একদল শ্রমিক। সেটি ঘিরেই এক বিরাট জটলা।আমরা ছোটোরা সেই ভিড়ে শ্রমিকদের গা ঘেঁষে দাড়িয়ে দাড়িয়ে সেই মাটি খনন দেখি নিবিষ্ট চিত্তে। আমাদের বাড়তি আকর্ষণ হলো ঐ মাটির তল থেকো উঠে আসা গুলি, গুলির খোসা, এমনি কিছু যুদ্ধ মহার্ঘ্য। একটা গুলি উঠে আসলেই আমরা পড়িমরি করে কে কার আগে নেব এ নিয়ে রীতিমতো কলহ বাধিয়ে ফেলি। এমনি এক খেলায় মগ্ন হয়ে হঠাৎ করে আমরা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ি। মাটির তল থেকে উঠে আসে কিছু হাড়গোড় সাথে একটা বেল্ট। হঠাৎ নেমে আসে এক সুমসাম নীরবতা।অতঃপর মানুষের মাঝে মৃদু গুঞ্জন। বেল্ট দেখে একজন বলে ওঠে ওটা নিলুয়া বুড়ো ( অনেক বছরের ব্যবধানে নামটা নিয়ে দ্বিধান্বিত )। মুহূর্তে আমি নিলুয়া বুড়োকে চোখের সামনে দেখতে পাই।আমি ফিরে যাই যুদ্ধ পূর্ববর্তী সময়ে- আমার বাল্যকালে।

জুবিলী গার্ডেন লেন। আহামরি এক নাম। এখানেই আমার জন্ম। এক ভাড়া বাড়ী। বাড়ীর গা ঘেঁসে বিরাট এক বিহারী পল্লী। বিহারী পল্লীর বাইরের এক ভগ্ন চেয়ারে বসে থাকতো এই বুড়ো। সে ছিল দাদুর মতো। অদূরে টিউবওয়েলের পাশে বিহারী মাতারা তাদের কোলের শিশু দের কলের পাড়ে জমে থাকা পলিমাটি দিয়ে সাড়া শরীর দলাই মলাই করে রৌদ্রে ফেলে রাখতো। নিলুয়া বুড়ো ওদের দেখ ভাল করতো। আমরা সমবয়সীরা শীতকালে রৌদ্রে দাড়িয়ে কালো পিপড়া, লাল পিপড়ার খেলা খেলতাম। যদিও সে খেলার মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার গন্ধ ছিল। কিন্তু আমরা তা কক্ষণও বুঝিনি। আমরা পাশাপাশি আত্মীয়ের মতো একসাথে বেড়ে উঠেছি। আমার দিদির বয়সী এক পরীর মতো আপা ছিল। ভীষণ স্নেহ করতো। ঐ হাড় গোড়ের দিকে তাকিয়ে সব কথা মনে পড়ে। দেশ স্বাধীন হবার পর মার সাথে একবার গিয়েছিলেম সেই পল্লীতে। কেঊ নেই, কিছু নেই। যুদ্ধের সময় ওদের কি ভূমিকা ছিল আমার জানা নেই। তবে শুনেছি পাশাপাশী বাস করা আমরাই চরম প্রতিশোধের স্পৃহা থেকে ওদের কারোকে বাচতে দেইনি। কিছু অপরাধীর সাথে সাথে অনেক নিরীহ মানুষকেও দিতে হয়েছে প্রাণ। তাই ভাবি – একটা যুদ্ধ শুধু যে বিজয় এনে দেয় তাই নয়, সাথে বহন করে বর্বরতার স্মৃতি, বিপন্ন মানবতার করুণ আর্তনাদ।

লেখকের স্মৃতিচারণের অন্যান্য পর্বগুলি দেখতে হলে 

যুদ্ধের স্মৃতি কথা ১ | সুশীল কুমার পোদ্দার
যুদ্ধের স্মৃতি কথা ২ | সুশীল কুমার পোদ্দার
যুদ্ধের স্মৃতি কথা ৩ | সুশীল কুমার পোদ্দার
যুদ্ধের স্মৃতি কথা ৪ | সুশীল কুমার পোদ্দার
যুদ্ধের স্মৃতি কথা ৫ | সুশীল কুমার পোদ্দার
যুদ্ধের স্মৃতি কথা ৬ | সুশীল কুমার পোদ্দার
যুদ্ধের স্মৃতি কথা ৭ | সুশীল কুমার পোদ্দার
যুদ্ধের স্মৃতি কথা ৮ | সুশীল কুমার পোদ্দার
যুদ্ধের স্মৃতি কথা ৯ | সুশীল কুমার পোদ্দার
স্বাধীনতাত্তোর আমার শৈশবের দিনগুলি- ১ | সুশীল কুমার পোদ্দার
স্বাধীনতাত্তোর আমার শৈশবের দিনগুলি- ২ | সুশীল কুমার পোদ্দার
স্বাধীনতাত্তোর আমার শৈশবের দিনগুলি- ৩ | সুশীল কুমার পোদ্দার

সর্বশেষ সংবাদ

দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com

সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

 

সংবাদটি শেয়ার করুন