লেখালেখি

একজন কিংবদন্তী চিকিৎসকের সতর্কতা

একজন কিংবদন্তী চিকিৎসকের সতর্কতা
ছবিতে ডানে ডা. লি ওয়েং

একজন কিংবদন্তি চিকিৎসকের সতর্কতা এবং আজকের করোনাভাইরাস

জানুয়ারির পর্যন্তও চীনের উহান সিটি কতৃপক্ষ ভয়াবহ করোনাভাইরাস সংক্রমণের বিষয়টি গোপন রাখতে চেয়েছিলো। শুধু তাই নয় ডা. লি ওয়েং লিয়াং নামের একজন অপথালমোলজিস্ট; বিশেষজ্ঞ চিকিৎসককে হাসপাতাল পুলিশ শাসায়। তার অপরাধ ছিলো, তিনি সবাইকে এ নতুন রহস্যময় এক ভাইরাসটির সংক্রমণের ব্যাপারে এসএমএস ও ব্যক্তিগত সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে সতর্ক করছিলেন।

চিকিৎসার ডা. লি ওয়েং খেয়াল করলেন নতুন আক্রান্ত কিছু রোগী রহস্যময় উপসর্গের নিয়ে আসছে। তিনি তড়িৎ সচেতন ও সতর্কতার আহবান জানালে চায়না পুলিশ তাকে অযথা ‘গুজব ছড়ানোর’ অভিযোগে গ্রেফতার করে। তার কাছ থেকে মুচলেকা নেয়। পাশাপাশি অযথা ‘সচেতনতার’ নামে গোয়ার্তুমী দেখালে আর গুজব ছড়াতে থাকলে তার বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেবারও হুঁশিয়ারী দিয়ে যায়। ঘটনাটি একেবারে শুরুতে যখন মাত্র কয়েকজন করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগী হাসপাতালে আসা শুরু করেছেন।

ডা. লি কাজ করতেন উহান সিটির কেন্দ্র স্থলে। ডিসেম্বরে তিনি খেয়াল করলেন, যে সকল নতুন রোগী জ্বর সর্দি কাশি নিয়ে ভর্তি হচ্ছেন তাদের উপসর্গগুলোর মধ্যে অদ্ভুত একটা মিল রয়েছে। ২০০৩ সালের মহামারী সার্স (সেভেয়ার এক্যুইট রেস্পিরেটরী সিনড্রোম) রোগের উপসর্গের মতো। তিনি এও দেখলেন আক্রান্ত রোগীদের সকলেই উহান সিটির হোয়ানান বাজারে আশপাশের যেখানে সাপ, বাদুড়, শিয়াল, কুকুর ইত্যাদি হিংস্র প্রাণির অঙ্গপ্রতঙ্গ খাবারের জন্যে বিক্রি হয়।

সচেতন বিদগ্ধ পন্ডিত ডা. লি তাই বার বার উদ্যোগী হয়ে সকল সহকর্মীদের গোপনে সতর্ক করতে লাগলেন এ সংক্রমনের ব্যাপারে এবং এও বললেন সবাই যেনো প্রোটেকটিভ ব্যবস্থা নিয়ে চিকিৎসা প্রদান করেন। তার কাছে নতুন রোগটি ভালো ঠেকছে না।

ডা. লি এর সতর্ক বাণীকে পুলিশ ভুল বুঝে। তারা গুজব ছড়ানোর অভিযোগে তাকে থানায় ডেকে নেয়। তার বিরুদ্ধে চরম বিমাতা সুলভ আচরণ করে। রীতিমত শাসায়, তাচ্ছিল্য ও অপমান করে।

পুলিশের ভাষা ছিলো এরকম, ‘আমরা তোমাকে ফের সতর্ক করছি ডা. লি. ওয়েং, যদি তুমি তোমার ‘গোয়ার্তমি’ বন্ধ না করো, ‘ভ্রান্ত তথ্য’ আর ‘গুজব’ ছড়াতে থাকো তাহলে তোমাকে আমরা আদালতের কাঠ গড়ায় তুলবো।

দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে ডা. লি বন্ড সই দিলেন ‘ঠিক আছে আমি আর কাউকে সতর্ক করবো না’।

কিংবদন্তীরা আসলে থেমে থাকেন না। ডা. লি ওয়েং ও থেমে যাননি। প্রতিকুলতায় হয়তো একটু চুপ ছিলেন। কিছুদিন পরই ডা. লি ওয়েং পুরো ঘটনার রোগগুলোর বিবরণ এবং তার সাথে কি কি আচরণ হয়েছে এ নিয়ে তাদের চীনা জনপ্রিয় সোশ্যাল মাধ্যম ‘ওয়েবো’ তে সব প্রকাশ করে দেন। শুধু তাই নয় ডা. লি. মনের দুঃখে সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি ব্যাঙাত্মক কুকুরের কার্টুনও আপলোড করেন। কুকুর টির বড় বড় চোখ। সেগুলো উল্টানো আর তার লক লকে বড় জিহবাটা বের করা।

সাথে সাথে সেটা হাজারো ফলোয়ার ফ্রেন্ডস ও উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নজরে আসে। তোরজোড় পড়ে যায় এ নিয়ে। হাজার হাজার লাইক কমেন্টস পড়ে। ভাইরাল হয়। অনেকে দুঃখ করে কমেন্ট করেন, ‘পন্ডিত চিকিৎসক ব্যক্তিবর্গের সাথে এমন মূর্খ আচরণ করলে সাধারণ জনগণ বা রোগী বাঁচবে কি করে’

সে সময় জীবনের তোয়াক্কা না ডা. লি যা করেছিলেন তা সত্যিকার অর্থেই ইতিহাস। যুগে যুগে চিকিৎসকরাই এভাবে ইতিহাস তৈরি করেন।

আমাদের মহান ভাষা আন্দোলন, মহান মুক্তিযুদ্ধ ও একই স্বাক্ষ্য দেয়। ভাষা আন্দোলনে ১৪৪ জারি চুরমার করে ভেঙে দিয়েছিলো ঢাকা মেডিকেলের চিকিৎসকরা, মহান মুক্তযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ে শহীদ হয়েছে দেশের অনেক বিদগ্ধ পন্ডিত চিকিৎসক, ৯০ এর গণতন্ত্রে জীবন দিয়েছেন ঢাকা মেডিকেলের চিকিৎসক ডা. মিলন।

যাহোক পরের কাহিনী ইতিহাস হয়ে যায়। ডা. লি-কে ‘হিরো’ আখ্যা দেওয়া হয়। তার কাছে কর্তৃপক্ষ তাদের অজ্ঞতা আর গর্হিত আচরণের জন্যে বার বার নিঃশর্ত ক্ষমা চায়। করোনাভাইরাস সনাক্ত হয়। কিন্তু ততক্ষণে বড্ড দেরি হয়ে যায়। এক মাস সময় ভাইরাসের ছড়াতে অনেক সময়। করোনাভাইরাস ছড়িয়ে সারা উহান শহর, উবেই প্রোবিন্স এমন কি চীনের বাইরে।

কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা, অসচেতনতা আর মূর্খতার জন্যে হাজার হাজার চীনা নাগরিক আজ করোনাভাইরাস এ আক্রান্ত। মারা যাচ্ছেন শত শত। সারা বিশ্বে করোনাভাইরাস ছড়িয়েছে চীন থেকে। যা এখোনও চলমান। চীনের বাইরে ফিলিপাইনেও গেলো দুদিন আগে মারা গিয়েছেন এক রোগী।

ডা. লি এর প্রতি বিমাতা সুলভ আচরণের জন্যে চীন তার প্রায়শ্চিত্ত করছে। বিশ্ব থেকে ‘পরাশক্তি চীন’ এখন কার্যত আলাদা। যেনো এক মৃত্যুপূরী।

বিদেশের কোন নাগরিক যেমন চীনে যেতে পারছে না, তেমনি চীন থেকে কোন নাগরিক আসতে পারছে না। ব্যবসা বাণিজ্য বন্ধ। চীন কার্যত অচল।

লেখক: ডা. সাঈদ এনাম

অথচ ডা. লি এর পরামর্শ শুনে তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা নিলে হয়তো জল এতটুকু গড়াতো না।

ডা. লি একজন চক্ষু বিশেষজ্ঞ সার্জন। তার কাজ ছিলো চোখের রোগীর চিকিৎসা। তার অতশত ভাববার দরকার ছিলো না। কিন্তু তিনি ছিলেন একজন দেশপ্রেমিক সচেতন নাগরিক। তিন যা করেছেন তা দেশের মানুষের জন্যে করতে চেয়েছেন।

এক পর্যায়ে একজন করোনা আক্রান্ত চক্ষু রোগীর চিকিৎসা করতে যেয়ে ডা. লি ও করোনাভাইরাস এ আক্রান্ত হন। তিনি সুস্থ আছেন।

সিম্পটম না থাকলেও একজন করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগী ভাইরাস ছড়াতে পারেন, যা হয়েছে জার্মানিতে। এক চীনা মহিলা জানুয়ারির মধ্য সময়ে জার্মানিতে একটা ব্যবসায়ীক মিটিং এ গিয়েছেন। চীনে ফিরে এসে তার দেহে করোনাভাইরাস সনাক্ত হয়। পরে দেখা গেলো জার্মানির সেই ব্যবসায়ী তার পরিবার ও সহকর্মীদের দেহেও ধীরে ধীরে করোনাভাইরাস এর উপসর্গ প্রকাশ পেতে থাকে।

করোনাভাইরাস আক্রান্তরা হাচি কাশি ও মলের সাথে সংস্পর্শে থাকা ব্যক্তদের মধ্যে করোনাভাইরাস ছড়ান। নির্গত হাচি কাশির মাঝে পরিবেশে করোনাভাইরাস কয়েক ঘন্টা থেকে মাস পর্যন্ত বেঁচে থাকে।

আক্রান্তদের সর্দি কাশি উপসর্গ নাও থাকতে পারে। তাই আক্রান্তদের বা সন্দেহজনকদের মাস্ক ব্যবহার করতে হয়, তাদের থেকে ন্যূনতম ২ মিটার দূরে থাকতে হয় সুস্থদের।

আক্রান্তদের সাথে ঘনিষ্ঠ মেলামেশায় করা যাবে না। রোগীদের চিকিৎসার জন্যে আইসোলেশন করতে হয়। সন্দেহজনক রোগীদের কোয়ারেন্টাইনে রাখতে হয়।

চিকিৎসায় চিকিৎসকদের মাস্ক, গ্লাভস, চোখে গ্লাস ও বিশেষ পোশাক পরিধান করতে হয়।

এসব ব্যবস্থা নিতে কোনো প্রকারের অবহেলা করলে রক্ষা হবে না। রোগী বা চীনে ভ্রমণ করেছেন এমন সন্দেহজনকদের নিয়ে অযথা কোন প্রকারের সস্থা আবেগ, আহলাদ কে করোনাভাইরাস মোটেই তোয়াক্কা করবে না।

ডা. সাঈদ এনাম ডিএমসি, কে-৫২

সাইকিয়াট্রিস্ট

সহকারী অধ্যাপক, সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ

 

আরও পড়ুনঃ

সর্বশেষ সংবাদ                                 

কানাডার সংবাদ

দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে cbna24.com 

 

 

সংবাদটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

2 × four =