ওল কচু বাংলাদেশের একটি জনপ্রিয় সবজি। এটি সাধারণত সেদ্ধ, ভাজা বা তরকারি হিসাবে খাওয়া হয়। ওলকচু দেখতে অনেকটা হাতির পায়ের নীচের অংশের মত তাই ইংরেজিতে এটিকে Elephant Foot Yam বলে এবং এর বৈজ্ঞানিক নাম Amorphophallus paeoniifolius. এর অনেক ঔষুধি গুনাগুণ ও রয়েছে তাই আয়ুর্বেদ, সিদ্ধ এবং ইউনানী চিকিৎসা শাস্ত্রে এর ব্যপক ব্যবহার রয়েছে। পেটের পীড়া, ফোড়া, হাঁপানিরোগ, গোদ, অর্শরোগ, বাত, বমি হওয়ার উদবেগ, রক্তের ব্যাধি ইত্যাদি সারাতে ওল কচু বেশ কার্যকরি।
ওল কচু খাওয়ার উপকারিতা
বাংলায় একটি প্রবাদ আছে “যেমন বুনো ওল, তেমনি বাঘা তেতুল”। ওলে চুলকানি আছে এবং তেতুলে তার নিস্তার আছে বলেই এমন প্রবাদের প্রচলন। তবে এর চুলকানী গুনের আড়ালে রয়েছে দেশিও খাবারের স্বাদ ও অনেক অনেক গুনাগুণ।
কোলেস্টেরল কমাতে : মানুষের দেহে দুই ধরনের কোলেস্টেরল রয়েছে, একটি ভাল এবং আরেকটি খারাপ। খারাপ কোলেস্টেরল বৃদ্ধি পেলে উচ্চ রক্তচাপ বাড়তে শুরু করে এবং হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ে। ওলে শক্তিশালী অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি যৌগ রয়েছে যা খারাপ কোলেস্টেরল হ্রাস করে হার্ট অ্যাটাক ও উচ্চ রক্তচাপ থেকে রক্ষা করে।
ক্যান্সার প্রতিরোধে : সঠিক সময়ে ক্যান্সারের চিকিৎসা না করা হলে রোগীর মৃত্যু অনিবার্য। ওল ক্যান্সারজনিত টিউমার গঠন রোধে অত্যন্ত উপকারী। কারণ ওলে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে যা কোষকে ক্যান্সার থেকে রক্ষা করে।
ওজন কমাতে : এতে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার রয়েছে, এছাড়াও এতে ক্যালোরি কম থাকে যা ওজন কমাতে উপকারী। তবে খেয়াল রাখা ভালো এটি বেশি তেলে ভাজবেন না। যারা ওজন কমানোর বিষয়ে ভাবছেন, তাদের জন্য ওল ভাল বিকল্প হতে পারে।
ডায়াবেটিক নিয়ন্ত্রণে উপকারী : ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য ওল কচু খুব উপকারী। সঠিক পরিমাণে ওল গ্রহণ করলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকে। এটি রক্তের শর্করার মাত্রা কমাতে সহায়তা করে। আপনি যদি ডায়াবেটিস রোগী হন তবে অবশ্যই এটি আপনার ডায়েটে অন্তর্ভুক্ত করুন।
স্ট্রেস উপশম ও ক্লান্তি দূর করতে : ওল কচুতে স্ট্রেস-এন্টি প্রপার্টি রয়েছে যা স্ট্রেস উপশম করতে সহায্য করে। কিছু গবেষণায় এটিকে স্ট্রেস উপশমের জন্য ভাল ঘরোয়া টোটকা বলা হয়েছে। এতে ভিটামিন এ, পটাসিয়াম এবং আয়রন রয়েছে যা আপনার দেহে শক্তি সরবরাহ করে এবং আপনার মেজাজ পরিবর্তন করে। ক্লান্তি দূর করতে আপনাকে সহায়তা করে।
বাতের ব্যথায় : কিছু গবেষণা অনুসারে বাতের ব্যথায় এই সবজিটি খেলে ব্যথার সমস্যা থেকে মুক্তি মেলে। ব্যথা হ্রাস এবং বাত জনিত প্রদাহ উপশমের বৈশিষ্ট্য ওলে রয়েছে।
কোষ্ঠকাঠিন্য দূরীকরণে : ওল ৭৫-১০০ গ্রাম ওজনের ছোট ছোট টুকরা করে, মুখী বাদ দিয়ে, মাটি লেপে, রোদে হালকা শুকিয়ে, চুলায় পুড়িয়ে, ঘি দিয়ে মেখে খেলে কোষ্ঠকাঠিন্য ভালো হয়।
ওল কচু খাওয়ার অপকারিতাঃ
- হাঁপানি ও সাইনাসে আক্রান্তদের ওল কচু না খাওয়াই উচিত। এতে হাঁপানি ও সাইনাস সমস্যা বৃদ্ধি পেতে পারে।
- ওল প্রাকৃতিক ভাবে শীতল সবজি, তাই স্তনপান করানো মায়েদের এটি খাওয়া উচিত নয়। এতে মা ও শিশুর ঠান্ডা লাগা জনিত সমস্যা দেখা দিতে পারে।
- এছাড়াও ওল কচু খেয়ে কোন সমস্যা অনুভব করলে খাওয়া বাদ দিন এবং ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
ওল কচু চাষ পদ্ধতি
বানিজ্যিকভাবে ওল কচু চাষ লাভজনক। বহু কৃষককের ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে দিয়েছে এই সবজিটি। এই সবজি চাষে পোকা-মাকড়ের বালাই নাই, রোগ-বালাই কম হয়, গরু-ছাগলেও এ গাছ খায় না। পরিত্যাক্ত আধা ছায়া জায়গাতেও এটি হয়, রোদ্রে ফলন ভালো হয়।
ওল কচুর জাত : দেশে অনেক ধরনের ওল চাষ হলেও বর্তমানে ১। মাদ্রাজী ওলকচু ২। বারি ওলকচু সবথেকে বেশি চাষ করা হয়।
মাদ্রাজী ওলকচু : “মাদ্রাজী” ওলের চাহিদা দিনে দিনে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এটি খেতে নরম ও সুস্বাদু হওয়ায় বাজারে বেশ চাহিদা রয়েছে। প্রতিটা গাছ থেকে ৭-১৫ কেজি পর্যন্ত ফলন পাওয়া সম্ভব। আবহাওয়া ও পরিচর্যা ভালো হলে এই জাত বিঘায় ১৫০ মন পর্যন্ত ফলন দিয়ে থাকে।
বারি ওলকচু : বাংলাদেশ কৃষি গবেষণার বারি ওল-১ জাতের ফলন হেক্টর প্রতি ৪৫-৫৫ মে.টন আর বারি ওল-২ জাতের ফলন ৩৫-৪৫ মে.টন।
ওল রোপনের পদ্ধতি ও সময় : চৈত্র-বৈশাখ মাসে ওল লাগানোর সময় হলেও বাজারে ভালো দাম পেতে আগাম চাষের জন্য মাঘ-ফাল্গুন মাসে বীজ লাগানোই উত্তম। সব ধরনের মাটিতেই ওল চাষ করা যায়, তবে বেলে-দোআশ মাটিতে ভালো ফলন হয়। ওল বা মুখা কার্বেন্ডাজিমে শোধন করে উচু জমি, যেখানে পানি জমে থাকে না এমন জায়গায় লাগাতে হবে। ওলের বীজ বড় হলে ফলনও ভালো হয়। ৪০০-৮০০ গ্রাম ওজনের বীজ লাগানো উত্তম। বীজের সাইজ অনুযায়ী ছোট ৫০-৮০ সে.মি. দুরে দুরে লাগাতে হবে।
ওল গাছের পরিচর্যা: ওল গাছের নিয়মিত আগাছা পরিষ্কার করতে হবে, মাটি দিয়ে গোড়া উচু করে দিতে হবে ও গোড়ায় খড় বা আচ্ছাদন দিয়ে ঢেকে দিলে ভালো ফলন পাওয়া যায়। ওল চাষে জৈব সার বেশি ব্যবহার করা ভালো তবে কিছু রাসায়নিক সার যেমন ইউরিয়া, পটাশ, টিএসপি সারও পরিমাণমত দেওয়া যায়। ওল গাছের তেমন কোনো রোগ-বালাই নেই, তবে পাতা ও কান্ড পচা রোগ দেখা যেতে পারে। এর জন্য ডায়থেন এম-৪৫ ছত্রাকনাষকটি দেয়া যেতে পারে।
বীজ লাগানোর ৭-৯ মাস পর যখন গাছের পাতা হলুদ হয়ে যাবে, তখন ওল সংগ্রহ করতে হবে। ওলের চার পাশের ছোট ছোট মুখাগুলো পরবর্তী বছরের বীজ তৈরীর জন্য রেখে দিতে হবে। সেগুলো প্রথম বছরে ঘন করে লাগিয়ে বেছন তৈরী করে দ্বিতীয় বছরে বানিজ্যিকভাবে লাগাতে হবে।
ওল কচু একটি লাভজনক ও অত্যন্ত গুনাগুন সম্পন্ন সবজি। বর্তমানে এর বাণিজ্যিক চাষে অনেকেই-লাভবান হচ্ছেন। অনেকে আবার বাড়ির আশে-পাশে, উঠানে এবং ছাদেও চাষ করছেন। তাই বেকার বসে না থেকে অধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ করি, বেকারত্ব দূর করি, দেশের খাদ্য ও পুষ্টির চাহিদা পূরণ করে একটি সুস্থ্য-সুন্দর বাংলাদেশ গড়ি।