লেখালেখি

অনন্তলোকে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়

অনন্তলোকে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়

অনন্তলোকে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়

আজিজুল পারভেজ ।। অপু ট্রিলজির দ্বিতীয় চলচ্চিত্র ‘অপরাজিত’র অপু চরিত্রের জন্য অভিনয়শিল্পী খুঁজছিলেন বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা সত্যজিৎ রায়। সত্যজিতের সহকারী নিত্যানন্দ দত্তের সঙ্গে বন্ধুত্বের সূত্রে অডিশনের ডাক পেলেন সৌমিত্র; কিন্তু তাঁকে নিতে রাজি হলেন না সত্যজিৎ। কারণ অপুর চরিত্রের বয়সের হিসাবে সৌমিত্র কিছুটা লম্বা ছিলেন। তবে এই দীর্ঘাঙ্গী সুপুরুষ নায়ক সৌমিত্রকে মনে ধরেছিল সত্যজিতের। অপু ট্রিলজির শেষ চলচ্চিত্র ‘অপুর সংসার’-এ তরুণ অপুর চরিত্রে সৌমিত্রকেই তিনি বেছে নেন। ১৯৫৯ সালের কথা। সৌমিত্রর বয়স মাত্র ২৩ বছর। তিনি ব্যস্ত তখন মঞ্চনাটক আর আবৃত্তি নিয়ে। কাজ করেন রেডিওর ঘোষক হিসেবে। সেই রেডিওর ঘোষক একসময় হয়ে উঠলেন এক বহুমাত্রিক অভিনেতা। সত্যজিৎ রায়েরই ৩৪টি চলচ্চিত্রের ১৪টিতেই অভিনয় করেন। সত্যজিতের ‘অপু’ আর ‘ফেলুদা’ চরিত্রকে রুপালি পর্দায় অমর করে দেওয়া বাংলা চলচিত্রের কিংবদন্তি অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের জীবনাবসান ঘটেছে।

কলকাতার বেলভিউ ক্লিনিকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গতকাল রবিবার দুপুরে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। ভারতীয় উপমহাদেশের দোর্দণ্ড প্রতাপশালী এই অভিনেতার বয়স হয়েছিল ৮৫ বছর। মৃত্যুর খবর পেয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ছুটে যান হাসপাতালে। হাসপাতাল থেকে সৌমিত্রর মরদেহ প্রথমে গল্ফগ্রিনের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে রবীন্দ্রসদনে ভক্ত-অনুরাগীদের শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে কেওড়াতলা শ্মশানে তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে গত ৬ অক্টোবর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল সৌমিত্রকে। হাসপাতালে ৪১ দিনের লড়াই শেষে বাংলা চলচ্চিত্রের এই উজ্জ্বল নক্ষত্র যাত্রা করলেন অন্যলোকে।

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯ জানুয়ারি ১৯৩৫, নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরে। চট্টোপাধ্যায় পরিবারের আদি বাড়ি ছিল বাংলাদেশের কুষ্টিয়ার শিলাইদহের কাছে কয়া গ্রামে। কর্মজীবী বাবার সঙ্গে ছেলেবেলা কেটেছে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন স্থানে। সুকুমারবৃত্তির চর্চা সেই ছেলেবেলা থেকেই। বই পড়ার প্রতি প্রচণ্ড টান। অভিনয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। মা-বাবা দুজনই যুক্ত ছিলেন মঞ্চনাটকের সঙ্গে। কলেজজীবনে শিশির কুমার ভাদুড়ির সান্নিধ্যলাভ জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। তাঁর হাত ধরেই থিয়েটারযাত্রার সূত্রপাত। সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে।

ছিপছিপে চেহারা, উজ্জ্বল চোখ ও মনখোলা হাসি। বাস্তবোচিত এবং সাধারণ মানুষের চরিত্রেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন সৌমিত্র। সত্যজিৎ রায় নির্মিত একেক ছবিতে একেক চরিত্রে আবির্ভূত হন। অভিনয় দক্ষতায় ভিন্ন ভিন্ন মাত্রা যোগ করেন। তাঁর অভিনীত কিছু চরিত্র দেখে ধারণা করা হয়, তাঁকে মাথায় রেখেই গল্প বা চিত্রনাট্যগুলো লেখা হয়। তাঁর অভিনীত চরিত্রগুলোর ভেতর সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং দর্শক সমাদৃত হলো ‘ফেলুদা’। এ ছাড়া মাস্টারদার চরিত্র এবং ‘আতঙ্ক’ ছবির মাস্টারমশাই চরিত্রের কথা ভাবলেই আজও বাংলা চলচ্চিত্রপ্রেমীদের শিহরণ অনুভূত হয়। প্রথমে ফেলুদা চরিত্রে তাঁর চেয়েও ভালো কাউকে নেওয়ার ইচ্ছা থাকলেও ‘সোনার কেল্লা’ মুক্তির পর সত্যজিৎ রায় অকপটে স্বীকার করেন যে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের চেয়ে ভালো আর কেউ করতে পারতেন না। কিন্তু তা সত্ত্বেও সত্যজিৎ রায় যখন ‘নায়ক’ ছবি করেন, সেই সময় নায়কের চরিত্রে প্রিয় সৌমিত্রকে পছন্দ না করে মহানায়ক উত্তম কুমারকেই নেন। তার পরও উত্তম কুমারের সঙ্গে এক সারিতে সৌমিত্রর নাম নেওয়া হয়। তপন সিনহার ‘ঝিন্দের বন্দি’ ছবিতে উত্তম-সৌমিত্রর অভিনয়ের লড়াই তাক লাগিয়েছিল সবাইকে। পর্দায় যেন অভিনয়ের যুদ্ধ। তবে শুধুই ‘ঝিন্দের বন্দি’ নয়, ‘দেবদাস’, ‘স্ত্রী’, ‘যদি জানতাম’ ছবিতেও উত্তম-সৌমিত্রকে একই সঙ্গে অভিনয় করতে দেখেছে চলচ্চিত্রপ্রেমী মানুষ। বাংলা ছবির দর্শক একসময় দুইভাগে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল এই দুই প্রবাদপ্রতিম অভিনেতার পক্ষে-বিপক্ষে।

সৌমিত্র তাঁর রক্ত-মাংসে চলচ্চিত্রকে ধারণ করেছেন একজন সত্যিকারের শক্তিমান অভিনেতা হিসেবে। সত্যজিৎ ছাড়া প্রায় ছয় দশকের চলচ্চিত্রজীবনে বিখ্যাত সব নির্মাতার ছবিতে কাজ করেছেন তিনি। সত্যজিৎ রায়ের ‘অপুর সংসার’, ‘চারুলতা’, ‘কাপুরুষ’, ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’, ‘অশনি সংকেত’, ‘সোনার কেল্লা’, ‘বাবা ফেলুনাথ’, ‘হীরক রাজার দেশে’, ‘ঘরে বাইরে’, ‘গণশত্রু’, ‘শাখাপ্রশাখা’; তপন সিংহের ‘ক্ষুধিত পাষাণ’; অসিত সেনের ‘স্বরলিপি’ ও ‘স্বয়ম্বরা’; মৃণাল সেনের ‘পুনশ্চ’, ‘প্রতিনিধি’ ও ‘আকাশ কুসুম’; বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর ‘তাহাদের কথা’ ও ‘মহাপৃথিবী’; অপর্ণা সেনের ‘পারমিতার একদিন’ ও ‘দেখা’; গৌতম ঘোষের ‘আবার অরণ্যে’র মতো চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে সৌমিত্র স্থায়ী আসন করে নিয়েছেন দর্শকের হৃদয়ে। সব মিলিয়ে দুই শতাধিক চলচ্চিত্র ও নাটকে অভিনয় করেছেন।

সৌমিত্র মানে শুধুই যে সিনেমার পর্দায় ডাকসাইটে অভিনেতা, তা একেবারেই নয়। সুকুমারচর্চার প্রায় সব শাখায় ছিল তাঁর উজ্জ্বল পদচারণ। চলচ্চিত্র, যাত্রা, মঞ্চনাটক এবং টেলিভিশন ধারাবাহিকে অভিনয় ছাড়াও যুক্ত হয়েছেন মঞ্চনাটকের নির্দেশনায়, দ্যুতি ছড়িয়েছেন যাত্রা ও আবৃত্তির মঞ্চেও। আবৃত্তিশিল্পী হিসেবেও তাঁর নাম উচ্চারিত হয় অত্যন্ত সম্ভ্রমের সঙ্গে। তিনি কবি এবং অনুবাদকও। কিংবদন্তি অভিনেতা—এই পরিচয়টির পাশেই স্বতন্ত্র আলো নিয়ে দাঁড়িয়ে তাঁর কবি পরিচয়। তাঁর কাব্যচর্চার ফসল পাঁচটি কাব্যগ্রন্থ। নাটকও লিখেছেন। ছবিও এঁকেছেন নিরন্তর। সেসব পেইন্টিং, স্কেচের প্রদর্শনী হয়েছে ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর কালচারাল রিলেশনসে। যৌবনে নির্মাল্য আচার্যের সঙ্গে এক্ষণ সাহিত্যপত্র সম্পাদনা করেছেন। একজন অভিনেতার কী অপরূপ বহুমাত্রিক তুলনাহীন পদচারণ সর্বক্ষেত্রে!

উইলিয়াম শেকসপিয়ারের ‘কিং লেয়ার’ অবলম্বনে সুমন মুখোপাধ্যায়ের ‘রাজা লিয়র’ নাটকে নাম ভূমিকায় কিংবদন্তি অভিনেতার অনবদ্য অভিনয় সব মহলে সমাদৃত। ২০১৫ সালে এই নাটক নিয়ে ঘুরে গেছেন বাংলাদেশ। তারও আগে ২০০৪ সালে শিশু একাডেমিতে তাঁর একক আবৃত্তি অনুষ্ঠান বাংলাদেশের দর্শকদের অমলিন স্মৃতি হয়ে আছে।

ধর্মের নামে গোঁড়ামি ও বিভাজনের রাজনীতির বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়ার (মার্ক্সবাদী) সমর্থক ছিলেন। তিনি ছিলেন বিজেপি সরকারের কড়া সমালোচকদের একজন।

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে ভারত সরকারের ‘পদ্মভূষণ’, ‘দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার’, ফ্রান্স সরকারের ‘লিজিয়ন অব অনার’সহ বহু পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছে।

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের স্ত্রী দীপা চট্টোপাধ্যায়ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে জড়িয়ে আছেন। তাঁদের ছেলে সৌগত চট্টোপাধ্যায় একজন কবি আর মেয়ে পৌলমী বসুর ছেলে রণদীপ বসু টালিগঞ্জের উদীয়মান অভিনেতাদের একজন।

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মৃত্যুতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনু ও সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার শোক প্রকাশ করেছেন।

 

এসএস/সিএ



সর্বশেষ সংবাদ

দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com

সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

 

সংবাদটি শেয়ার করুন