ফিচার্ড লেখালেখি

অতীতের ডায়েরী  থেকে – ঝরা পাতার কান্না | সুশীল কুমার পোদ্দার

অতীতের ডায়েরী  থেকে – ঝরা পাতার কান্না | সুশীল কুমার পোদ্দার

১৯৯১। অনেক প্রতীক্ষার পর আমার পোস্টিং হলো বাংলার এক নিভৃত শহর নেত্রকোনায়। তখনও ছাত্রত্বের গন্ধ গা থেকে উঁবে যায়নি। তাই চাকুরীর নিয়ম-নীতির নাগপাশ ভেঙে আমি সময় পেলেই ছুটে যাই অনাবিল প্রকৃতির কাছে। শীর্ণ মগরার কোল ঘেঁষে অফুরন্ত সবুজের মাঝে আমি হারিয়ে যাই । নাম না জানা বিচিত্র জনপদ, কপটতাহীন সহজ-সুন্দর মানুষগুলো আমায় আপন করে নেয়। কি এক দূর্বার নেশায় আমি সময় পেলেই হেটে চলি অনির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে !

পরদিন যথা নিয়মে DC আমায় তলব করেন। অত্যন্ত গম্ভীর গলায় বলে যান – তুমি বজলুর দোকানে আবারও চা খেয়েছ? তুমি নাকি আটপাড়ার মোড়ের সেলুনে চুল কাটিয়েছ? দেখ, তুমি ম্যাজিষ্টেট, অফিসের বাইরে যতোটুকু পার নিজকে সাধারণ মানুষ থেকে দূরে রাখার চেষ্টা কর। আমি মুখে নিমীলিত হাসি টেনে অর্বাচীনের মতো ভান করি, আর মনে মনে জাল বুনি পালিয়ে যাবার । আমার যে ভালো লাগে না এ জন-বিচ্ছিন্ন জীবন। আমি অপ্রতিভ হই যখন আমার পিতৃস্থানীয় অধঃস্থনেরা আমায় দেখে কুর্ণিশ করে, কাঠগড়ায় করজোড়ে দাড়িয়ে থাকে অসহায় বিচার প্রার্থী। আমি ব্যথিত হই যখন দেখি আমারই কোন সহকর্মী অধীনস্থের সাথে মানবেতর আচরণ করে তার ক্ষমতার নির্লজ্জ প্রকাশ ঘটায়। আমি মনে মনে বিরক্ত হই যখন প্রতিদিন সকালে অফিসে যাবার প্রাক্কালে ড্রাইভারের পাশের সীটে বসা নিয়ে শুরু হয় নিজেদের মধ্যে বচসা । আমি নিজের মধ্যে বসবাস করতে শুরু করি , নিজের চারপাশে গড়ে তুলি এক সূক্ষ্ম দেয়াল । আমায় সবাই ভুল করে আঁতেল ভাবতে শুরু করে। আমি মনে মনে আমার এ আবরণকে উপভোগ করি। আস্তে আস্তে আমার এ মেকী আবরণটা সবার মাঝে একটা গ্রহণ যোগ্যতা পেয়ে যায়। আমি শিক্ষামন্ত্রকের দায়িত্ব পেয়ে যাই। জেলা পর্যায়ের বিভিন্ন নিয়োগের প্রশ্নপত্র তৈরি করি, মৌখিক পরীক্ষায় কঠিন কঠিন প্রশ্ন করি। এমনি করে গড়িয়ে চলে আমার স্বল্পায়ু চাকুরী জীবন।

একদিন এক স্কুলে মাধ্যমিক পরীক্ষা পর্যবেক্ষণের দায়িত্ব পড়ে। বিরাট স্কুলে আমি বিরামহীন টহল দিয়ে চলি। আমার এ কর্ম তৎপরতা অনেকের চোখেই ভাল লাগেনা। আমি একদিকে টহল দেই আর চোখ থাকে অপর প্রান্তে। অদূরে এক ছাত্রকে দেখি আস্তিন উঁচিয়ে কি যেন দেখছে। আমি ছুটে যাই। সতর্ক করে দেই যেন এর পুনরাবৃত্তি না হয়। পরীক্ষা আর পনের মিনিট বাকী। আবারো দেখি ছাত্রটি একি ভাবে আস্তিন উঁচিয়ে নকল করে যাচ্ছে। চন করে রক্ত উঠে আসে মাথায়। আমার পদবীর আভিজাত্য এক মুহূর্তে আমায় অন্ধ করে দেয়। আমি ক্ষিপ্ত গতিতে ছুটে যাই , ততোধিক ক্ষিপ্ত হোয়ে পরীক্ষা পত্রটা কেড়ে নেই। চিৎকার করে বলি – you are expelled। ছাত্রটা ঝাঁপিয়ে পড়ে আমার পায়ে, কান্না বিজড়িত কণ্ঠে ও ওর স্থানীয় ভাষায় বলে চলে- স্যার, আমার বাবা দিন মজুর, অনেক কষ্টে পরীক্ষার ফিস জোগাড় করে দিয়েছেন। স্যার, আব্বা আমাকে মেরে ফেলবে, আমার আর পড়াশুনা হবে না স্যার, প্লিজ স্যার, প্লীজ। আমি নিষ্ঠুর ভাবে পা টা সরিয়ে নেই। মুখে বলি I am helpless ।

স্কুল বারান্দায় এসে দাঁড়াই। একটা হিমেল বাতাস পরশ দিয়ে যায় আমার সারা শরীরে। মনটা মুহূর্তে বিষণ্ণতায় ভরে যায় । এ আমি কি করলেম ! মনে বেজে চলে – স্যার, আমার বাবা দিন মজুর, অনেক কষ্টে পরীক্ষার ফিস জোগাড় করে দিয়েছেন…। বাইরে গাড়ী দাঁড়িয়ে। আমি ইশারায় চলে যেতে বলি। মগরার পার ধরে হেটে চলি আনমনে।

আজ প্রকৃতি বড় রুক্ষ, কোথাও কোন সবুজ নেই, আকাশে পাখী নেই, কি বিষণ্ণ আজ চারিদিক ! আমি এক বট বৃক্ষের নীচে বসে রই অনন্ত কাল ধরে। গাছ থেকে পাতাগুলো ঝরে ঝরে পড়ে। আমি ঝরা পাতার কান্না শুনে যাই। কানে বাজে – আমার আর পড়াশুনা হবে না স্যার। আমি ঝরা পাতার সাথে ছেলেটাকে এক করে ফেলি। মনকে প্রশ্ন করি, আচ্ছা, আমি তো ওকে নাও পারতেম বহিষ্কার কোরতে। আমার কাজ তো নকল ধরা নয়, আমার কাজ নকলকে অনুৎসাহিত করা। তবে কেন করলেম? তবে কি আমি বদলে যাচ্ছি? ততক্ষণে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। অদূরে লাইট পোস্টের অনুজ্জ্বল হলদে আলো আমায় বলছে ঘরে ফেরার কথা…

চলবে…

অতীতের ডায়েরী  থেকে – ঝরা পাতার কান্না | সুশীল কুমার পোদ্দার,  ওয়াটারলু, কানাডা নিবাসী ।  ফলিত পদার্থ বিদ্যা ও ইলেকট্রনিক্স,  মাস্টার্স,  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় , বাংলাদেশ ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স,   ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, পি, এইচ, ডি,   ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। সিস্টেম ডিজাইন ইঞ্জিনিয়ারিং, ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স,  ওয়াটারলু, বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডা ।।


সর্বশেষ সংবাদ

দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com

সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

আমাদের ফেসবুক পেজ   https://www.facebook.com/deshdiganta.cbna24 লাইক দিন এবং অভিমত জানান

সংবাদটি শেয়ার করুন