ধা রা বা হি ক…….পূর্ব প্রকাশের পর
জাপানের যাপিত জীবন – ৮ | সুশীল কুমার পোদ্দার
আমার নতুন ভাড়া-বাড়িটার সাথে আত্মীয়তা হতে বেশ সময় লেগে যায়। পাহাড় থেকে বয়ে আসা মৃদুমন্দ বাতাসে আমার বাড়ীটার পুরো কাঠামো দুলে ওঠে। সূর্য ডোবার সাথে সাথে ঝুপ করে কোথা থেকে অন্ধকার এসে বাড়ীটাকে জাপটিয়ে ধরে। বড় বড় গাছের ছায়ায় ঢেকে যায় বাড়ির অঙ্গন।
আমার প্রায়ই বাসায় ফিরতে দেরী হয়। গলির মুখে একটা প্রাচীন এক অভিজাত বাড়ী। আভিজাত্যের পলেস্ত্ররা অনেকটাই খসে গেছে। বয়সের ভারে ন্যুব্জ এক বৃদ্ধা এই বাড়ীটার এক কোনে বাস করে। সন্ধ্যা হলেই সে বাড়ীর প্রবেশ দ্বারে ঝুলিয়ে দেয় লাল রঙা এক লণ্ঠন। বাতাসে দুলে দুলে সে লণ্ঠন এক প্রলম্বিত মায়াবী ছায়া ফেলে সমস্ত আঙ্গিনা জুড়ে। সে ছায়া পেন্ডুলামের মতো দুলে দুলে সৃষ্টি করে কতো অপার্থিব অবয়ব। আমার সেই আলোছায়া মারিয়ে রাত্রে বাড়ী ফিরতে কেন যেন গা ছম ছম করে। মনে হয় অশরীরী কোন অস্তিত্ব আমার পিছু নিয়েছে; হয়তো ফিসফিস করে বলবে সেইকাৎসু গা তাইহেন নে …
শুনেছি জাপানে দুধরনের ভুত- ওবাকে( বড় ভুত) এবং কোবাকে ( ছোট ভুত) এই সব আলো আধারে খেলা করে। ভুতে বিশ্বাস না করলেও আমার অবচেতন মন যুগ যুগান্তরের কুসংস্কারের মায়া ছাড়তে পারে না। তাই প্রতিদিন রাতে বাসায় ফেরার পথে অঙ্গীকার করি আর এ বাড়ীতে থাকা নয়। কিন্তু সকাল হলেই মনে হয় – দেখি না আর কটা দিন। জাপানীজদের পরম্পরাগত হাসি মাখা মুখের পেছনে পরচর্চা, পরনিন্দা, হিংসা-বিদ্বেষ, ছিদ্রান্বেষণের মতো নেতিবাচক দিক গুলো যেমন এখানে এসে চোখে পড়ে তেমনি ওদের আতিথেয়তায় আমি বিমুগ্ধ হই। অভিজাত এলাকায় থেকে যা দেখিনি, যা শুনিনি তা খুব কাছ থেকে দেখার ও শুনার সুযোগ পেয়ে নিজকে মাঝে মাঝে সৌভাগ্যবান মনে হয়।
সকালে ঘুম ভাঙ্গে পাখীর কলকাকলিতে। আমার দোতলা বাড়ীর রেলিঙের ধার ঘেঁষে সারিবদ্ধ ভাবে বসে থাকে পাহাড় থেকে উড়ে আসা চড়ুই পাখীর মতো নাম না জানা পাখীর এক বিশাল পরিবার। লোহার সিঁড়িতে রাজকীয় ভঙ্গীতে রোদ পোহায় বেশ কিছু ভুল-ভুলা বেড়াল। ওরা কেউই আর বিদেশী বলে আমাদের দিকে কান খাড়া করে তাকায় না।একতলাতে এক ঝগড়েটে জাপানী পরিবার। প্রায়ই আমাদের সাক্ষী রেখে স্বামী স্ত্রী ঝগড়া করে। গৃহকর্তা কি করেন তা জানিনে। তবে গভীর রাতে ওর জড়ানো কণ্ঠের আওয়াজ কানে আসে। হয়তো সে মদ্যপ হয়ে ঘরে ফিরেছে । প্রথম প্রথম অস্বাভাবিক লাগলেও আস্তে আস্তে জাপানী সমাজের এ অন্ধকার দিক চোখে সহে যায় ।
এখানে কেউ নয়টা পাঁচটা অফিসে কাজ করে না। কাজের প্রতি একাগ্রতা, বসের প্রতি আনুগত্যে দেখাতে এরা দীর্ঘ সময় কাজ করে। কাজ শেষে বসের সাথে আকণ্ঠ পান করা, বা বসকে সঙ্গ দেওয়া অধিকাংশ অফিসের অলিখিত নিয়ম। এই নিয়ম পালন করতে করতে জাপানী সমাজে পতির বিলম্বে ঘরে ফেরা একটা সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। শুনেছি কোন স্বামী তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরলে তার শরীর, স্বাস্থ্য, কর্ম ক্ষেত্র নিয়ে পাঁচকথা হয়।
আস্তে আস্তে বিবর্ণ ধুসর বাড়ীটা আমাদের এক গভীর মমতায় বেধে ফেলে। বিশেষ করে আমার ছোট বাবুটার প্রতি ওদের অকৃত্রিম ভালোবাসা আমায় পুরানো ধারনা থেকে বেড় হোয়ে আসতে সাহায্য করে। ওকে দেখলেই ওরা এটা ওটা কিনে দেয়। ও ডে-কেয়ার থেকে ফেরার পথে সেই বয়সের ভারে ন্যুব্জ বৃদ্ধার দরজায় শিশুর ভাষায় তাতা তাতা বলে ক্রমাগত করা নাড়ে। বৃদ্ধা যেন উপহার নিয়ে ঐ করাঘাত শুনার প্রতীক্ষায় কান পেতে থাকে। প্রতিদিন এমন উপহার নিতে আমি কুণ্ঠিত হলে বৃদ্ধা ঘোলা চোখে অসহায় হয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করে। আমি অবাক হোয়ে তাকিয়ে থাকি বৃদ্ধার পানে। বৃদ্ধা ভাবলেশহীন ভাবে বলে যায় তার অতীত জীবনের কথা। স্বামী গত হয়েছে অনেক অনেক দিন আগে, একমাত্র ছেলে পরিবার নিয়ে টোকিও থাকে, একমাত্র নাতীকে দেখতে খুব মন চায়, কিন্তু ছেলে সময় করে উঠতে পারে না। বৃদ্ধার কথায় কোন অভিযোগ নেই, কোন আক্ষেপ নেই। হঠাৎ করে কিছু লুকিয়ে মৃদু হেসে এক গভীর মমতা দিয়ে আমার সন্তানকে কাছে টেনে নেয়। যান্ত্রিক জীবনের জটিল সমীকরণ মিলাতে না পেরে আমি দিশেহারা। মনে পড়ে মায়ের কথা। প্রকৃতি কেন যে কোন খেয়ালে সব মাকে এতো মায়া মমতা দিয়ে সৃষ্টি করেছে – বুঝে পাইনা।
ধর্মীয় সংহতির দেশ জাপান। এখানে কোন বিশেষ ধর্মের প্রতি নেই কোন রাষ্ট্রীয় পক্ষপাতিত্ব, নেই কোন ধর্মীয় নিবর্তনমূলক আইন। ধর্ম এখানে সামাজিক জীবনের এক অদৃশ্যমান স্বত্বা, সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত জীবনাচারের অংশবিশেষ। জাপানিজ জনগণ প্রধান দুই ধর্মের ( সিনতো ও বৌদ্ধ ) অনুসারী হলেও এরা কেউই সামাজিক ভাবে বিভাজিত নয়। কোন এক পরিসংখ্যানে দেখেছিলেম জাপানে এক একটা পরিবার গড়ে ১.৮ ধর্মে বিশ্বাসী। এরা জন্ম মৃত্যু বিয়ের মতো সামাজিক অনুষ্ঠান গুলো পালন করে সিনতো মন্দিরে আবার মৃত্যু সহ পারলৌকিক আচার আচরণ পালন করে বৌদ্ধ মন্দিরে। ইদানীং অনেকে আবার পশ্চিমা সংস্কৃতি অনুসরণ করে গির্জায় বিবাহ বন্ধনে মিলিত হয়।
জাপানী সংবিধান প্রতিটা নাগরিককে দিয়েছে নিরঙ্কুশ ধর্মীয় স্বাধীনতা। এখানে মূল ধারা যে স্বাধীনতা ভোগ করে হিন্দু, খ্রিষ্টান, শিখ, জুরাষ্টীয়ানরাও একই স্বাধীনতা ভোগ করে। অনেক জায়গায় সিনতো মন্দির ( shrine), বৌদ্ধ মন্দির ও খ্রিস্টান চার্চ পাশাপাশি অবস্থিত। ধর্মকে রাজনীতি থেকে দূরে রেখে কেমন করে একটা দেশ মাথা উঁচু করে পৃথিবীর বুকে দাড়িয়ে থাকতে পারে, জাপান এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
সিনতো ধর্ম জাপানের সনাতন ধর্ম। এ ধর্ম জুড়ে রয়েছে প্রকৃতি বন্দনা । এরা সবুজের কাছে, সমুদ্রের বিশাল জলরাশির কাছে, উত্তুঙ্গ পর্বত মালার কাছে, ফুলে ফুলে সুশোভিত চেরী বৃক্ষের কাছে কৃতজ্ঞতা ব্যক্ত করে। আর এই কৃতজ্ঞতা ব্যক্ত করার জন্যে জাপান সরকার রাষ্ট্রীয় ভাবে নির্ধারণ করেছে বেশ কিছু ছুটির দিন (উমি নো হি – সমুদ্রের দিন, মিদরি নো হি – সবুজের দিন, ইয়ামা নো হি – পর্বতের দিন, …)। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল এমনি কিছু উৎসবে অংশ নেবার।
বিদেশী শিক্ষার্থীদের জাপানী সংস্কৃতির সাথে পরিচিত করার জন্যে অনেক স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান রয়েছে। আমরা এমনি এক প্রতিষ্ঠানের আমন্ত্রণে হাজির হলাম পাহাড়ের গা ঘেঁষা এক প্রত্যন্ত গ্রামান্চলে। এক বিশাল বড় উন্মুক্ত ফসলের মাঠ। চাষিরা সদ্য ধান কেটে নিয়ে গেছে। সেই মাঠ সেজেছে উৎসবের সাজে। ছোট ছোট দোকান বসেছে হরেক রকম পণ্য নিয়ে। আমাদের জন্য অজস্র খাবার- বেশ কিছু টেবিলে হরেক রকমের ফল, কয়লার উনুন গুলোতে চলছে মাছের বারবিকিউ। অদূরে এক বিশাল জটলা। এক বিশাল আকৃতির কাঠের পাত্রের মধ্যে ঢালা হচ্ছে গরম গরম নবান্ন। বিরাট আকার একটা মুগুর অনেকটা আমার দেশের ঢেঁকীর মতো উঠছে নামছে সেই পাত্রের মধ্যে, আর এ কাজে সহযোগিতা করছে জনা পঞ্চাশেক মানুষ। বিশাল এক কর্মযজ্ঞ। পিঠার মতো খেতে এ খাবারটাকে ওরা মচি বলে। খেতে বেশ মজা, বিশেষ করে পুড়িয়ে খেতে।
বিকেলে আমাদের নিয়ে যাওয়া হয় গ্রাম্য কৃষকের বাড়ীতে। ওরা ওদের সহজাত অকৃত্রিম আতিথেয়তা দিয়ে বরণ করে নেয় আমাদের বিরাট বাহিনীকে। মচির হরেক রকম পদ দিয়ে আপ্যায়ন করা হয় আমাদের। ফিরতে পথে আমাদের বাস থামে এক সিনতো মন্দিরের প্রবেশ দ্বারে। বিশাল আকারের সিঁদুর বর্ণ তোরণ পেড়িয়ে মূল মন্দির। জুতো খুলে, বাঁশের খোল দিয়ে বেয়ে আসা পবিত্র জলে হাত ধুয়ে ঢুকতে হয় এ মন্দিরে। মন্দির প্রাঙ্গণে ঢুকেই যে জিনিসটা চোখে পড়ে তা হলো রং বেরঙ্গের চাইম। প্রতিটা চাইমের উপরে কানজিতে কিছু লেখা। পরে শুনেছি অধিকাংশ জাপানিজ ভাগ্য ও কুসংস্কারে বিশ্বাসী। এই চাইম ওরা ব্যাক-প্যাকে, গাড়ীতে, ঘরের প্রবেশ দ্বারে ঝুলিয়ে রাখে। আমাদের মতো কিছুটা হলেও ওরাও ওদের ভাগ্যকে পরিবর্তন করতে চায় এমনি সব অন্ধবিশ্বাস দিয়ে (যদিও ওদের এ অন্ধবিশ্বাস পরিশ্রমের বিকল্প নয়, বরং পরিশ্রমের পরিপূরক শক্তি) । চাকুরীতে পদোন্নতি, পরীক্ষায় পাশ এমনকি ভালবাসার পাত্র/ পাত্রীকে পাবার জন্যও চাইমের রয়েছে ব্যাপক চাহিদা। আমরা অনেকে এতকিছু না ভেবে শুধু এর নির্মাণশৈলীতেই মুগ্ধ হয়েই কিনে নেই দুএকটা।
গৌতম বুদ্ধ বলেন আপাত সুখের মাঝে দুঃখের বীজ নিহিত। কারণ সুখ ক্ষণস্থায়ী। আমরাতো সাধারণ মানুষ। তাই অজস্র সুখানুভূতির স্মৃতি কুড়িয়ে নিয়ে ফিরে আসি আপন শহরে, কোন দুঃখের সময় ভাঙ্গিয়ে খাবো বলে।