ফিচার্ড লেখালেখি

অতীতের ছবি – পকেটমার | নৈশব্দের পংক্তিমালা ।। ধারাবাহিক ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

অতীতের ছবি – পকেটমার | নৈশব্দের পংক্তিমালা ।। ধারাবাহিক ।। সুশীল কুমার পোদ্দার

কিছু কিছু মানুষ আছে যারা পোষাকে আষাকে কখনো স্মার্ট হয়ে উঠতে পারে না। আমি অমন জাতীয় এক রংচটা মানুষ। আমার কেন জানি জীবনে তেমন কখনো ইচ্ছাই জাগেনি স্মার্ট হবার। কিন্তু আমি না চাইলেও আমার প্রিয়জনেরা অন্তহীন চেষ্টা করে যেতো বিশেষ করে আমার দাদা ও দিদি। আমাদের বাড়ীর সামনে ছিলো এক সুদর্শন যুবক। গৌরকান্ত শরীরে যা পড়তো তাই মানাতো। একদিন আমার দিদি ওর গায়ে জড়ি যুক্ত লাল জামা দেখে ছোটভাই টাকে বানিয়ে দিল অনুরূপ। আমি লজ্জায় লাল হয়ে যাই। দিদির চাপে প্রায়ান্ধকার সন্ধ্যায় আমি সমস্ত জগৎ সংসার কে ফাকি দিয়ে রাস্তা দিয়ে হাটি অত্যন্ত সন্তর্পণে। মনে হয় সমস্ত পৃথিবী আমার দিকে চেয়ে চেয়ে বিদ্রূপ করছে। পথে যেতে দেখা হয় এক রিক্সা চালকের সাথে। ওর গায়ে হুবহু আমার জামা। ওতো পরতেই পারে, কিন্তু আমি সেদিন মেনে নিতে পারি নি।

এমনি আনস্মার্ট হয়ে কৈশোর পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্গনে পা রাখি আমি। বন্ধু বান্ধব কারণে অকারণে কালো চশমা পড়ে ঘুরে বেড়ায়। আমি ওদের অর্বাচীনের মতো প্রশ্ন করি রৌদ্রবিহীন অপরাহ্ণে কেন তোরা কালো চশমা পড়িস? আমার বন্ধুরা আমার বালখিল্য আচরণে কৌতুক ভরে উত্তর দেয় ওটা কালো চশমা নয়। ওটা হলো গগলস। আমার কাছে গগলস পরাকে কেন যেন প্রহসন বলে মনে হয়। ভাগ্যচক্রে একদিন বন্ধুদের কালো চশমার সমালোচনা করতে যেয়ে নিজেই চশমাক্রান্ত হয়ে পড়ি।

সেদিন টাকফাটা এক রৌদ্রজ্বল দিনে বিশ্ববিদ্যালয়ের পথে হেটে চলেছি। চোখে আমার রে-বানের গগলস। এবার দিদি নয় দাদার আদেশে। আমার গা দিয়ে ঘাম ঝরছে। চশমায় পাওয়ার থাকার কথা নয়। কিন্তু আমার কেন যেন রাস্তা ঘাট উঁচু নিচু মনে হয়। কার্জন হল পর্যন্ত যাওয়া আর হয়ে ওঠেনা। বুক পকেটে কালোকে ভরে রেখে রৌদ্রজ্জ্বল মধ্যাহ্ন বেলায় চোখ পিটপিট করে কতোদিন যে আমি পার হয়েছি টিএসসি, সামসুন্নাহার, রোকেয়া হল। আজ ভাবলে ঠোটের কোনে জেগে ওঠে এক চিলতে হাসি।

বড়দাদার চাকুরীর সুবাদে আমি হলে না থেকে থাকি বাংলামোটরে জহুরা ম্যানসনে। সিরাজগঞ্জ থেকে প্রায়ই বন্ধু বান্ধব, আত্মীয় স্বজন হাজীর হয় আমাদের অতিথি শালায়। সেদিন এক অপরাহ্ণ বেলায় হাজির হলো আমার এক বন্ধু সেও কালো চশমা পড়ে। ও আমার চেয়ে অনেক স্মার্ট। ওর ওয়ালেটে সর্বদা বসবাস করে অভিনেত্রী ববিতার ছবি। ও একজন অন্ধ ববিতা শিষ্য। সেবার ও যে ববিতাকে কাছ থেকে দেখার ইচ্ছে নিয়ে ঢাকায় এসেছে জেনে অবাক বিস্ময়ে ওর দিকে চেয়ে থাকি।

বাংলামোটরের অনতি দূরে কাউরান বাজারের পেছনে যে এফডিসি তা আমার জানা ছিলো না। জানার কখনো আগ্রহও ছিলো না। সিনেমায় অভিনয় করা তারকারা চিরকাল আমার কাছে আকাশের তারার মতো। দূর থেকে দেখে মুগ্ধ হই। পাছে সে মুগ্ধতা ঝরে পরে, পাছে মোহ মুক্তি ঘটে, সে আশংকায় আমি খুব কাছে যেতে চাইনা। ফরীদি সুবর্নাকে অনেকবার টিএসসিতে দেখেছি। কানাডায় আমাদের ওয়াটারলুর অনেক কমিউনিটি ইভেন্টে ববিতাকে একা একা বসে থাকতে দেখে আমি কতোবার নিজকে প্রশ্ন করেছি একি সেই ববিতা যে আমার মনোজগতে অশনি সংকেতের অনঙ্গ বউ, নয়ন মনির মনি, গোলাপি এখন ট্রেনের গোলাপি হয়ে বসে আছে! বাস স্ট্যান্ডে দাড়িয়ে থাকা ববিতাকে দেখে আমার ভাবান্তর হয়। তারকাদের মাটিতে নেমে আসাকে কেন যেন আমি সহজ ভাবে নিতে পারিনা।

বন্ধুর শখ মিটাতে এফডিসির এক নম্বর গেটের অনতিদূরে আমরা সন্ধ্যা অবধি দাড়িয়ে থাকি তারকাদের এক নজরে দেখার জন্য। গেট দিয়ে পার হয়ে যায় কতো গাড়ি। আমরা উকি ঝুঁকি মেরে দেখার চেষ্টা করে যাই – কে যায়? গেটের সামনে এক ভয়ংকর মোছাল দারোয়ান। ওকে দেখে খুব পরিচিত মনে হয়। কোন এক ফ্যানটাসি সিনেমায় ও ছিল এক দৈত্য। মনিবের কাছে মাথা নত করে বলতো ‘হুকুম কর মালিক’। আমাদের দাড়িয়ে থাকা দেখে সে ভীষণ বিরক্ত। শ্লেষ্মাজড়ানো কণ্ঠে বলে উঠে ‘ফোটেন মিঞা’। কিন্তু আমরা তো ফুটতে আসেনি। হঠাৎ কপাল খুলে যায়। ওদের দশ বার জন লোক দরকার। আমি বুঝার আগেই আমার বন্ধুটি আমায় নিয়ে হুরমুর করে সামনের সারিতে দাড়িয়ে যায়। আমরা এক ফ্লোর বয়ের পিছে পিছে প্রবেশ করি স্বপ্নের রাজ্যে।

ছাদহীন এক ঘরে বিবর্ণ চেয়ার টেবিল। রাজকীয় ভঙ্গিতে বসে আছে রাজ্জাক, পাশে ব্ল্যাক আনোয়ার, পরিচালক সহ আরো বেশ কিছু মানুষ। পরিচালক নিজের পরিচয় দিয়ে একটা ব্রিফিং দিয়ে যান যার মর্মার্থ হলো আমরা দশ-বার জন পকেটমার আমাদের লিডার ব্ল্যাক আনোয়ারের নেতৃত্বে ঢাকার বিভিন্ন জনপদে পকেট কেটে বেড়াই। দিন শেষে সব টাকা জমা হয় নায়ক রাজের কাছে। সেদিন গ্রাম থেকে এক কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা নিউমার্কেটের মোরে তার সর্বস্ব খুইয়ে দিশেহারা। সে খবর পৌঁছে যায় নায়ক রাজের কাছে। দিনান্তে টাকার হিসেবে গড়মিল। ব্রিফিং শেষ হওয়া মাত্র আমাদের পরিপাটি করা চুল গুলো একজন নির্মম ভাবে এলোমেলো করে দেয়। ইন করা বিন্যস্ত সার্টটা ঝটকা টানে খুলে ফেলে গিট এটে দেয়। পকেটের টাকাপয়সা সহ সমস্ত সম্পদ একরকম ছিনিয়ে নিয়ে রেখে দেয় তালাযুক্ত ড্রয়ারে, শুটিং শেষে ফিরিয়ে দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে। বুঝলাম ফেঁসে গেছি। বন্ধুর দিকে আড়চোখে তাকাই। ওর যেন আনন্দের সীমা নেই। শুটিং শুরু হয়। নায়করাজ উচ্চ কণ্ঠে ব্ল্যাক আনোয়ারকে শাসিয়ে যান। আমরা থরথর কাঁপছি। মুহূর্তে কাট কাট বলে আমাদের থামিয়ে দেয়া হয়। পরিচালক আমার বন্ধুর দিকে আঙ্গুল তুলে অশেষ বিরক্তি নিয়ে চিৎকার করে উঠে। আরে মিঞা অতো কাঁপনের কি আছে। আর এই যে ভদ্র লোকের পোলা তুমি তো নড়াচড়াই কর না। কথাটা যে আমার দিকে বুঝতে বাকী রইলো না। নায়ক রাজ ক্ষণে ক্ষণে ধমকে চলেছে মেকআপম্যানকে। চুল বিন্যস্ত করে আবারও শাসিয়ে যায় ব্ল্যাক আনোয়ারকে। সাময়িক বিরতি দিয়ে আবারও শুরু হয় শুটিং। এবার মারের দৃশ্য। নাট বল্টুহীন টেবিলের উপর উড়ে এসে পড়ে ব্ল্যাক আনোয়ার। খণ্ড খণ্ড হয়ে টেবিলটা ভেঙ্গে পড়ে। মাটি থেকে উঠিয়ে নিয়ে ব্ল্যাক আনোয়ারকে প্রবল বেগে ধাক্কা মারে নায়করাজ। ব্ল্যাক আনোয়ার তাল সামলাতে না পেরে আমায় নিয়ে ঢুকে পরে থরে থরে সাজিয়ে রাখা চায়ের বাক্সের পাহাড়ের মাঝে। আমি কিছু বুঝার আগেই আমাদের শরীরের উপর পড়তে থাকে বাক্সের পর বাক্স।আমি হাতের আঙ্গুলে ব্যথা পেয়ে কোকীয়ে উঠি। পরিচালক উচ্ছছিত খুব একটা ভালো সর্ট দেবার জন্য। ক্ষুধা তৃষ্ণায় ক্লান্ত বিধ্বস্ত হয়ে আমরা দুই পকেটমার অজস্র অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরে আসি গভীর রাত্রে।

সে যাত্রায় ববিতার সাথে ওর দেখা হয় না। ও বিফল মনোরথ হয়ে ঘরে ফিরে যায়। আমি মাকে চিঠি লিখে ওর সাথে পাঠিয়ে দেই। মা, আমরা দুই বন্ধু নায়করাজ রাজ্জাকের সাথে একটা ছবিতে অভিনয় করেছি। ছবির নাম আউয়ারা, পকেটমারের চরিত্রে। খুব শীঘ্রই মুক্তি পাবে।

অতীতের ছবি – পকেটমার | নৈশব্দের পংক্তিমালা ।। ধারাবাহিক ।। সুশীল কুমার পোদ্দার , ওয়াটারলু, কানাডা নিবাসী ।  ফলিত পদার্থ বিদ্যা ও ইলেকট্রনিক্স,  মাস্টার্স,  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় , বাংলাদেশ ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স,   ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, পি, এইচ, ডি,   ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। সিস্টেম ডিজাইন ইঞ্জিনিয়ারিং, ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স,  ওয়াটারলু, বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডা ।।


সর্বশেষ সংবাদ

দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com

সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

আমাদের ফেসবুক পেজ   https://www.facebook.com/deshdiganta.cbna24 লাইক দিন এবং অভিমত জানান

এসএস/সিএ

সর্বশেষ সংবাদ

দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com

সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

আমাদের ফেসবুক পেজ   https://www.facebook.com/deshdiganta.cbna24 লাইক দিন এবং অভিমত জানান

সংবাদটি শেয়ার করুন