দেশের সংবাদ ফিচার্ড

দেবোত্তর সম্পত্তি কি? দেবোত্তর সম্পত্তি বিধি বা দেবোত্তর আইন-২০২২

দেবোত্তর-সম্পত্তি-কি

দেবোত্তর সম্পত্তি কি? দেবোত্তর সম্পত্তি বিধি বা দেবোত্তর আইন-২০২২ | বিধি ভাঙলেই কঠোর শাস্তি

দলিলে লেখা আছে এই সম্পত্তি শুধু পূজা অর্চনার ও হিন্দুধর্মীয় কাজে ব্যবহার হবে। তাই দেশের সব দেবোত্তর সম্পত্তি হয়ে উঠেছে মূল সেবায়েতদের গলার কাঁটা। দখলদারদের স্বর্গরাজ্য। অধিকাংশ দেবোত্তর সম্পত্তি বেহাত হয়ে গেছে। নানা চেষ্টায়ও উদ্ধার করা যাচ্ছে না। দখলদাররা প্রভাবশালী। ফলে হিন্দু সম্প্র্রদায় ও প্রশাসনের হস্তক্ষেপের পরও এসব সম্পত্তি ফিরিয়ে আনা যাচ্ছে না।

তবে দিন বদল হয়েছে। বিলম্বে হলেও দেশের বিভিন্ন স্থানে দখল হয়ে যাওয়া হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের দেবোত্তর সম্পত্তি সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। সম্পত্তি সংরক্ষণে সুনির্দিষ্ট আইন হচ্ছে, হচ্ছে নতুন বিধিমালাও। অতীতে বিভিন্ন সময়ে আইন প্রণয়নের দাবি থাকলেও বাস্তবায়ন হয়নি।

তবে সর্বশেষ সরকার এ বিষয়ে আইন প্রণয়নে উদ্যোগ নিয়েছে। যা দেবোত্তর আইন-২০২২ নামে অভিহিত হবে। ইতোমধ্যে ধর্ম-বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে আইনের খসড়া প্রস্তুত করে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও অংশীজনদের মতামত নেয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে।

আইন প্রণয়নের কথা উল্লেখ করে মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (সংস্থা ও আইন) মো. মুনিম হাসান আমার সংবাদকে বলেন, ‘এটিই স্বাধীন বাংলাদেশে দেবোত্তর সম্পত্তি-সংক্রান্ত প্রথম আইন। ইতোপূর্বে দেশে এ সংক্রান্ত কোনো আইন ছিল না।  ২০১৩ সালে আইনটির খসড়া প্রস্তুত করে তা পাস করার জন্য আমরা জাতীয় সংসদে পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু নানা বাধা-বিপত্তির কারণে আইনটি আলোচনায় আসেনি। পাস হয়নি।

পরবর্তীতে একই বিষয়ে আমরা পুনরায় কাজ শুরু করি। এবার সব পক্ষের মতামত নিয়ে চূড়ান্ত মতামতের জন্য মন্ত্রণালয়ের ওয়বসাইটে প্রকাশ করেছি। অংশীজনদের নজরে নিয়ে মতামত চেয়েছি। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় উপাসনালয়ের বেহাত হওয়া সম্পত্তি পুনরুদ্ধার ব্যবস্থাপনা নিয়মের আওতায় অপরাধীর শাস্তির বিধান করাই আইনের মূল উদ্দেশ্য। সবার মতামতের ভিত্তিতে পরবর্তীতে মন্ত্রিসভার বৈঠকে উন্থাপনের জন্য শিগগিরই পাঠানো হবে।’

বর্তমানে দেবোত্তর সম্পত্তি রক্ষায় শুধু উচ্চ আদালতের একটি রায় রয়েছে। তবে রায়ের দোহাই দিয়ে দেবোত্তর সম্পত্তি রক্ষা করা যাচ্ছে না। যদিও  দেবোত্তর সম্পত্তি নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের যে রায় রয়েছে তাতে স্পষ্ট করে বলা আছে, আগে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করতে হবে। নতুন করে কাউকে দখলের সুযোগ দেয়া যাবে না। যদি কেউ দখলের চেষ্টা করে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। তবে এই রায়ের বাস্তবায়ন হয়নি।

রায়ের আলোকে সম্পত্তি উদ্ধার বা দখল ঠেকাতে কোনো পদক্ষেপ নিয়েছে এমন কোনো নজিরও নেই। ফলে আদালতের রায়টি শুধু কাগজ-কলমেই আটকে আছে। আদালতের রায় নয়, এখন জবরদখলের সব দেবোত্তর সম্পত্তি উদ্ধার, দেখভাল ও রক্ষায় আইন করা হচ্ছে। এ আইন কার্যকর হলে সব দেবোত্তর সম্পত্তি সরাসরি সরকারের তত্ত্বাবধানে চলে আসবে। তত্ত্বাবধানে সেবায়েত নয়, বরং নিয়ন্ত্রণ থাকবে মন্ত্রণালয়ের।

দেবোত্তর সম্পত্তি কি : হিন্দু ধর্মাবলম্বী লোকজন মন্দিরের দেবতার উদ্দেশ্যে পুণ্য অর্জনের লক্ষ্যে সম্পত্তি উৎসর্গ করলে তাকে বলে দেবোত্তর সম্পত্তি। শব্দগতভাবে দেবোত্তর অর্থ দেবতার স্বত্বাধীন। দেবোত্তর একটি অর্পণ বা চিরস্থায়ী দান। ট্রাস্টের মাধ্যমেও এই দান সৃষ্টি করা যায়। তবে সে ক্ষেত্রে সম্পত্তির মালিকানা ট্রাস্টের ওপর বর্তায় এবং দেবতা হন সুবিধাভোগী। দেবতা অদৃশ্য শক্তি হলেও বৈধ সত্তা হিসেবে সম্পত্তি ধারণ করতে সক্ষম। দেবোত্তর সম্পত্তির তত্ত্বাবধায়ককে বলে ‘সেবায়েত’ সেবায়েত এরূপ সম্পত্তি হস্তান্তর করতে পারেন না।

আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেবোত্তর সম্পত্তি উদ্ধার ও রক্ষা করতে সুনির্দিষ্ট আইন ও নীতিমালা বহু আগেই করা প্রয়োজন ছিল। আইন থাকলে এসব সম্পত্তি বেদখল ও বেহাত হতো না। আইন না থাকায় শত শত একর সম্পত্তি  বেদখল হওয়ার পরও দখল পুনরুদ্ধার করা যাচ্ছে না। নেয়া যাচ্ছে না প্রশাসনিক কোনো ব্যবস্থা। আইন ও শাস্তির বিধান না থাকার সুবিধা পুরোপুরি কাজে লাগিয়েছেন প্রভাবশালীরা। আইন প্রণয়ন চূড়ান্ত হলে বেহাত হওয়া সম্পত্তি পুনরুদ্ধার সহজ হবে।

পরবর্তীতে কেউ এই সম্পত্তি দখলে নেয়ার চেষ্টা করলে শাস্তির আওতায় আনা যাবে। এতে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা উপকৃত হবে। জানা গেছে, হিন্দুধর্মীয় আইনে ধর্মীয় বা দাতব্য উদ্দেশ্যে কোনো ব্যক্তি তার সম্পত্তি দেবতার অধিকারভূক্ত উৎসর্গ করতে পারেন। উৎসর্গকৃত এই সম্পত্তি দেবোত্তর সম্পত্তি নামে অভিহিত হয়ে থাকে। এই সম্পত্তি ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা ব্যক্তি সেবায়েত নামে পরিচিত।


তিনি সম্পত্তি দখল, রক্ষণাবেক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা করেন। কিন্তু সেবায়েতরা যথাযথভাবে এই সম্পত্তি ব্যবস্থাপনা ও রক্ষণাবেক্ষণ করেন না বা নানান কারণে করতেও পারেন না। ফলে হাজার হাজার একর দেবোত্তর সম্পত্তি বেহাত, অপদখল ও বেআইনিভাবে বিক্রি হয়েছে। আর এ জন্য আইনি শূন্যতা প্রধানত দায়ী। তাই নতুন এই প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।

দেবোত্তর সম্পত্তি বিধিঃ আইনে দেবোত্তর সম্পত্তি সংরক্ষণে নিবন্ধন বাধ্যতামূলক এবং হস্তান্তর নিষিদ্ধ করা হয়েছে। দেশের প্রত্যেক জেলায় দেবোত্তর সম্পত্তি বোর্ডের কার্যক্রম চলবে। পদাধিকার বলে জেলা প্রশাসককে জেলা বোর্ডের প্রধান করা হয়েছে। আইনটি কার্যকর হলে কেন্দ্রীয় ও জেলা বোর্ডের মাধ্যমে হিন্দুধর্মীয় উপাসনালয়গুলোর সম্পত্তির তালিকা তৈরি করা হবে।

এসব সম্পত্তি ব্যবস্থাপনা, উন্নয়ন ও প্রয়োজনে হস্তান্তর করা হবে। এ ছাড়া আইনের খসড়ায় দেবোত্তর সম্পত্তির অব্যবস্থাপনা এবং মিথ্যা তথ্য দেয়ার জন্য এ আইনে শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে।

আইনের খসড়ার ৫২ ধারায় বলা হয়েছে, সম্পত্তি ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে যারা থাকবেন তাদের গাফলতি বা অব্যবস্থানার অভিযোগ প্রমাণিত হলে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা এবং এক বছরের কারাদণ্ড এবং সম্পত্তির বিষয়ে মিথ্যা তথ্য দিলে এক বছর কারাদণ্ড এবং ৫০ হাজার টাকা জরিমানা।


এ আইনের মাধ্যমে দেবোত্তর সম্পত্তি হস্তান্তর এবং বোর্ডের অনুমতি ছাড়া এ ধরনের সম্পত্তির বিপরীতে ঋণ নেয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে। প্রস্তাবিত আইনটি চূড়ান্ত অনুমোদন  হলে সব দেবোত্তর সম্পত্তি একটি বোর্ডের অধীনে নিবন্ধিত ও নিয়ন্ত্রিত হবে। এই সম্পত্তি কোনোভাবেই কারো কাছে হস্তান্তর করা যাবে না। একই সাথে অতীতে হস্তান্তর হওয়া দেবোত্তর সম্পত্তি উদ্ধারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হবে।

৭ নং বিধিতে বলা হয়েছে, দেবোত্তর সম্পত্তির সুষ্ঠু রক্ষণাবেক্ষণ, উন্নয়ন, তহবিল পরিচালনা, সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার জন্য দেবোত্তর সম্পত্তি ব্যবস্থাপনা বোর্ড প্রতিষ্ঠা করা হবে। হিন্দু ধর্মাবলম্বী একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি বা সচিব অথবা অতিরিক্ত সচিব বোর্ডের চেয়ারম্যান হবেন। জেলা প্রশাসক পদাধিকার বলে বোর্ডের সদস্য সচিব হবেন।

এছাড়া সরকার কর্তৃক মনোনীত ১৩ জন ব্যক্তি যাদের মধ্যে ছয়জন দেবোত্তর সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণের কাজে নিয়োজিত যেমন— সাধু সন্ন্যাসী। সদস্য থাকবেন সেবায়েত হিসেবে কর্মরত তিনজনসহ হিন্দু ধর্মাবলম্বী। এছাড়া সরকারের ধর্ম, আইন, মন্ত্রণালয়ের উপসচিব পদমর্যাদার একজন হিন্দু কর্মকর্তাকে বোর্ডের প্রশাসক নিয়োগ দেয়া হবে। মনোনীত ব্যক্তিরা নিয়োগের পর থেকে তিন বছর দায়িত্ব পালন করবেন।

খসড়ায় আরো বলা হয়েছে, বোর্ডের প্রধান কার্যালয় হবে ঢাকায়। তবে জেলা সদরে বোর্ডের শাখা কার্যালয় থাকতে পারবে। প্রতিটি জেলায় ‘দেবোত্তর সম্পত্তি জেলা কমিটি’ নামের একটি কমিটি থাকবে। জেলা প্রশাসক ওই কমিটির সভাপতি হবেন।

খসড়া বিলের ১৮ ধারায় বলা হয়েছে, আইনটি কার্যকর হওয়ার আগে ও পরে সৃষ্ট সব দেবোত্তর সম্পত্তি বোর্ডে তালিকাভুক্তির জন্য আবেদন করতে হবে। আবেদন যাচাই-বাছাই শেষে বোর্ড সম্পত্তি তালিকাভুক্ত করে সনদ দেবে। সেবায়েত বা ব্যবস্থাপনা কমিটি বছর শেষে বোর্ডের কাছে আয়-ব্যয়ের হিসাব দেবে। সেবায়েতের অবর্তমানে সম্পত্তি ব্যবস্থাপনার জন্য একটি ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করবে বোর্ড। বোর্ড বেদখল হওয়া সম্পত্তি উদ্ধারে পদক্ষেপ নেবে। ৩৬ ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে, দেবোত্তর সম্পতি দেখাশোনার দায়িত্বে থাকা পুরোহিতরা বিধি অনুযায়ী সম্মানি পাবেন।


সেবায়েত বা ব্যবস্থাপনা কমিটি নির্ধারিত পদ্ধতিতে দেবোত্তর সম্পত্তির আওতাধীন মন্দিরের পুরোহিতের সম্মানি নির্ধারণ করতে পারবেন। সম্মানি নির্ধারণ হলে পুরোহিতরা দায়িত্ব পালনে বাধ্য থাকবেন। তবে তারা দায়িত্ব পালনে অযোগ্য বা অনুপযুক্ত হলে সেবায়েত কমিটি তাকে অপসারণ করতে পারবে।

খসড়ার ৩৯ ধারায় দেবোত্তর তহবিল গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে। দেবোত্তর সম্পত্তির আয়ের ৫ থেকে ৭ শতাংশ অর্থ এই তহবিলে জমা হবে। এ ছাড়া সরকারের অনুদান, ঋণ, বেসরকারি অনুদান ও অন্য কোনোভাবে প্রাপ্ত অর্থ তহবিলে সংরক্ষণ করা হবে। এই তহবিল থেকেই বোর্ডের সব ব্যয় নির্বাহ হবে।

বিলের দশম অধ্যায়ে সেবায়েত বা ব্যবস্থাপনা কমিটি কর্তৃক দেবোত্তর সম্পত্তির ব্যবস্থাপনায় ব্যর্থতা ও বোর্ডের কাছে মিথ্যা তথ্য উত্থাপনের দায়ে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে এক বছর বিনাশ্রম কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট জামিউল হক ফয়সাল বলেন, এ আইনের ফলে দখল হওয়া সম্পত্তিগুলো উদ্ধার করা সম্ভব হবে। তবে প্রস্তাবিত দেবোত্তর আইন নিয়ে অনেক সমালোচনাও রয়েছে। কারণ হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অনেকে এ আইন কার্যকর হোক তা চান না। এর বেশ কিছু কারণও রয়েছে।

প্রথমত, আইন হলে এটি সরাসরি সরকারের নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে। এতে তাদের স্বার্থ বিঘ্নিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। দ্বিতীয়ত, সরকার চাইবে অব্যবহূত পড়ে থাকা খালি জায়গাগুলো সরকারি নানা প্রকল্পে কাজে লাগাতে। আর আইনের মধ্যে থেকে এমন কিছু করলে তখন সম্পত্তির হকদারদের কিছু করার থাকবে না।

জানতে চাওয়া হলে সুপ্রিম কোর্টের আরেক আইনজীবী ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ বলেন, দেবোত্তর সম্পত্তি রক্ষায় আইন করা সময়ের দাবি ছিল। তবে আইনের ব্যবহার যদি সৎভাবে হয় তবে এতে সংখ্যালঘুরা উপকৃত হবে। কিন্তু আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে এর অপব্যবহার হলে বহু বছরের পুরোনো সম্পত্তি হুমকির মুখে পড়বে। -আমার সংবাদ

 

সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

আমাদের ফেসবুক পেজ   https://www.facebook.com/deshdiganta.cbna24 লাইক দিন এবং অভিমত জানান

সংবাদটি শেয়ার করুন