অমিত পর্ব-৭ |||| সুশীল কুমার পোদ্দার
পূর্ব প্রকাশের পর…
… ও পাখীর পালকের মতো ঊর্ধ্বাকাশে ভেসে চলে। একটা স্নিগ্ধ বাতাস ওর সারা শরীরে ছড়িয়ে দেয় ঠাণ্ডা আবেশ। দিনান্তের সূর্যটা দিগন্তের কোলে ঢেলে দিয়েছে আবিরের মায়াবী রঙ । পাখীরা কলকাকলি করে ফিরছে ঘরে। ওর চোখে পড়ে নিচে বয়ে যাওয়া সবুজে মোরা বিস্তীর্ণ বনাঞ্চল, গিরীশৃঙ্গ, পাহাড়ি পথ। তা পার হতেই ভোরের স্নিগ্ধ আলোয় ওর চোখ জুড়িয়ে যায় । চোখে পড়ে উন্মত্ত জলরাশি। সেই জলরাশি এখানে সেখানে সৃষ্টি করে চলেছে অজস্র ঘূর্ণাবর্ত, অসংখ্য ঘরবাড়ী, বৃক্ষলতা সে ঘূর্ণাবর্তে হারিয়ে যাচ্ছে। ঘর হারা পাখীরা উচ্চ কলোরব করে ওকে ঘিরে চক্রাকারে উড়ে চলে। অমিতের মনে সেই শৈশবে দেখা নদীকুলের ভাঙনের দৃশ্য জেগে উঠে। ও তার বন্ধুদের সাথে এক অর্ধভঙ্গ স্কুলের মাটিতে কান পেতে ভাঙ্গনের শব্দ শুনে। টাস-টাস করে বৃক্ষের শিকড় ছেড়ার শব্দ, ঝুপ-ঝুপ করে মাটির আত্ম বিসর্জনের শব্দ। শব্দগুলো আস্তে আস্তে বড় হতে থাকে । অজস্র কালনাগিনী ফোঁস ফোঁস করে গর্জন করে ওঠে। ওরা মাটি থেকে উঠে দ্রুত পেছনে সরে আসে। মুহূর্তে বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে দেখা দেয় ভয়াবহ ফাটল। আস্তে আস্তে সে ফাটল বড় হতে হতে অকস্মাৎ গাছপালা নিয়ে ডুব দেয় নদীর জলে। ওর কানে আসে বানভাসি মানুষের বিলাপ – কিন্তু সে বিলাপ ওকে স্পর্শ করে না। ও তার বন্ধুদের নিয়ে সর্বনাশা এ ভাঙনের খেলা দেখতে আবারো এগিয়ে চলে।
পথে দেখা হয় বাবার সাথে । অগ্নিশর্মা বাবা ওকে কান ধরে মারতে মারতে হির হির করে টেনে নিয়ে চলে। সেই শৈশবের অমিতের সাথে সাথে সেও পাশাপাশি হেটে চলে। ও ওর পিতার দিকে তাকিয়ে থাকে অনিমেষ। পিতাকে কবে হারিয়েছে তা ওর মনে নেই। শৈশবে বাবাকে দেখতে বড় মন চাইত। বাবার কথা বললেই মা আচলে চোখ মুছত। শুনেছে বাবা তার সেই শৈশবে বিনা চিকিৎসায় গত হয়েছেন। আজ সেই হারিয়ে যাওয়া বাবাকে দেখে জড়িয়ে ধরতে প্রবল ইচ্ছে করে। অনেক অনেক শাসন, অনেক অনেক মার খেতে ইচ্ছে করে। অদূরে দাড়িয়ে আছে উদ্বিগ্ন মা ছোটভাইটাকে কোলে নিয়ে। অমিতকে দেখেই জড়িয়ে ধরে। বাবার শাসনে পাঁচ আঙ্গুল বসে যাওয়া পিঠে হাত বুলিয়ে দেয় মা পরম মমতায়। বিমর্ষ অমিত নির্বাক দাড়িয়ে থাকে। মাকে বলে – মা, তুমি একটিবার আমায় জড়িয়ে ধর। শুধু একটিবার। সে অনুভব করে একটা অপরিচিত স্নেহময় স্পর্শের । ও চোখ খুলে বিহ্বলিত হয়ে তাকিয়ে দেখে ইট্টিঞ্জার। ইট্টিঞ্জার পরম স্নেহে ওর গলায় এক ব্যাচ পড়িয়ে দেয়। হলঘর গম গম করে উঠে উচ্ছ্বসিত মানুষের করতালিতে। অমিত বুঝতে পায় না সে এমন কি করেছে ??
ওর কথা শুনার জন্য সবাই উদগ্রীব হয়ে তাকিয়ে থাকে। অমিত কি বলবে খুঁজে পায়না। ইট্টিঞ্জারের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে – মানুষ কেন দীর্ঘজীবী হতে চায়, কেন অমরত্ব চায় – তা আমি জানি না। আমার এ নবজন্ম নিয়ে আমি কি করবো? আমি আমার আত্মার সমস্ত বন্ধন হারিয়েছি। চারিদিকে অপরিচিত সব মুখ। আমি শুধু আমার জন্য বাঁচতে চাইনে। আমার যে কিছুই দেবার নেই। ইট্টিঞ্জার বাঁধা দিয়ে বলে উঠে- কে বলে তোমার দেবার কিছু নেই ! আমার দিকে তাকিয়ে দেখ – আমি পৌঢ়, তোমার তিনগুণ বয়স আমার, কিন্তু আমি আজও স্বপ্ন দেখি। স্বপ্ন দেখার কোন বয়স হয় না। আজকের পৃথিবীতে মানবতা শব্দটা আর নেই। স্বার্থান্বেষী মানুষে ভরে গেছে পৃথিবী। প্রযুক্তি মানুষের কাছ থেকে মানবিক গুণাবলীগুলো কেড়ে নিয়েছে। আজ আমাদের সময় এসেছে সেই মানবতাকে ফিরিয়ে আনা। একটা সভ্যতা এ মানবতা ছাড়া ধ্বংস হতে বাধ্য। আমরা চেষ্টা করছি রোবটকে মানবিক গুণাবলী দিতে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাথে মানবতা, মানবিক গুণাবলী যোগ করতে আজ আমরা সবাই মিলে কাজ করে চলেছি। তুমি হলো আমাদের বিগত শতকের মানবতার এক জীবন্ত উদাহরণ। করোনা কালীন সময়ে তুমি বাড়ীতে বাড়ীতে অসংখ্য মানুষের ওষুধ, খাবার পৌঁছে দিয়েছ, অসুস্থ মানুষকে তুমি হাসপাতালে নিয়ে গেছ, নিজের ভেন্টিলেটর তুমি খুলে দিয়েছ মৃত্যু পথযাত্রী রোগীকে, নিজের শরীর দিয়েছ বৈজ্ঞানিক গবেষণার জন্য…
অমিত নীরবে দাড়িয়ে থাকে। মনে পড়ে হাসপাতালের দিনগুলো। হাসপাতাল উপচে পরা ভিড়। ওর পাশের বেডে অরুণ- হাসপাতালেই ওর সাথে পরিচয়। অরুণের দুই ছোট ছোট শিশু সন্তান। প্রতিদিন ওর পরিবার হাসপাতালের বারান্দায় ওকে একটু দেখার জন্য অপেক্ষা করতো। ছোট ছোট হাত দিয়ে ওর সন্তানরা ছুড়ে দিতো ভালবাসার চুম্বন। ওদের মা কান্না লুকিয়ে মাথা নিচু করে নিতো বিদায় ।
করোনা ওদের ফুসফুসকে ভয়াবহ ভাবে আক্রান্ত করেছে। ওদের দুজনের মধ্যে অমিতের ভাগ্যে জুটেছে ভেন্টিলেটর।ভেন্টিলেটরের অভাবে ডাক্তার অরুণকে মৃত্যুর হাতে ছেড়ে দিয়েছে। অমিত ওর ছোট ছোট সন্তানদের কথা মনে করে ডাক্তারকে অনুরোধ করেছিল তার ভেন্টিলেটর অরুণকে দেবার জন্য।
অরুণ তুমি কি বেঁচেছিলে? তুমি কি ফিরে যেতে পেরেছিলে তোমার পরিবারের কাছে? তোমার সন্তানরা কি ফিরে পেয়েছিল তোমাকে ? নেই কোন রক্তের সম্পর্ক, নেই কোন ধর্মীয় বন্ধন, তবু ওর চোখ বেয়ে ঝরে পড়ে মানবতা-শিক্ত উষ্ণ বারিধারা…
চলবে…
অমিত পর্ব-৭ |||| সুশীল কুমার পোদ্দার, ওয়াটারলু, কানাডা নিবাসী । ফলিত পদার্থ বিদ্যা ও ইলেকট্রনিক্স, মাস্টার্স, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় , বাংলাদেশ ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স, ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, পি, এইচ, ডি, ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। সিস্টেম ডিজাইন ইঞ্জিনিয়ারিং, ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স, ওয়াটারলু, বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডা ।।
সিএ/এসএস
দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com
সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন