ফিচার্ড মত-মতান্তর

কন্স্যুলেট জেনারেল অব বাংলাদেশ : কানাডা প্রবাসী বাংলাদেশীদের সেবায় এক অনন্য দৃষ্টান্ত

কন্স্যুলেট জেনারেল অব বাংলাদেশ : কানাডা প্রবাসী বাংলাদেশীদের সেবায় এক অনন্য দৃষ্টান্ত ||| মো: মাহমুদ হাসান

প্রিয় মাতৃভূমিকে কে না ভালোবাসে!! তবুও প্রবাসী বাংলদেশীদের অনুভূতিগুলো একটু অন্য রকম বই কি? রুটিনে বাঁধা প্রবাস জীবনে ধুলোমাখা বাংলার মতো সকাল বিকেল, যখন তখন চায়ের দোকানের আড্ডা যেমন নেই, তেমনি সুখ-দুঃখ, উৎসব আমেজে পাড়া-পড়সীর হ্রদয় নিংড়ানো ভালোবাসাও খুঁজে পাওয়া ভার। সব কিছুতেই সময়ের তাড়া নিয়ে দৌড়ঝাপ যখন নিত্যসঙ্গী, সেই সময়ে করণিক জটিলতা যেমন মনের দুঃসহ যন্ত্রণাকে বহুগুণে বাড়িয়ে দেয় আবার দেশমাতৃকার যে কোন সুসংবাদ সকল যাতনার তাৎক্ষনিক অবসান ঘটিয়ে হ্রদয়, মনের আনন্দকেও বাড়িয়ে দেয় বহুগুণে।

ওয়ালমার্ট, হাডসন বে, টমি হিলফিগার এর মতো মেগা শপগুলোয় স্তরে স্তরে সাজানো বাংলাদেশী পণ্যের শেল্ফগুলোতে ক্রেতার ভিড় দেখে প্রবাসী বাংলাদেশী মানুষগুলোর মনে যেমন আনন্দের শিহরণ জাগে, ঠিক তেমনি নিজের টাকায় নির্মিত পদ্মা সেতুর কথা শুনে গর্বে বুক ভরে যায়। রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে, মাইনাস তাপমাত্রার হাড়কাঁপানো শীতকে উপেক্ষা করে অর্জিত ডলার, রিয়াল দেশে পাঠিয়েও মনের আনন্দে দেশকে নিয়ে কল্পনার জাল বুনে। প্রবাসের অফিস, আদালত, ব্যবসা, প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের আচার-আচরণে বিস্মিত হয়ে রাতজেগে এই মানুষগুলোই আবার আফসোস করে- নিদেনপক্ষে আমার দেশের এয়ারপোর্টে আর প্রবাসে বাংলার দুতাবাসের মানুষগুলো যদি এমন হতো!!

আগষ্ট ২৪, ২০২১ অবধি বাংলাদেশ ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ আটচল্লিশ দশমিক শুন্য চার বিলিয়ন ইউএস ডলার, যা পাকিস্তানের রিজার্ভের চেয়ে তিনগুণ বেশি। সরকার প্রত্যাশা করছে অর্থ বছরের প্রান্তিকে এটি বায়ান্ন বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে। আর এমন খুশির খবরে মান্যবর অর্থমন্ত্রী প্রবাসী বাংলাদেশীদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা, কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানিয়েছেন। এই খবরে প্রবাসী বাংলাদেশিরা আনন্দিত হয়েছে বটে, তবে সেই সাথে একটু সুব্যবহার আর সম্মান প্রাপ্তির প্রত্যাশাটাও বেড়েছে।

দেশের রেমিট্যান্স প্রবাহে মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজারের ভূমিকা অগ্রগন্য হলেও কুটনৈতিক সম্পর্ক আছে এমন সকল দেশে বসবাসকারী বাংলাদেশীরাই রেমিট্যান্স পাঠিয়ে দেশের উন্নয়নে অসামান্য ভুমিকা রাখছে। সরকারের প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী, পররাষ্ট্র মন্ত্রী সহ দায়িত্বশীলরা প্রবাসীদের এই অবদানকে স্বীকার করলেও সেবা আর সম্মানের প্রশ্নে অগ্রগতি নিতান্তই সামান্য। এখনও আমাদের বিমানবন্দর, প্রবাসের মিশনগুলোর বিভিন্ন সেবা নিয়ে অভিযোগের অন্ত নেই। হাসিমুখে সেবাদানের সংস্কৃতিটি আজও আমাদের দেশে গড়ে উঠেনি। অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি সেবার জগতেও একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন এখন সময়ের দাবী। হরহামেশাই আমাদের বৈদেশিক মিশনের কর্মকর্তাদের সেবার প্রশ্নে নানা অভিযোগ শোনা যায়।

বিদেশে বাংলাদেশের মিশনগুলোতে ঘন্টার পর ঘন্টা ফোন করেও কাউকে পাওয়া যায় না। আবার অগত্যা পেলেও সেবা প্রার্থীর কথা শুনতে চান না। মহাশয় সুলভ আচরণে মনে হয়, মিশনে কর্মরত কর্তা ব্যক্তিরা যেন প্রভূ হয়ে ভৃত্যদের শাসন করতে এসেছেন। বিদেশে বাংলাদেশ মিশনের ওয়েভ রিভিও আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের মন্তব্যগুলো পড়লে এমন হতাশার ভূরি ভূরি প্রমাণ মেলে। জনবলের তুলনায় সেবাগ্রহীতার আধিক্য, অর্থনৈতিক ও কারিগরি সক্ষমতার অভাব নাকি মানসিকতার দৈন্যতা, কোন অজ্ঞাত কারণে ডিজিটাল প্রযুক্তির যুগেও প্রবাসী বাংলাদেশিরা প্রাপ্য সেবা নিয়ে অভিযোগ তুলছেন, এর কারণ অনুসন্ধানে মনোযোগী হতে আরও বিলম্ব কেন?

হতাশা আর অভিযোগের মাঝেও আশার আলো আছে। শুধুমাত্র ইচ্ছা শক্তি দিয়ে প্রবাসের একটি মিশনকে যে সত্যিকারের একটি সেবা কেন্দ্রে পরিণত করা যায়,তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ কানাডার টরেন্টোতে অবস্থিত ‘বাংলাদেশ কন্স্যুলেট জেনারেল’। ঘন্টার পর ঘন্টা ফোন করেও অপর প্রান্ত থেকে জবাব না পাওয়ার অভিজ্ঞতা যখন আমাদের সামনে, অগত্যা জবাব পেলেও কঠোর প্রভূসুলভ আচরণে অপর প্রান্তের রুঢ় ও কর্কশ আচরণে সেবাগ্রহীতারা যখন ভারাক্রান্ত, এমন চিত্রের বিপরীতে সর্ব নিম্ন সময়ে কল রিসিভের নিশ্চয়তা, হাস্যবদনে সেবাগ্রহীতার সন্তুষ্টি অর্জনের প্রানান্তকর প্রচেষ্টার চিত্রকে প্রত্যাশার চেয়েও বেশি বললে অত্যুক্তি হবে কি?

প্রিয় পাঠক, সেবা নিয়ে অভিযোগ করলে কর্তার অসন্তোষের অসংখ্য দৃষ্টান্ত যে সময়ে আমাদের চারপাশে ঘুরে বেড়ায়, এর বিপরীতে গুগল আর ফেসবুকের রিভিও দেখে অসন্তুষ্ট সেবাগ্রহীতার সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে সমস্যা সমাধানের প্রানান্তকর প্রচেষ্টাকে সেবার জগতে অনন্য দৃষ্টান্ত বললে বাড়িয়ে বলা হবে কি? সর্বোচ্চ তিন কর্ম দিবসের মধ্যে যে কনস্যুলার সেবাটি সম্পন্ন হওয়ার কথা, সেটি ত্রিশ দিনেও শেষ হয় না। সমস্যা সমাধানে নির্ভর যোগ্য কোন দায়িত্বশীল কর্মকর্তার সংগে যোগাযোগ স্থাপনে প্রবাসে খেটে খাওয়া মানুষগুলো যখন গলদঘর্ম হয়, এমন দুঃসহ অবস্থার বিপরীতেও টরেন্টোর বাংলাদেশ কন্স্যুলেট জেনারেল অফিস ডাকযোগে প্রেরিত আবেদন প্রাপ্তির সংগে সংগে আবেদনকারীকে ই-মেইল কনফার্মেশন পাঠায়। যে কোন সময়ে অনলাইনে আবেদনের বর্তমান অবস্থান দেখার সুযোগ তো আছেই, পাশাপাশি অতিরিক্ত কোন ডকুমেন্টস বা তথ্যের প্রয়োজন হলে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল কর্মকর্তা আবেদনকারীর সংগে তাৎক্ষনিক যোগাযোগ করে প্রয়োজনীয় পরামর্শ প্রদান করেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও আনন্দের বিষয়, কোন আবেদন বিধি অনুযায়ী প্রত্যাখ্যাত হলেও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার বিনয়ী ও পরামর্শ সুলভ আচরণে সেবাগ্রহীতা সন্তুষ্টচিত্তেই প্রিয় দেশের কন্স্যুলার সেবার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।

একটি কন্স্যুলেট জেনারেলের অফিস যেখানে সেবা গ্রহণ করে প্রবাসী বাংলাদেশীরা মন্তব্য করেন, ‘আন্তরিকতার সাথে এমন দ্রুত ও সহজ সেবা কল্পনাতীত’ ‘মাত্র পনেরো মিনিটে তিনটি পাসপোর্টে এনভিআর’ ‘মাত্র দু’ঘন্টায় পাঁচ জনের ভিসা’ – এমন আরও অনেক অনেক প্রশান্তির বার্তা!! যে কন্স্যুলেটের ৫৬ জন সেবাগ্রহীতার মতামত পর্যালোচনায় দেখা যায় ৯২.৮৫% সেবাগ্রহীতা কন্স্যুলেট সার্ভিসে দারুণভাবে মুগ্ধ, ৭.১৫% সেবাগ্রহীতা প্রাথমিক ভাবে কিছুটা অসন্তুষ্ট হলেও স্বয়ং কন্সাল জেনারেল তাদের সাথে যোগাযোগের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করেছেন। এমন একটি বাংলাদেশী কন্স্যুলেট জেনারেলের অফিস কে ‘বাংলাদেশী সেবার আন্তর্জাতিক মান’ বললে বোধ করি মোটেও অতিশয়োক্তি হবে না।

অর্থনৈতিক আর নানা সামাজিক সূচকে বাংলাদেশের অভূতপূর্ব দৃশ্যমান অগ্রগতির সাথে সাথে প্রবাসী বাংলাদেশিদের সেবায় আরও মনোযোগী হওয়া যখন সময়ের দাবি, সেই মাহেন্দ্রক্ষণে টরেন্টোতে অবস্থিত বাংলাদেশ কন্স্যুলেট জেনারেল- সেবার জগতে নিঃসন্দেহে এক অনন্য মডেল। কন্স্যুলার সেবায় এমন সাফল্য অর্জনে সুদক্ষ একঝাঁক কর্মকর্তাদের সমন্বিত উদ্যোগের পাশাপাশি নিশ্চয় কোন দিক-নির্দেশক দেশ প্রেমিক নেতৃত্ব আড়ালে থেকে কাজ করেছেন। যারা সেবা নিয়েছেন, ভবিষ্যতে সেবা নিতে পারেন আর যারা বাংলাদেশের কন্স্যুলার সেবা নিয়ে আহাজারি করছেন সবার পক্ষ থেকেই বলতে চাই, টরেন্টো কে অনুসরণ করে যদি দেশে দেশে আমাদের বৈদেশিক মিশনগুলো তৎপর হয়ে উঠে নিশ্চয়ই সেদিন বেশি দূরে নয় যখন প্রশান্তির সুরেই আমরা বলবো “বাংলাদেশের কন্স্যুলার সেবা ও এখন আন্তর্জাতিক মানের”।

লেখকঃ কলামিস্ট, উন্নয়ন গবেষক ও সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষক

এস এস/সিএ

সর্বশেষ সংবাদ

দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com

সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

আমাদের ফেসবুক পেজ   https://www.facebook.com/deshdiganta.cbna24 লাইক দিন এবং অভিমত জানান

সংবাদটি শেয়ার করুন