মুক্তিযুদ্ধ

যুদ্ধের স্মৃতি কথা ২ | সুশীল কুমার পোদ্দার

যুদ্ধের স্মৃতি কথা

পূর্ব প্রকাশের পরধা রা বা হি ক 

যুদ্ধের স্মৃতি কথা ২ | সুশীল কুমার পোদ্দার

ধবলীকে অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ওর মালিকের হাতে তুলে দেওয়া হলো। ওর জন্য কষ্টবোধ সময়ের সাথে সাথে লঘু হয়ে আসে। ওর শূন্যতা নতুন নতুন উদ্বেগ, নতুন নতুন অনিশ্চয়তায় পূর্ণ হয়ে যায়।

প্রতিটা দিন যায় একটা অস্থির উৎকণ্ঠার মধ্য দিয়ে। রাত গুলো আসে আরো বেশি দীর্ঘ হয়ে। রাজাকারদের তৎপরতার সাথে সাথে যোগ হয় ডাকাতের উপদ্রব । বাবা, দাদা সহ আরো অনেক বড়রা মিলে রাত জেগে পাহারা দেন। নিত্য দিন শহর থেকে পাক বাহিনীর নির্যাতন, হত্যা, অগ্নিসংযোগের খবর আসে। আমি নীরবে দাড়িয়ে দাড়িয়ে সেসব শুনে মাকে এসে মুখস্থ বলি। একদিন খবর আসে আমাদের প্রতিবেশী দন্ত চিকিৎসক ভবেশ কাকু ( ভবতোষ প্রামাণিক ?) ও ওনার বড় ছেলেকে নাকি পাক সেনারা মেরে ফেলেছে। ডাক্তার কাকু আমায় খুব স্নেহ করতেন। আমি ওনার পাশে বসে চোখ ভরা বিস্ময় নিয়ে দাঁত বানানো দেখতাম। শুনে সবাই ব্যথিত হলেন। আস্তে আস্তে একটা ভয়াবহ আতংক আমাদের আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে। আগের মতো আর ঘুরে বেড়ানো হয় না। বাড়ীর উঠোনে অথবা ছাদের ‘পর মিলিটারি মিলিটারি খেলে পার করে দেই অলস মধ্যাহ্ন ও অপরাহ্ণের একঘেয়ে সময়গুলো।

রাত হলে কাচারি ঘরে অনেক লোকের সমাগম হয়। কর্মহীন হতাশাগ্রস্ত মানুষগুলো রেডিওকে ঘিরে কানপেতে বসে থাকে একটা আশা জাগানিয়া খবরের প্রতীক্ষায়। মা বাবার জন্য পান বানিয়ে রাখেন। বাবা পান চিবুতে চিবুতে ক্ষণিকের তরে তার উদ্বেগ হতাশা ঝেরে ফেলে বলে যান রেডিওয়ে শুনা বিভিন্ন জায়গায় প্রতিরোধ গড়ে উঠার কথা। মাকে বলেন ইন্ডিয়া যেতে মন চায় না। দেখি না আর কটা দিন। মা মাথা নাড়িয়ে সন্মতি দেন।

সেদিনটা অন্যদিনের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা। দলে দলে কাকেরা কেন জানি রড় বেশি কা-কা করছে। আকাশ থেকে ঝরে পড়ছে সাদাকালো পোড়া কাগজ। বাতাসে চোখ জ্বালা করা মরিচের গন্ধ। বাবা, দাদা শশব্যস্ত হয়ে ঘর বার করছেন। আমাদের ঘরের বাহির হতে মানা। আমরা চুপিসারে দাঁড়ালাম ছাদে। অনতিদূরে কোন এক গ্রাম থেকে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে উঠছে কালো ধুয়ো। বাবা চিৎকার করে বললেন বাগবাটি গ্রামে পাকসেনা এসেছে। ওরা নির্বিচারে অজস্র মানুষকে গুলি করে মেরেছে। বাড়ির পর বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে। সিরাজগঞ্জ থেকে যতো হিন্দু ওখানে আশ্রয় নিয়েছিল সবাইকেই নাকি মেরে ফেলেছে। মা কান্নাবিজরীত কণ্ঠে বললেন আমার দাদা, আমার নিতাইদা, দাদার পরিবার ওদের, ওদের খবর কি? দিদিমা ছেলের জন্য আহাজারি করছেন। আমরা ভাই বোন নিথর হয়ে দাড়িয়ে আছি। মনে মনে প্রার্থনা করছি আমাদের সদা হাস্যময় মামাটা যেন দৈব ক্রমে বেচে যান। বড়দা জেদ ধরলেন যে করেই হোক মামার পরিবারের খোজ নিতে হবে। সবার নিষেধ উপেক্ষা করে তিনি ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন ত্রস্ত গতিতে। বলে গেলেন খুব তাড়াতাড়ি ফিরবেন।

চারিদিকে রটনা রটে গেল মিলিটারি নাকি এ গ্রামের দিকে এগিয়ে আসছে। আশে পাশের কিছু ভিন্ন প্রকৃতির মানুষ হঠাৎ করে খুব দরদী হয়ে উঠলো। ওরা ব্যস্ত হয়ে জমিদার বাবুকে বুঝাতে শুরু করলো বাবু এখনো সময় আছে তাড়াতাড়ি পালিয়ে যান। বাড়ী ঘরের জন্য ভাববেন না। আমরা দেখবো। চারিদিকে অবিশ্বাস। ওদের অযাচিত উপদেশ শুনে উনি আভিজাত্যের খোলস থেকে বেড় হলেন একজন হত বিহ্বল, ভীত সন্ত্রস্ত, অতিসাধারণ মানুষ হোয়ে । স্বল্পভাষী মানুষটা এই প্রথম বাবার সাথে অনেক কথা বললেন। অনেক পরামর্শ করলেন।

পালানোর সব প্রস্তুতি শেষ। অজস্র উদ্বেগের মধ্যে দাদার জন্যে অস্থির অপেক্ষা। দাদা এখনো আসছে না কেন! আমার বড়দাকে আমি যে অনেক ভালবাসি। আমি চোখ বুজে দাদার জন্য অনন্ত ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি। সবাই বলছে আর দেরী করা ঠিক হবে না। অগত্যা দাদাকে ছাড়াই আমরা বেড় হোয়ে পড়ি। আমাদের প্রত্যেকের কাঁধে, হাতে, মাথায় পুঁটলি। ক্ষেতের আল ধরে এগিয়ে চলছি বিশাল এক কারাভানের সাথে -অনির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে । দাদার জন্য সবাই দুশ্চিন্তায় ছট ফট করছে। আমি বার বার ফিরে ফিরে দেখি দাদা ফিরে এসেছে কিনা …

চলবে…

যুদ্ধের স্মৃতি কথা ২ | সুশীল কুমার পোদ্দার ,  ওয়াটারলু, কানাডা নিবাসী ।  ফলিত পদার্থ বিদ্যা ও ইলেকট্রনিক্স,  মাস্টার্স,  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় , বাংলাদেশ ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স,   ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, পি, এইচ, ডি,   ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। সিস্টেম ডিজাইন ইঞ্জিনিয়ারিং, ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স,  ওয়াটারলু, বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডা ।।

 

 

এসএস/সিএ

সর্বশেষ সংবাদ

দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com

সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

সংবাদটি শেয়ার করুন