লেখালেখি

হেফাজত অনুসারী আওয়ামী নেতাদের চিহ্নিত করার বিকল্প নেই!!

হেফাজত-অনুসারী-আওয়ামী-নেতা

হেফাজত অনুসারী আওয়ামী নেতাদের চিহ্নিত করার বিকল্প নেই!!

|| মোঃ মাহমুদ হাসান || গেল বছর ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকেই আমার শুভাকাঙ্ক্ষী আপনজনেরা আমাকে নিয়ে শংকিত। কেউ বলে, ‘তোমার লিখার হাত ভালো, ভিন্ন বিষয় বেঁচে নাও’। কেউ বলে, ‘ওরা ভয়ংকর; ওদের নিয়ে লিখো না’। পরমাত্মীয় কেউ কেউ বললেন ‘হুজুর ইসলামের মডেল; উনাকে নিয়ে লিখলে পরম করুণাময় অসন্তুষ্ট হবেন’। কেউ বলে, ‘কুষ্টিয়ায় ভাস্কর্য ভেঙেছে, তাতে তোমার কি?’ কোন কোন বন্ধু শুভানুধ্যায়ী আবার আমার কাছ থেকে নিরাপদ দুরত্বে সরে গেলেন। ডিজিটাল সুবিধা ব্যবহার করে কেউ কেউ আবার হুমকি ধামকি ও দিলেন। আমার অপরাধ কি ছিল জানেন? মামুনুল হক যখন জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভেঙে বুড়িগঙ্গায় ভাসিয়ে দেয়ার ঘোষণা দিলেন, তখন আমি ইত্তেফাক সহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর আস্ফালনের বিরুদ্ধে কলাম লিখেছিলাম। দেশ বিরোধী আনুগত্যহীন তৃতীয় পক্ষের এজেন্ডা বাস্তবায়নকারী মামুনুল হকের হুংকার বন্ধে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে কলম ধরেছিলাম।

সামপ্রদায়িক অপশক্তি কুষ্টিয়ায় জাতির জনকের ভাস্কর্য ভেঙে ফেললে, সমমনাদের নিয়ে সাংবাদিক সম্মেলন করে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলাম।

আমাকে নিয়ে যারা উদ্বেগ উৎকন্ঠা প্রকাশ করেছিলেন তাদের প্রতি আমার শ্রদ্ধাবোধ, বিনয়, কোন কোন ক্ষেত্রে কিছুটা ক্ষোভ কাজ করলেও মোটেও বিস্ময়ে অবাক হইনি। অবাক বিস্ময়ে বিমুঢ় হয়েছি তখনি, যখন ঢাকার মেয়র ফজলে নুর তাপস আর হাতে গোনা ক’জন আওয়ামী লীগ নেতা ছাড়া সবাই কে নীরব দেখেছি। যখন কোন এক আওয়ামী লীগ নেতা ফোন করে বলেছিলেন “আল্লামা মামুনুল হুজুর তো তোমার কোন ক্ষতি করেননি, উনাকে নিয়ে না লিখলেই খুশি হবো” তখনই আতংকিত হয়েছি। এ আতঙ্ক আমার কোন ব্যক্তি জীবনের শংকা নয়। এ শংকা ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তের উত্তরাধিকার বাংলাদেশ নিয়ে শংকা, এ শংকা জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর আদর্শ অস্তমিত হওয়ার শংকা। এ শংকা বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে থামিয়ে দেয়ার শংকা। অসাম্প্রদায়িক সুখী সমৃদ্ধ সোনার বাংলার পথে দ্রুতগতিতে ধাবমান প্রিয় দেশটিকে গুড়িয়ে দেয়ার সুদুরপ্রসারি পরিকল্পনা নিয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত হওয়ার শংকা।

স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মোদীর বাংলাদেশ আগমন মোটেও অপ্রত্যাশিত কোন বিষয় ছিল না। এটি তাঁর বাংলাদেশে প্রথম সফর ও নয়। তাহলে হেফাজতের নেতৃত্বে উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী হামলার নেপথ্যে কি ছিল? হঠাৎ করেই কি এমন ঘটনা ঘটেছে? ব্রাহ্মণবাড়িয়া, হাটহাজারী সহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে হেফাজতি তান্ডব মোকাবেলায় আওয়ামী লীগ ব্যর্থ হলো কেন?

অপরাজনীতিকে রাজনীতি দিয়ে মোকাবিলা করতে হয়। পুলিশি একশন সাময়িক উত্তেজনাকে প্রশমিত করলেও,এর দীর্ঘস্থায়ী ক্ষত ক্যান্সারের রুপ ধারন করলে আর নিরাময়ের কোন উপায় থাকে না। ২০১৩ সালের পর থেকেই হেফাজত সুদুরপ্রসারি লক্ষ্য নিয়েই এগুতে থাকে। জামাতি আর আওয়ামী বিরোধী শক্তির সমন্বয়ে তারা দ্রুত শক্তি সঞ্চয় করে। খেলাফত, শরিয়ত আর ইসলামের নাম ব্যবহার করে শেখ হাসিনার কর্মকান্ড ইসলাম বিরোধী সেটি প্রমাণ করতে সারাদেশে ওয়াজ মাহফিলের নামে লক্ষ লক্ষ মানুষের জমায়েতে সভা সমাবেশ চলতে থাকে। আর এসব সমাবেশে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের বিশেষ অতিথি হিসেবে অংশ নিতে দেখা যায়। অনেক আওয়ামী লীগ নেতা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এসব সভা সমাবেশের পৃষ্ঠপোষক হয়ে উঠেন। সুচতুর সামপ্রদায়িক গোষ্ঠী লক্ষ লোকের সমাবেশে একদিকে শেখ হাসিনা কে জননেত্রী বলে সম্ভোধন করেন অন্যদিকে কুরআন হাদিসের অপব্যাখ্যা করে সরকার ও তার সকল কর্মকান্ড কে ইসলাম বিরোধী আখ্যায়িত করে ‘টেনেহিঁচড়ে’ নামিয়ে ফেলার ঘোষণা দেন। আর এসব সমাবেশে মামুনল হকদের পাশে বসা আওয়ামী লীগ নেতারা তা হজম করেন। বিগত কয়েক বছর এভাবেই সামপ্রদায়িক অপশক্তি মাঠে ঘাটে জনতাকে সংঘটিত করতে থাকে। ২৬ মার্চ পরবর্তীতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জে আওয়ামী দৈন্যদশার দিকে তাকালে এই অপশক্তির সফলতা সম্পর্কে আর কোন সংশয় থাকার কথা নয়।

মামুনুল হকের বক্তব্য কে কেন্দ্র করে সুনামগঞ্জের শাল্লায় ক্ষুব্ধ ঝুমন দাশ নাকি মামুনুল হক কে নিয়ে কটুক্তি করেছিলেন!! পরিস্থিতি বিবেচনায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের চাপে গ্রামবাসী নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে ঝুমন দাশকে আইনের হাতে সোপর্দ করেছিল। পুলিশ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে তার বিরুদ্ধে মামলা ও করেছিল। তার বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে জানা না থাকলেও, আজকের পরিস্থিতিতে এটি সন্দেহাতীত ভাবে প্রতীয়মান ঝুমন দাশ দেশ বিরোধী আনুগত্যহীন একজন লেবাসধারী উগ্র সাম্প্রদায়িক ব্যক্তির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে কোন অন্যায় করেন নি।

শাল্লার ন্যাক্কারজনক সাম্প্রদায়িক হামলার পর একাত্তর টিভিতে সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগ নেতা ও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নুরুল হুদা মুকুট স্পষ্ট করেই তথ্য প্রমান দিয়ে বলেছিলেন, উপজেলা চেয়ারম্যান, পৌরসভা চেয়ারম্যান সহ আওয়ামী লীগের উপজেলা পর্যায়ের দায়িত্ব প্রাপ্ত নেতাদের প্রত্যক্ষ সহযোগীতায় মামুনুল হক দিরাইয়ের জনসভায় আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। মামুনুল হক কে নিয়ে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের অতি আগ্রহী আওয়ামী নেতাদের খুঁজে বের করা সময়ের ই দাবী। আমাদের দেশের চৌকস গোয়েন্দা বাহিনী চাইলেই মামুনুল হক সহ এই সামপ্রদায়িক অপশক্তিকে পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া আওয়ামী নেতাদের চিহ্নিত করা মোটেও অসাধ্য কোন বিষয় নয়।

বাংলাদেশের মানুষ ধর্মপ্রাণ। ওলি, আওলীয়া, গাউস,কুতুব আর পীর মশায়েখদের উত্তরাধিকারের এই ভূখন্ডে ইসলামের শান্তিপ্রিয় রুপটিই শাশ্বত সত্য। কিন্তু কিছু অতি উৎসাহী ৭১ এর পরাজিত শক্তির দোসর তালেবানী কায়দায় ধর্ম কে ব্যবহার করে এই বাংলাকে অশান্ত করেই পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। যদি তাই না হতো, তবে শেখ হাসিনার সরকারের প্রতি তাদের এতো গাত্র দাহ হবে কেন? শেখ হাসিনা কওমী মাদ্রাসাকে স্বীকৃতি দিয়ে যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিলেন, আট হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে সারা দেশের প্রতিটি উপজেলায় মডেল মসজিদ সহ ইসলামী সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নির্মাণ করছেন, যুগোপযোগী কারিকুলাম নিয়ে ১৮০০ আধুনিক মাদ্রাসা নির্মান প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন। ইসলামের সেবায় উন্নয়নের এমন দৃষ্টান্ত তো সারা মুসলিম বিশ্বেই বিরল। তবুও এতো বিদ্রোহ কেন? ৭২-৭৫ সময়কালে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের নামে অতি বিপ্লবী গোষ্ঠী জাসদ-গনবাহিনী গঠন করে গুম, খুন লুঠতরাজের মাধ্যমে যেভাবে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী বঙ্গবন্ধু কে হত্যার ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিল হেফাজত-খেলাফত কে সামনে রেখে উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী এভাবেই আর একটি বিয়োগান্তক ইতিহাসের ই পুনরাবৃত্তি ঘটাতে চায়।

প্রশাসনের বর্তমান দৃশ্যমান ভুমিকা হয়তো পরিস্থিতি উত্তরণে সাময়িক সহায়ক হবে কিন্তু স্থায়ী সমাধানে রাজনৈতিক উদ্যোগের বিকল্প নেই। ইসলামের কল্যাণে শেখ হাসিনার গৃহীত পদক্ষেপসমুহকে জাতির সামনে তুলে ধরা যেমন জরুরী, তেমনি উন্নয়ন আর সমৃদ্ধ বাংলাদেশের জন্য অসাম্প্রদায়িক সমাজব্যবস্থার সুফলকেও সমভাবে ছড়িয়ে দিতে হবে। অনেকেই বলেন, শেখ হাসিনা নাকি নীলকন্ঠী, বিষ খেয়ে বিষ হজম করতে পারেন। যখন কোন দৈত্য রুপী সামপ্রদায়িক দানব জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য গুঁড়িয়ে বুড়িগঙ্গায় ফেলে দেয়ার কথা বলেন, হাঠে ঘাটে লাখ লাখ লোকের সমাবেশ ঘটিয়ে শেখ হাসিনা কে ইসলামের শত্রু বানাতে মরিয়া হয়ে উঠেন আর সেই সব সমাবেশ আয়োজনে প্রকাশ্যেই কোন কোন আওয়ামী লীগ নেতা ভূমিকা রাখেন তখন কোন বিবেচনায় সেই সব নেতাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অনুসারী বলবেন? ধৈর্য, সহনশীলতা আর মহানুভবতার শ্রেষ্ঠত্বে অনেকেই হয়তো শেখ হাসিনা কে নীল কন্ঠী বলেন, কিন্তু যে বিষ শেখ হাসিনার জীবনকে বিপন্ন করতে পারে, যে বিষ হজম করলে রক্তে অর্জিত স্বাধীনতা প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে, যে বিষ জাতীয় স্থিতিশীলতাকে বিপন্ন করে উন্নয়ন অগ্রগতিকে থামিয়ে দিতে পারে সেই হেমলক পান করা কি কোনভাবেই বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক হবে?

মামুনুল হক ফেসবুক লাইভে এসে বলেছিলেন, “আমি যদি মিথ্যে বলে থাকি, তাহলে আমার উপর আল্লাহর গজব বর্ষিত হবে—“। মহান সৃষ্টিকর্তা হয়তো সংগে সংগেই তা কবুল করেছেন। তাই তার নিজের বক্তব্যেই আজ প্রমানিত হয়েছে, আশ্রিতা দুই নারী তার বৈধ স্ত্রী ছিল না। শরিয়ত মারিফতের প্যাচে এগুলো ছিল লিভ টুগেদার এর এক আধুনিক খেলাফতি সংস্করণ। সেই নামধারী ভন্ডদের সহযোগিতা দিয়ে যেসব আওয়ামী নেতারা ভুমিকা রেখেছেন, তারা আওয়ামী লীগে লুকিয়ে থাকা হ্যামলক। সেই হ্যামলক হজম করার কোন উপায় নেই বরং এর ক্রমাগত বিষক্রিয়া একদিন আমাদের জাতীয় অস্তিত্বকেই বিষিয়ে তুলবে। তাই আওয়ামী লীগে লুকিয়ে থাকা হেফাজতীদের চিহ্নিত করে ডাষ্টবিনে নিক্ষিপ্ত করার এখনি শ্রেষ্ঠ সময়।

লেখক ঃ কলামিস্ট, উন্নয়ন গবেষক ও সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষক, কানাডা


 

সর্বশেষ সংবাদ

দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com

সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

আমাদের ফেসবুক পেজ   https://www.facebook.com/deshdiganta.cbna24 লাইক দিন এবং অভিমত জানান

সংবাদটি শেয়ার করুন