মহাবীরের শেষ যাত্রা |||| বিশ্বজিৎ মানিক
আজ পহেলা মার্চ দুই হাজার একুশ, স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর অর্থাৎ সুবর্ণ জয়ন্তী মাসের শুরুর মাত্র পাঁচ দিন আগে বঙ্গমাতার এক অগ্নি সন্তানের চির বিদায়। ব্যক্তিগত সমস্যার কারণে যথাসময়ে লেখা হয়নি। ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি ব্যর্থতার জন্য।
২৪ ফেব্রুয়ারী বুধবার হঠাৎ অফিসে খবর এলো – সুনামগঞ্জ জেলা বারের প্রাজ্ঞ আইনজীবী বীর মুক্তিযোদ্ধা জনাব বজলুল মজিদ চৌধুরী খসরু সাহেব চিরবিদায় নিয়েছেন। অত্যন্ত মর্মাহত, অনুতপ্ত এবং ব্যথিত হলাম। মহাশুন্য যেন মস্তকে নিপতিত হলো। দুদিন আগেও এমন পূর্বাভাস উনার দেহ ভল্লবে পরিলক্ষিত হয়নি অথচ আজ এ দুঃসংবাদ! বীরের চালচলন, বাচনভঙ্গি প্রকৃত বীরের মতোই ছিল।
জনাব বজলুল মজিদ চৌধুরী খসরু মৌলভীবাজার এর জামাতা বন্ধু লিটন চৌধুরীর ভগ্নিপতি, বড়বোন কবি মুনমুন চৌধুরীর স্বামী, বাড়ি – সুনামগঞ্জ, আমি উনার রণাঙ্গনের সহযোদ্ধা বীর মুক্তিযোদ্ধা অমলেন্দু দত্ত ( সুনামগঞ্জ) এর ভগ্নিপতি, বাড়ি – মৌলভীবাজার। উনি আমার শ্বশুর বাড়ির সম্পর্কে সম্পর্কিত, আমি উনার শ্বশুর বাড়ির সম্পর্কে সম্পর্কিত। আবার দুইজনের কর্মক্ষেত্র একই স্থানে। উনি সুনামগঞ্জ জেলা জজ আদালতের আইনজীবী আমি একই আদালতের প্রশাসনিক কর্মকর্তা। এই ত্রিবিধ কারণে আমরা পরস্পর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। উনার মৃত্যু সংবাদ শুনে বিশ্বাস হয়নি, বিশ্বাসের কোন কারণ ছিল না। মৃত্যুর পূর্ব দিনেও রাজপথে হাঁটাচলা এবং অফিসে আসা হয়েছে তাঁর।
পঞ্চাশ বছর আগে পহেলা মার্চ বেলা ১ টা ৫ মিনিটে পাকিস্তানের সামরিক শাসক আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান ঘোষণা করেন ৩ মার্চের জাতীয় পরিষদ অধিবেশন অনিদৃষ্ট কালের জন্য স্থগিত থাকবে। ইয়াহিয়া খানের ঘোষণার সাথে সাথেই ঢাকার মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়ে লাঠিসোটা হাতে নিয়ে মিছিল শুরু করলে অফিস আদালত, দোকান পাট, বিমান চলাচল সহ সবকিছু বন্ধ হয়ে যায়। হোটেল পূর্বানীতে পারলামেন্টারী পার্টির বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু প্রেসিডেন্ট ইহাহিয়ার সিদ্ধান্তকে প্রত্যাখ্যান করে আন্দোলনের কর্মসূচি হিসেবে ২ মার্চ ঢাকায় এবং ৩ মার্চ সারাদেশে হরতাল আহ্বান করেন একই সাথে ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে জনসভার ঘোষণা দেন। বঙ্গবন্ধুর এই ঘোষণার ঢেউ সারাদেশের ন্যায় সুনামগঞ্জ মহকুমায়ও এসে লাগে।
জনাব বজলুল মজিদ চৌধুরী খসরু সুনামগঞ্জ কলেজের স্নাতকের ছাত্র ও প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনের তুখোড় কর্মী। তিনি বুঝতে সক্ষম হয়েছিলেন পূর্ববঙ্গের মানুষ বঞ্চনা লাঞ্ছনার শিকার। তাঁর মধ্যে পাকিস্তান বিরোধী ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। তিনি আন্দোলন সংগ্রামে সক্রিয় হয়ে উঠেন। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ শুনে তিনি স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হন সশস্ত্র সংগ্রাম ব্যতিরেকে দেশমাতৃকার মুক্তি সম্ভব নয় যার ইঙ্গিত বঙ্গবন্ধুর ভাষণে স্পষ্ট হয়ে গেছে। তিনি যুদ্ধে অংশ গ্রহণের জন্য প্রস্তুত হয়ে যান। ২৮ মার্চ সুনামগঞ্জ প্রতিরোধ যুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। পাক হানাদার বাহিনী সুনামগঞ্জ দখল করে নিলে তিনি শহর ছেড়ে দোয়ারাবাজার গিয়ে মুক্তি বাহিনীতে যোগদান করেন। ৫ নং সেক্টরের সেলা ( বাঁশতলা) সাব সেক্টরে ক্যাপটেন হেলাল উদ্দিনের অধীনে অসংখ্য গেরিলা ও সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
নয় মাসের অসীম সাহসী মরণ পণ লড়াইয়ে বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হলে জনাব খসরু দেশ গড়ায় আত্মনিয়োগ করেন। তিনি ১৯৭২ সালে সুনামগঞ্জ কলেজ থেকে বি,এসসি পাশ করেন। ১৯৭৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এল এল বি পাশ করে পশ্চিম জার্মানীতে চলে যান। ১৯৮৩ সালে দেশে ফিরে আইন পেশায় নিয়োজিত হন। ১৯৯১ সালে সুনামগঞ্জ আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক এবং ২০০০ সালে সভাপতি নির্বাচিত হন। ২০০৭-২০০৯ সালে পাবলিক প্রসিকিউটর হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন।
জনাব বজলুল মজিদ চৌধুরী খসরু ছাত্রজীবন থেকেই লেখালেখি ও সাংবাদিকতায় পারদর্শিতা অর্জন করেন। তাঁর সম্পাদিত ” একাত্তরের সুনামগঞ্জ ” ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গবেষণাধর্মী বই ” রক্তাক্ত ৭১ সুনামগঞ্জ “, পশ্চিম জার্মানীর সৃতিকথা, বরুণ রায় স্মারক গ্রন্থ, আলফাত উদ্দিন আহমদ স্মারক গ্রন্থ, হোসেন বক্ত স্মারক গ্রন্থ আজও পাঠক হৃদয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে।
এই বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, গবেষক, নাট্যাভিনেতা,সদালাপী, সাদা মনের ব্যক্তির প্রয়াণে সুনামগঞ্জ হারালো এক আপনজনকে, দেশ হারালো দেশপ্রেমিক বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর। উনার মৃত্যুতে আমি ব্যাথিত, মর্মাহত। আমি উনার চিরশান্তি কামনা করি। আর তাঁর মুখে শুনবো না ” আপনি সুনামগঞ্জের জামাই বাড়ি মৌলভীবাজার আর আমি মৌলভীবাজার এর জামাই বাড়ি সুনামগঞ্জ। পরপারে ভালো থাকবেন হে সজ্জন।
পহেলা মার্চ দুই হাজার একুশ।
বিশ্বজিৎ মানিক, ছড়াকার ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা
এস এস/সিএ