রাজধানীর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে করোনার চিকিৎসা চলছে নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার মাস্টারপাড়ার স্বাস্থ্য সহকারী জাফরুল্লার। ২৬ জুন করোনা পরীক্ষার জন্য তাঁর নমুনা সংগ্রহ করেছিলেন উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রের তাঁরই সহকর্মীরা। ২৯ জুন জানা যায়, তিনি করোনা আক্রান্ত। পরদিন তাঁকে জেলা সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অবস্থা খারাপ হতে থাকলে ২ জুলাই রাতে তাঁকে ঢাকায় পাঠানো হয়। তখন থেকে তিনি কুর্মিটোলা হাসপাতালে।
দক্ষিণের জেলা নোয়াখালীর আরও দক্ষিণের দ্বীপ হাতিয়া। জাফরুল্লাকে নিয়ে এই দ্বীপে এ পর্যন্ত ৩৭ জন রোগী শনাক্ত হয়েছে বলে জানিয়েছেন হাতিয়া উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রের চিকিৎসা কর্মকর্তা মো. নিজামউদ্দীন। এই চিকিৎসা কর্মকর্তাকে করোনাবিষয়ক মুখপাত্রের দায়িত্ব দিয়েছে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ। তিনি বলেন, এই দ্বীপে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয় ২৬ এপ্রিল। ঢাকা থেকে আসা লঞ্চের যাত্রীরাই ছিলেন প্রথম রোগী এবং তাঁদের মাধ্যমেই দ্বীপে করোনা ছড়িয়েছে।
হাতিয়া দ্বীপে প্রায় ছয় লাখ মানুষের বাস। এ পর্যন্ত শনাক্ত হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ছয়–সাতজন উপজেলা সদরে বসবাস করেন। বাকিরা গ্রামের বাসিন্দা। যেসব বাড়িতে রোগী আছেন, সেগুলোর দুই পাশে নোটিশ টাঙিয়ে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। মেডিকেল কর্মকর্তা নিজামউদ্দীন জনান, আক্রান্ত ব্যক্তিদের সংস্পর্শে কত মানুষ এসেছে, তা জানা বা কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং করা সম্ভব হয়নি। কেন সম্ভব হয়নি—এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘সদর থেকে একেকজনের বাড়ি অনেক দূর। ফোন করলে নানা অজুহাতে আসতে চান না। কেউ বলেন কাজ আছে। কেউ ভয়ে আসতে চান না।’
বঙ্গোপসাগরের এই দ্বীপের মতো প্রত্যন্ত এলাকায় কীভাবে করোনা ছড়িয়েছে, তার সঠিক তথ্য ও ব্যাখ্যা কেন্দ্রীয়ভাবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কাছে নেই। মোটা দাগে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, জুনের শেষ পর্যন্ত মোট রোগীর ৩২ শতাংশ ছিল ঢাকা শহরে। বাকি ৬৮ শতাংশ রোগী দেশের বিভিন্ন জেলা শহর ও গ্রামে। শহরে রোগী বেশি। তবে দেখা যাচ্ছে, বেশ দ্রুতই সংক্রমণ শহর থেকে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ছে। শহরে জনঘনত্ব বেশি, গ্রামে মানুষের ঘনিষ্ঠতা বেশি।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মুশতাক হোসেন জানান, ‘গ্রাম আক্রান্ত হওয়ার পর সারা দেশে আমাদের জন্য আর কোনো নিরাপদ জায়গা থাকল না। এখনো অবশিষ্ট যদি থাকে, তাহলে ‘সবুজ এলাকা’ ঘোষণা করে তা রক্ষা করার জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে।’
সংক্রমণ কম, এমন জেলাগুলোতে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন জনস্বাস্থ্যবিদেরা। পবিত্র ঈদুল ফিতরের ছুটিতে ঢাকা থেকে সারা দেশে যেন মানুষ ছড়িয়ে পড়তে না পারে, তার জন্য প্রয়োজনে সান্ধ্য আইন জারির কথাও বলেছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজারি কমিটি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কমিটির একজন সদস্য বলেছেন, ওই পরামর্শের মূল উদ্দশ্য ছিল সংক্রমণ থেকে গ্রামগুলোকে যত দূর সম্ভব রক্ষা করা।
জনস্বাস্থ্যবিদ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক বে–নজির আহমেদ জানান, ‘আর্থিক ও ভৌগোলিকভাবে প্রান্তিক মানুষ স্বাস্থ্যসেবায় বঞ্চিত হয়। সুন্দরবন–সংলগ্ন গ্রাম বা হাতিয়া দ্বীপের মানুষ করোনায় আক্রান্ত হবে ঠিকই, কিন্তু তারা সহজে পরীক্ষা করাতে পারবে না, জটিল পরিস্থিতিতে হাসপাতালসেবা পাবে না।’
কক্সবাজারের মহেশখালী দ্বীপও করোনা সংক্রমণ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে পারেনি। একটি পৌরসভা ও ৮টি ইউনিয়ন পরিষদ নিয়ে গঠিত এই উপজেলায় প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয় ১৯ এপ্রিল। এ পর্যন্ত ১৩৯ জন রোগী শনাক্ত হয়েছে, মারা গেছেন দুজন। সুস্থ হয়েছেন প্রায় ১০০ জন।
কক্সবাজারের পাশের জেলা বান্দরবান। বান্দরবান, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি—এই তিন জেলা নিয়ে দেশের পার্বত্য এলাকা। এ অঞ্চলের ভৌগোলিক পরিবেশ ও জনমিতি দেশের বাকি অংশ থেকে আলাদা। তিন জেলার সদরে রোগীর সংখ্যা বেশি। কিন্তু বান্দরবানের লামা ও নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায় রোগী শনাক্ত হয়েছে যথাক্রমে ৪৬ ও ৩৯ জন। আর খাগড়াছড়ির দীঘিনালা উপজেলায় রোগী শনাক্ত হয়েছে ১৪ জন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে এসব এলাকায় সংক্রমণ কম। কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে সংক্রমণ দ্রুত বেড়ে যেতে পারে। এর বড় উদাহরণ খুলনা জেলার দাকোপ উপজেলা। খুলনা শহর থেকে দক্ষিণে সুন্দরবন–সংলগ্ন এ উপজেলায় ৫৩ জন রোগী শনাক্ত হয়েছে। উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা মোজাম্মেল হক জানান, ইতিমধ্যে এখানে তিনটি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। একটি করোনায়, একটি করোনা উপসর্গে। অন্য ব্যক্তির নমুনা পরীক্ষার ফল এখনো জানা যায়নি।
স্থানীয় চালনা কলেজের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন শিক্ষক বলেছেন, চুনকুড়ি গ্রামে চারজন, উপজেলা সদরে দুজন এবং তিলডাঙ্গা গ্রামে একজন মারা গেছেন। চুনকুড়ি গ্রামের কোনো পরিবার পরীক্ষা করায়নি সামাজিকভাবে হেনস্তা হওয়ার আশঙ্কায়।
এ উপজেলায় ২ মে প্রথম দুজন করোনা শনাক্ত হন খাটাইল গ্রামে। আক্রান্ত ব্যক্তিরা নারায়ণগঞ্জ থেকে গিয়েছিলেন। ওই দুজনের বাড়ি লকডাউন করেছিল উপজেলা প্রশাসন। একজন ব্যাংক কর্মকর্তা জানান, ‘প্রথম আক্রান্তের খবরে পুরো উপজেলা চমকে উঠেছিল। মানুষ বাজারঘাটে আসা বন্ধ করে দেয়। অনেকেই ভয় পেয়েছিলেন। অনেকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে শুরু করেন। এই ইতিবাচক দিকগুলো কাজে লাগাতে পারেনি প্রশাসন। আক্রান্তের সংখ্যা কখন ২ থেকে ৫৩ হয়েছে, গ্রামের মানুষ তা বুঝতেই পারেনি।’
কলেজশিক্ষক ও ব্যাংক কর্মকর্তারা বলেছেন, শিথিল লকডাউন, বাজার নজরদারির দুর্বলতা, খেয়া পারাপারের সময় ভিড় নিয়ন্ত্রণ না করায় সংক্রণ বেড়েছে। আক্রান্ত ব্যক্তি খাদ্য বা আর্থিক সহায়তা না পেয়ে লকডাউন অগ্রাহ্য করে বাড়ির বাইরে এসেছেন, এমন ঘটনাও আছে।
দাকোপ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবদুল ওয়াদুদ জানান, ‘এলাকায় ব্যাপকভাবে মাইকিং করা হয়েছে। আক্রান্ত মানুষকে পরিবার থেকে পৃথক রাখার জন্য ঘর তৈরির সরঞ্জাম ও নগদ অর্থ সাহায্যও দেওয়া হয়েছে। কাজে কোনো শৈথিল্য ছিল না।’
মূলত শহরের সংক্রমণ মোকাবিলা নিয়েই বেশি আলোচনা হচ্ছে। লকডাউন নিয়ে যে কথা হচ্ছে, তা–ও মূলত শহরকেন্দ্রিক।
জনস্বাস্থ্যবিদ অধ্যাপক বে–নজির আহমেদ জানান, সুন্দরবন এলাকা বা পার্বত্য চট্টগ্রামের অনেক মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করেন। এদের অনেকেই ২০০ টাকা খরচ করে করোনা পরীক্ষা করাবেন না। তাঁদের সহায়তামূলক সেবা না দিলে তাঁরা গ্রামে সংক্রমণের ঝুঁকি হয়েই থাকবেন।
সূত্রঃ প্রথম আলো
বাঅ/এমএ
দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে cbna24.com
সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন