মত-মতান্তর

আইসল্যান্ডের পুস্তক-বন্যা ও বাংলাদেশের পুস্তক-খরা

আইসল্যান্ডের পুস্তক-বন্যা

২৪ ডিসেম্বর রাতে ক্রিসমাস ট্রির নিচে উপহার রাখা পাশ্চাত্যের এক পুরনো রীতি। আইসল্যান্ডের রীতি হচ্ছে, ক্রিসমাস ট্রির নিচে বই রাখা। অন্য কোনো উপহার নয়- বই, বই আর বই। ২৪ তারিখ রাতটা তারা কাটায় একে অপরকে বই পড়ে শুনিয়ে। আইসল্যান্ড শীতের দেশ।

ফায়ারপ্লেসের কাছাকাছি কম্বলের নিচে আধশোয়া হয়ে একেকজন হাতে একটা গরম তরল চকোলেটের মগ নিয়ে বই পড়বে, বই পড়া শুনবে। আইসল্যান্ডের প্রতিটি পরিবারে ২৪ তারিখ রাতে এই চিত্র।

২৫ ডিসেম্বর সকালে আইসল্যান্ডে বইয়ের বন্যা বয়ে যায় ক্রিসমাস ট্রির নিচে। পুস্তককেন্দ্রিক এই উৎসবের নাম ‘জোলাবোকাফ্লাড’ বা বড়দিনের পুস্তক বন্যা। ক্রিসমাসের প্রাক্কালে পুস্তক বিনিময় ও পুস্তক উপহার দেয়া আইসল্যান্ডের ঐতিহ্য। এই ঐতিহ্য কিংবা জোলাবোকাফ্লাড আইসল্যান্ডের প্রকাশনা শিল্পের টিকে থাকার পূর্বশর্ত।

পুস্তক-বন্যার শুরু ১৯৪৫ সালে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে। তখন গরীব দেশ ছিল আইসল্যান্ড- জিনিসপত্র আমদানি করার ক্ষমতাও ছিল না, অনুমতিও ছিল না। কিন্তু ক্রিসমাসের উপহারতো দিতে হবে। কাগজ বেশ সস্তা ছিল বলে বই মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে ছিল। বই এভাবেই ক্রিসমাসের অন্যতম উপহার হয়ে ওঠে আইসল্যান্ডে।

আইসল্যান্ডে বছরের মোট প্রকাশনার দুই তৃতীয়াংশ ছাপা হয় নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে। এটা অনেকটা ইংল্যান্ডের সুপার থার্সডের মতো। অক্টোবরের প্রথম বৃহস্পতিবারকে ইংল্যান্ডে বলা হয় ‘সুপার থার্সডে’ বা মহা বৃহস্পতিবার। এই দিন হাজার হাজার বইয়ের শোভন সংস্করণ বা শক্তমলাট সংস্করণ প্রকাশিত হয়। আইসল্যান্ডে এক দিন মাত্র নয়, প্রায় দুমাস ধরে চলে এই প্রকাশনা উৎসব। শত শত নতুন বই ছাপা হয়ে আসে বইয়ের দোকান আর সুপারমার্কেটগুলোতে, হ্রাসকৃত মূল্যে।

বহুকাল যাবৎ আইসল্যান্ডের নাগরিকদের কাছে সাহিত্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। সাহিত্যকে আইসল্যান্ডে একটি শিল্পমাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সব নাগরিকই কোনো না কোনোভাবে এই শিল্পমাধ্যমের সঙ্গে সম্পর্কিত, হয় পাঠক হিসেবে, নয়তো লেখক হিসেবে। আইসল্যান্ডের প্রতি দশ জন নাগরিকের মধ্যে একজন জীবনে অন্তত একটি বই লিখে প্রকাশ করেছেন। ৯০ ভাগের বেশি নাগরিক বছরে কমপক্ষে একটি বই পড়েন। ৫০ ভাগ নাগরিক বছরে ৮টির বেশি বই পড়েন। ৮৩টির বেশি পাঠাগার আছে আইসল্যান্ডে, প্রতি ৪,৩০০ জন নাগরিকের জন্যে একটি পাঠাগার।

আইসল্যান্ডের লোকসংখ্যা মাত্র ৩ লাখ ৬০ হাজার, কিন্তু প্রকাশনা ব্যবসায়ের মোট বিক্রয়মূল্যের বিচারে এই দেশের স্থান ইংল্যান্ডের ঠিক পরেই। ক্রিসমাসের আগেই ছেলে-বুড়ো সবাই শত শত পৃষ্ঠার সব ক্যাটালগ ঘেঁটে ঠিক করে ফেলে, কোন কোন বই তারা কিনবে সে বছর। ২০১৯ সালের একটি ক্যাটালগে ৮৪২টি নতুন বই আছে। প্রতি ১০ জনে ৭ জন ক্রিসমাস উপহার হিসেবে একটি বই কিনবেই কিনবে।

আইসল্যান্ডে সাহিত্যচর্চার দীর্ঘ ঐতিহ্য রয়েছে। আইসল্যান্ডিক সাহিত্যের শুরু আজ থেকে ৯০০ বছর আগে। বিশ্বসাহিত্যের এক রত্ন হিসেবে বিবেচিত হয় এই সাহিত্য। আইসল্যান্ডের প্রাচীন সাহিত্য আজও এই দেশের স্কুলে শিশুদের পাঠ্য। এই সাহিত্যে আছে কীভাবে ১১শ ও ১২শ শতকে লোকজন এই এলাকায় বসতি স্থাপন করেছিল, কী রকম সংগ্রামমুখর ছিল তাদের জীবন।

পরবর্তী ৭০০ বছর ধরে আইসল্যান্ড নরওয়ে ও ডেনমার্কের উপনিবেশ ছিল। কীভাবে জানি, আইসল্যান্ডের স্বাধীনতা ও স্বকীয়তার আন্দোলনের সংগে বইপড়ার অভ্যাসের একটা সম্পর্ক দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। ‘আমরা নরওয়েজিয়ান কিংবা ডেনিশদের মতো নই, আমরা বই পড়ি!’ আইসল্যান্ডের নাগরিক হতে হলে বই পড়তে হবে– এরকম একটা সংস্কার জড়িয়ে গিয়েছিল আইসল্যান্ডিক জীবনচর্যায়।

২০১৩ সালের এক সমীক্ষা থেকে জানা গেছে, সারা বছরই বই প্রকাশিত হয় আইসল্যান্ডে, তবে ক্রিসমাসে ছাপা হয় বছরের মোট প্রকাশনার ৪০ ভাগ বই। আইসল্যান্ডে বইয়ের গড় দাম ৫৭ ডলার, যা ব্রিটেন বা ফ্রান্সের দ্বিগুণেরও বেশি। এই দামে সবাই বই কিনতে পারে না সারা বছর। ক্রিসমাসে দাম অনেক কমিয়ে দেয়া হয়। ক্রিসমাস উপলক্ষে সুপার মার্কেটগুলোতে হিমায়িত খাদ্য, রুটি, কেক ইত্যাদি লোভনীয় পণ্যের কাছাকাছি র‌্যাকে রাখা হয় নতুন নতুন সব বই, লোভনীয় দামে। লোকজন আক্ষরিক অর্থেই বইয়ের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।

আরও পড়ুনঃ সেই রতনের অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ

বইমেলার প্রাক্কালে আইসল্যান্ডের পুস্তক-বন্যার উদাহরণ দিচ্ছি, কারণ বাংলাদেশে পুস্তকপাঠের খরা চলছে বহুদিন যাবৎ। কে না স্বীকার করবে, জনগণের সাংস্কৃতিক মান বাড়াতে হলে, আম জনতাকে যৌক্তিক মননের অধিকারী হিসেবে গড়ে তুলতে হলে, বইপড়ার বিকল্প নেই। আমরা ঘটা করে বইমেলার আয়োজন করি বটে, কিন্তু মেলায় বই বিক্রির মোট অর্থের পরিমাণ, সলিমুল্লাহ খান যেমনটা বলেছেন তার সাম্প্রতিক এক রচনায়, গুলশানে মওদুদ আহমদের দখল করা ও বেদখল হওয়া বাড়ির বাজারমূল্যের চেয়েও কম।

বাংলাদেশের বেশিরভাগ বই মানসম্মত নয়। বিখ্যাত প্রকাশকেরাও জানেন না বইয়ে নতুন একটি লেখা বাম দিক থেকে বা জোড় পৃষ্ঠা থেকে শুরু হতে পারে না। পেজমেকিং-এ বিধবা বা এতিম নিয়ন্ত্রণ সম্বন্ধে কোনো ধারণাই নেই উভয় বঙ্গের প্রকাশকদের, অর্থাৎ তারা জানে না যে পৃষ্ঠাশেষের বা পৃষ্ঠাশুরুর প্যারাগ্রাফে কমপক্ষে দুই লাইন থাকতে হয়। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, বাংলাদেশের প্রকাশকদের একটি বড় অংশ অসাধু ও তস্কর প্রকৃতির। কাগজের মূল্য, মুদ্রণের টাকা, বাঁধাইয়ের পারিশ্রমিক সবই তারা সময়মতো পরিশোধ করে। পরিশোধ করে না শুধু লেখকের সম্মানী। অধিকাংশ প্রকাশক লেখকের সঙ্গে চুক্তি পর্যন্ত করে না। যে যৎসামান্য সম্মানী দেবার কথা লেখককে তাও দেয় না, বিক্রির হিসাব দেয়াতো দূর কী বাত।

এভাবে লেখককে ঠকিয়ে বাংলাদেশের প্রকাশনা কখনই শিল্প হয়ে উঠবে না, বলা বাহুল্য। যেসব প্রকাশক লেখকের সঙ্গে চুক্তি করে না কিংবা লেখকের সম্মানী পরিশোধ করে না, একুশের বইমেলায় সেই সব অসাধু ও তষ্কর প্রকাশককে স্টল দেয়া বন্ধ করার প্রস্তাব করছি। বই মূলত লেখকের সৃষ্টি। লেখককে যারা অসম্মান করে, বাংলা একাডেমির কোনো প্রকার সুবিধা যেন সেই সব অসভ্য প্রকাশক না পায়।

প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককে প্রতি মাসে সরকার গবেষণা বাবদ হাজার পাঁচেক টাকা দিয়ে থাকেন। বই কেনার জন্যেও টাকা দিয়ে থাকে বছরে অন্তত এক বার। সব শিক্ষক এই টাকায় বই কিনলে বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্প পূর্ণ বিকশিত হবার কথা। আশির দশকে ধ্বংস হওয়া স্কুল পাঠাগারগুলো পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে। প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি মাসে বইমেলা থেকে বই কেনার জন্যে সরকারি বরাদ্দ দেয়া যেতে পারে। স্থানীয় উদ্যোগেও বই কেনা যেতে পারে সরকারি টাকায়। পুস্তক ক্রয়ের ক্ষেত্রে অনিয়ম নিয়ন্ত্রণ করার জন্যে খুব সতর্কভাবে নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। বই পড়া প্রতিযোগিতা হতে পারে প্রতি বছর, সমাজের সর্বস্তরে।

জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনের জন্যে সমাজে বইপড়ার অভ্যাস গড়ে তোলার বিকল্প নেই। বাংলাদেশের পুস্তক-খরা বা পাঠ-খরার সমস্যা সমাধানে আইসল্যান্ডের পুস্তক-বন্যা একটি চমৎকার অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হতে পারে।

শিশির ভট্টাচার্য্য অধ্যাপক, আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

 

সংবাদটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

1 × two =