ষোল আনা

এসেছি সেবা দিতে

বাংলাদেশে ৫৫ বছর সিস্টার রোজ ‘এসেছি সেবা দিতে, যত দিন বাঁচব তা-ই করে যাব’ পেশায় নার্স রোজ শুধু অসুস্থদের সেবা দিয়েই দায়িত্ব শেষ করেননি।

বাংলাদেশে ৫৫ বছর সিস্টার রোজ ‘এসেছি সেবা দিতে, যত দিন বাঁচব তা-ই করে যাব’

পেশায় নার্স রোজ শুধু অসুস্থদের সেবা দিয়েই দায়িত্ব শেষ করেননি। মেহেরপুরের মুজিবনগরের নিভৃত পল্লী বল্লভপুর মিশন হাসপাতালের এই কর্মী রোগীদের সেবার পাশাপাশি গড়ে তুলেছেন কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। ওই হাসপাতালে নিজ প্রচেষ্টায় স্থাপন করেছেন স্পেশাল বেবি কেয়ার ইউনিট। বিভিন্ন এলাকার শিশুরা কম খরচে এখানে সেবা পাচ্ছে। প্রায় ১৭ বছর হলো হাসপাতালে ‘জি ওয়ার্ড’ নামে একটি বৃদ্ধাশ্রমও চালু করেছেন, যেখানে বর্তমানে ১৮ জন নিবাসী রয়েছেন। হাসপাতালের সঙ্গে নার্সিং প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটও প্রতিষ্ঠা করেছেন নার্স রোজ। বর্তমানে সেখানে ৯৬ জন প্রশিক্ষণার্থী রয়েছেন। এখান থেকে প্রতিবছরই প্রশিক্ষণ শেষে নিজের পায়ে দাঁড়াচ্ছেন অনেকে। স্থানীয় ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের জন্য গড়ে তুলেছেন কম্পিউটার ট্রেনিং সেন্টার। সেখানে ১৬ জন প্রশিক্ষণার্থী রয়েছেন।

বল্লভপুর মিশন হাসপাতালের ফার্মাসিস্ট সুজিত মণ্ডল জানান, ইংল্যান্ডে জন্ম নেওয়া রোজ সিস্টার ২২ বছরের বেশি সময় ধরে এই হাসপাতালে নার্স হিসেবে কাজ করছেন। এর পাশাপাশি অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোও তত্ত্বাবধান করেন মমতা দিয়ে, নিষ্ঠার সঙ্গে। তিনি জানান, রোজ সিস্টার এই মিশন হাসপাতালের প্রাণ।

জিলিয়ান এম রোজ ওরফে রোজ সিস্টারের বয়স এখন ৮০ বছর ছুঁই ছুঁই। ধর্মপ্রচারের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশে এসেছিলেন। একপর্যায়ে জড়িয়ে পড়েন চিকিৎসাসেবায়। ১৯৮১ সাল থেকে সেবিকা হিসেবে মিশনারি হাসপাতালে যোগ দেন। মানুষের সেবায় আত্মনিবেদিত এই মানুষটি এখন এলাকায় একনামে রোজ সিস্টার হিসেবে পরিচিত।

রোজের বাবা সিএ রোজ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন। ১৯৩৯ সালে দক্ষিণ ইংল্যান্ডে জন্ম নেওয়া রোজ ছোটবেলায়ই বাবাকে হারান। মায়ের সংসারে একমাত্র ভাইয়ের সঙ্গে ভালোই চলছিল রোজের। তরুণ বয়সেই নিয়ে ফেলেন জীবনের গুরুত্বপূর্ণ এক সিদ্ধান্ত। তা হচ্ছে খ্রিস্টধর্ম প্রচারে আত্মনিয়োগ। ১৯৬৪ সালে ২৫ বছর বয়সে খ্রিস্টের বাণী প্রচারের উদ্দেশ্যে ইংল্যান্ড ছেড়ে চলে আসেন এ দেশে। ১৯৮১ সালে ধর্মপ্রচার ছেড়ে সরাসরি চিকিৎসাসেবার মাধ্যমে মানবসেবার সিদ্ধান্ত নেন রোজ। নার্স হিসেবে শুরু করেন মানবসেবা। মাঝখানে ১৯৮৬ সালে বয়োবৃদ্ধ মায়ের সেবার জন্য দেশে ফিরে যান। তবে মা মারা গেলে ওই বছরই ফিরে আসেন বাংলাদেশে। এরপর প্রায় তিন দশকের অধিক সময় ধরে বল্লভপুর মিশন হাসপাতালে সেবিকা হিসেবে সেবা দিচ্ছেন। মানবসেবায় নিবেদিত এ মানুষটির ব্যক্তিগত জীবনে সংসারী হয়ে ওঠা হয়নি। তাঁর একমাত্র ভাই ডক্টর ডি এ রোজ ইংল্যান্ডে থাকেন পরিবার নিয়ে।

তিনি বল্লভপুর মিশন হাসপাতাল থেকে কোনো বেতন নেন না, ব্রিটিশ সরকারের পেনশনে চলে রোজের সংসার। অন্যদিকে বিভিন্ন দাতা সংস্থা থেকে কিছু অর্থ নিয়ে ও নিজের থেকে কিছু অর্থ দিয়ে বল্লভপুর মিশন হাসপাতালের দরিদ্র রোগীদের সেবা দেন তিনি।

কথা হয় জিলিয়ান এম রোজের সঙ্গে। বয়সের ভারে ন্যুব্জ তবুও কর্মচঞ্চল রোজ বলেন, ‘মানবসেবাই হচ্ছে পরম ধর্ম। সেবার মধ্য দিয়ে ঈশ্বরকে পাওয়া যায়। আমার এই সেবার কার্যক্রমে পরিবারের লোকজনও সন্তুষ্ট। আমি যত দিন বেঁচে থাকব, তত দিন এভাবে সেবা দিয়ে যাব। পৃথিবীতে এসেছি সেবা দিতে। বৃদ্ধদের জন্য কেউ কিছু করে না। তাই আমি নিজে একটি বৃদ্ধাশ্রম খুলেছি। সেখানে তাঁরা যেন ভালোভাবে মৃত্যুবরণ করতে পারেন।’

আরও পড়ুনঃ যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসী হামলা, নিহত ২

রোজ সিস্টার হাসপাতালের রোগী ও প্রশিক্ষণার্থীদের সঙ্গে মায়ার বন্ধনে আবদ্ধ। মানবসেবায় তিনি যেমন পেয়েছেন আত্মার প্রশান্তি, তেমনি হয়ে উঠেছেন সবার আপনজন। সেবা দিতে গিয়ে এলাকার মানুষের সঙ্গে গড়ে উঠেছে তাঁর আত্মার সখ্য। অশীতিপর এই বয়সে চলার শক্তি অনেকটা কমে গেলেও দমে যাননি শীর্ণকায় এই আত্মপ্রত্যয়ী নারী।

তবে নিজ দেশ ছেড়ে সুদূর এই দেশে মানুষের সেবায় নিয়োজিত থাকলেও পাঁচ বছর পর পর পাসপোর্ট নবায়ন করতে গিয়ে রোজকে পড়তে হয় বিড়ম্বনায়। নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করেছেন। কিন্তু ইতিবাচক সাড়া এখনো পাননি। তাঁকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দিলে একদিকে ভিসা জটিলতা থেকে তিনি মুক্তি পেতেন, অন্যদিকে মানবসেবী এই নারীকে প্রকৃত সম্মানও দেওয়া হতো বলে বলে মনে করেন স্থানীয় ইউপি সদস্য শংকর বিশ্বাস। বল্লভপুর মিশন হাসপাতালের সব কার্যক্রম চলে চার্চ অব বাংলাদেশের অনুমোদনে। ১৯৮৯ সালে চার্চ অব বাংলাদেশ খ্রিস্টানপ্রধান বল্লভপুরে প্রায় তিন একর জমির ওপর এ হাসপাতালটি প্রতিষ্ঠান করেন।

এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে নার্সিং প্রশিক্ষণের ছাত্রী মেরি মণ্ডল ও শিলা মণ্ডল বলেন, ‘জুলিয়ান এম রোজ একটি আদর্শ। আমাদের মায়ের মমতা দিয়েই কাজ শেখান তিনি। তাঁকে আদর্শ হিসেবে নিয়ে আমরাও তাঁর মতো জীবন গড়তে চাই।’

বাগোয়ান ইউপি চেয়ারম্যান আইয়ুব হোসেন জানান, এখানে সেবা নিতে আসা রোগীদের সঙ্গে জুলিয়ান এম রোজের এক প্রকার সখ্য গড়ে উঠেছে। মায়ের মমতা মাখা হাত দিয়ে চব্বিশ ঘণ্টা সেবা দিয়ে যাচ্ছেন তিনি। সেবা করতে গিয়েই এলাকার মানুষের হৃদয়ে এক অন্য রকম জায়গা করে নিয়েছেন রোজ। এলাকার রোগী ও সাধারণ মানুষ জিলিয়ানকে খুবই আপনজন হিসেবে দেখে। মেহেরপুরের জেলা প্রশাসক আতাউল গনি বলেন, ‘জিলিয়ান এম রোজ বাংলাদেশকে ভালোবেসে দীর্ঘদিন ধরে গ্রামীণ মানুষকে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। এটা আমাদের জন্য অত্যন্ত গর্বের বিষয়।’

দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে 

সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব

সংবাদটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

five × three =