কোভিড-১৯ ও আমার বিক্ষিপ্ত চিন্তা |||| আবুল জাকের
এবছর ২১ এ ফেব্রুয়ারি মন্ট্রিয়লে ধুমধাম করে শহীদ দিবস ও বই মেলার করে আয়োজন করে সলিডারিটি কানাডা। ১২ ই ফেব্রুয়ারি আমাদের বিবাহ বার্ষিকী। শেষ সপ্তাহে বাফে ভিসিতে পরিবারের সবাইকে নিয়ে খেতে গেলাম সন্ধ্যায়। সবাই ছিলাম আগের মতো। মার্চের মাঝামাঝি এসে পালটে গেলো সবার জীবন। টিভি তে বার বার আসছে চীনের হুয়াং শহরে শ্বাসকষ্টে মানুষ মারা যাচ্ছে। মানুষ মরছে অনেক। দলে দলে। হুয়াং শহর লকডাউন। পরের সাপ্তাহে চীনের আরও কিছু শহর। ওয়ার্ল্ড স্বাস্থ্য সংস্থা জারি করলো ভীষণ বিপদের কথা। জীবন বাঁচাতে থাকতে হবে ঘরে বন্দি। নড়ে চড়ে বসল পশ্চিমা পৃথিবী। এরই মধ্যে ইটালির অবস্থা চরমে পৌঁছে। সমস্থ ইটালি লকডাউন। লাশ রাখার জায়গা নেই। ইটালির পর স্পেন ও ফ্রাঞ্ছ। কানাডা ও আমেরিকা ভয় পেয়ে সাবধানতা অবলম্বন করতে শুরু করে মহামারি ঠেকাতে। কেউ বাসা থেকে বেরোতে পারবে না। মানতে হবে নিরাপদ দূরত্ব। পরতে হবে মাস্ক ও গ্লাভস বাইরে গেলে। হাসপাতাল গুলো হিমসিম মড়ক ঠেকাতে। নিরাপত্তা সরমজামে অভাব চূড়ান্তে পৌঁছায়। এমনকি ধনী দেশ এবং দেশগুলোতেও ভেন্টিলেটর নেই পর্যাপ্ত ব্যবস্থা। ইতালির পর আমেরিকায় মহামারি চরম রূপ ধরে। পাশাপাশি ফ্রাঞ্চ ও স্পেন। ধীরে ধীরে সব ইউরোপ। তারপর ভাইরাস হামলা দেয় এশিয়ান দেশগুলোতে। আর এখন রাশিয়ায়। সবার নাকানি চুবানি খাবার অবস্থা। এখন জুন। আমরা এখন হন্যে হয়ে খুঁজছি প্রতিষেধক। চীন, যুক্তরাজ্য, ফ্রাঞ্চ, আমেরিকা, কানাডা ও ভারত একসাথে খুঁজছে সোনার কাঠি। যার ছোঁয়ায় আবার জেগে উঠবে আধুনিক মানব সভ্যতা। মানুষ আবার প্রাণ খুলে নেবে শ্বাস। লোকদের বাঁচাতে সব সরকার তাদের সাধ্যমত সাহায্যে এগিয়ে আসল। সাধারন মানুষ এর সাহায্যে হাত বাড়াল সবাই। রোটারি ও সামিল হল তার দলে। পশ্চিমা বিশ্ব, বাংলাদেশ, ভারত সহ সকল এশিয়ানদের কর্মহীন মানুষদের খাবার যোগাতে যার যার সাধ্যিমত শুরু করে সাধারন মানুষ। এই প্রথম দেখলাম বাংলাদেশের মানুষ মানুষের পাশে দাঁড়াতে দু হাত খুলে। বাংলাদেশ রোটারির আগামী বছরে গভর্নর রুবায়েত শুরু করে “আহার প্রতিদিন” কার্যক্রম মে মাস থেকে। বর্তমান গভর্নর খাইরুল মার্চ মাস থেকেই চালু করেছে সানিটেসান ও খাদ্য বিতরণ কর্মসূচি। রোটারি ইন্টারন্যাশনাল সাহায্য পাঠায় তার সব ডিস্ট্রিক্টগুলোতে। দেখতে পেলাম কুষ্টিয়া, খুলনা ও অন্যান্য রোটারি ক্লাব গুলো বিতরণ করছে কর্ম মুজুরদের খাবার ও ইফতারি। অন্যদিকে কানাডা, আমেরিকা ও পশ্চিমা দেশগুলো চার মাসের জন্য মাসিক অর্থনৈতিক সাহায্য চালু করে কর্মহীন মানুষদের জন্য। যার যার একাউটে পৌঁছে যায় মাসিক ভাতা। সময়ে পাল্টায় মানুষ। মানবতা জেগে উঠে। মনে পড়লো ভুপেন হাজারিকার গান “ মানুষ মানুষে জন্য, জীবন জীবনের জন্যে, একটু সহানুভূতি কি মানুষ পেতে পারে না”…।
পৃথিবীতে দুর্যোগ বা মহামারি এই প্রথম নয়। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রূপে হানা দিয়েছে পৃথিবীর বুকে। মানব জাতিকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে। ধর্ম গ্রন্থতে আমারা খুঁজে পাই অতি প্রাচীন যুগের গোত্রদের নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবার কথা প্রাকৃতিক দুর্যোগে। তার মধ্যে ফিরাউন অন্যতম। প্রাকৃতিক দুর্যোগ এখনো চলছে। সাইক্লোন, বন্যা, ভূমিকম্প, আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ ও সুনামি। পম্পাই নগরীর ধ্বংসের কথা সবার জানা। ক্লিওপেট্রার প্রাসাদ পানির নীচে। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ভূমিকম্প হয় চীনের সাওয়ান্সকি শহরে ১৫৬৫ র ২৩ জানুয়ারিরতে। মারা যায় ৮ লাখের ও বেশী মানুষ। মানুষ ধীরে ধীরে এগুলো সামলাতে শিখেছে। তাই কমেছে মৃত্যু হার। সবচেয়ে ভয়ের ব্যাপার মানুষ চেষ্টা করছে একে যুদ্ধের কৌশল হিসাবে ব্যাবহার করতে। তার নাম টেক্টনিক অস্ত্র, যা দিয়ে ধ্বংসযজ্ঞ চালানো যায়।
স্পেনিশ ফ্লুর কথা আমরা সবাই জানি। মহামারী আকারে প্লেগ হানা দিয়েছে একসময়। এছাড়াও আছে পোলিও, কলেরা, যক্ষ্মা, এইচা, আই,ভি, সারস, ইবোলা, আরও অনেক। তবে তা এতটা ভয়ংকর আকার ধারন করেনি। রোটারির পোলিওতে অবদান আমরা জানি। তবে সমগ্র বিশ্বকে কখনই এভাবে বিপদে ফেলেনি। এটাই ভাবার বিষয়। রোমান এম্পায়ার এর সময়, ২৪৯ হতে ২৬২ খ্রিস্টাব্দে, মহামারী হানা দেয় সাইপ্রেনে। রোমান সাম্রাজ্যকে দুর্বল করে দেবার জন্য এটাই ছিল যথেষ্ট। জানা যায় এটা যখন চরমে পৌঁছে তখন প্রতিদিন ৫০০০ হাজার লোক মারা যায় বেশ কিছুদিন ধরে। সম্রাট ক্লডিয়াস টুঁ মারা যান এতে। জানাযায় এটায় জ্বরের প্রকুপ হত, এসেছিল রোডেন্ট (বীবর বা কোরাল, তীক্ষ্ণ দাত বিশিষ্ট জন্তু) থেকে। এর আগে ১৫৫ থেকে ২৩৫ খ্রিষ্টাব্দে, রোমে হানা দিয়েছিল মহামারী। জানা যায় যুদ্ধ জয় করে রোমান সৈন্যরা যখন দেশে ফিরে, তখনি শুরু হয় এটা। রোমান সম্রাট “লুচিয়াস ভারসাস” মারা যান এতে। প্রতিদিন মারা যাচ্ছিল ২০০০ হাজার। প্রায় ২৫% মানুষ প্রাণ হারায়। এটা হয়ত স্মল পক্স বা মিসেলস ছিল। অথবা ব্যাকটেরিয়া জনিত জ্বর থেকে, এখনকার ইবোলার ন্যায়, সঠিক তথ্য নেই। ১৩৪৮ এ স্পেনের কেটালনিয়াতে মহামারির প্রাদুর্ভাব হয়, অনেকটা কোভিড-১৯ এর মত। বহু মানুষ মারা যায়। প্রথম মানুষ নিজেকে বাড়ীতে বন্ধ থাকা শিখে। জনসমাগমে যাওয়া নিষিদ্ধ করে। বিভিন্ন খাবার খাওয়া কমিয়ে দেয়। ইতালির রাজা জারি করে আদেশ – ভ্রমন নিষিদ্ধ, মালামাল পরিবহণ, বুচারিজ এবং টেনারিজ বন্ধ। গণসমাবেশ ও ফিউনারেন এ বাধা নিষেধ। ২০০ মিলিয়ন মানুষ মারা যায় চার বছর ধরে। এর পর ও প্লেগ থেমে থাকেনি। ১৩৪৮ থেকে ১৬৬৫, প্রায় বিশ বার প্লেগ হানা দেয় লন্ডনে, এবং প্রতিবার লন্ডনের ২০% নারী, পুরুষ ও শিশু মারা যায়। ১৬৬৫ এ শুধু মাত্র ১০০,০০০ মানুষ মারা যায় সাত মাসে লন্ডনে। ১১০০ তে ইউরোপে আঘাত করে স্মল পক্স। তাণ্ডব চালায় ১০০ বছর ধরে। ছড়িয়ে পরে এশিয়া, আমেরিকা, মেক্সিকো ও আরব দেশগুলোতে। আমেরিকার রেড ইন্ডিয়ান্দের প্রায় ৯০% বিলুপ্ত হয়ে যায়। ১৮০০তে এসে টিকা বের হয় স্মল পক্সের। প্রায় দু বছর লাগে মহামারী ঠেকাতে। সাধারন মানুষের নাগাকেয়াস্তে আসে ১৯০০ মাঝামাঝি। ১৯০০ তে কলেরার প্রাদুর্ভাব হয় ইংলেন্ডে। ময়লা পানি এর জন্য দায়ী। লক্ষ লক্ষ লোক মারা যায়। আধুনিক বিশ্বে এটা নিয়ন্ত্রনে আনলেও অনুন্নত বিশ্বে এটার প্রকোপ এখনও আছে বিশুদ্ধ পানির অভাবে। স্পেনিশ ফ্লু ১৯১৮ তে আঘাত হাতে পৃথিবীকে। দু বছর স্থায়ী ও তিন টি ওয়েভে প্রায় ৫০০ মিলিয়ন মানুষকে অসুস্থ করে, মারা যায় ৫০ মিলিয়ন।
জন বেনাম ফস্টারের কথা আমরা কেউ কেউ জানি। কাল মার্ক্স এর “মেটাবলিক রিফট” বা প্রান-প্রতিবেশ- সমাজের পারষ্পরিক সম্পর্কের উপর কাজ করছেন।এটা এমন এক তত্ত্ব যা দিয়ে প্রান-পরিবেশ-পরিবেশ -সমাজের মধ্যকার সম্পর্ক, বিশেষ করে সমাজ ও প্রকৃতির মধ্যকার নির্ভরশীল পারষ্পরিক নির্ভরশীলতাকে অনুসন্ধান করা হয়। জার্মান রসায়নবিদ ইয়োস্টান লিবিগের গবেষণা থেকে মার্ক্স মাটির রাসায়নিক বিপাকীয় প্রক্রিয়ার ভাঙ্গন বিষয়ে মনযোগী হন। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষ ও এক জায়গার ফসল অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়ার ফলে মাটির প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদানের ঘাটতি হয়, এগুলো মাটিতে ফিরে যাবার উপায়ত থাকেই না, বরং এগুলো শহর নগরকে দুষিত করে তুলে। এর ফলে প্রাকৃতিক বিপাকীয় ক্রিয়ার ভাঙ্গন তৈরি হয়। মাটি তার প্রাকৃতিক ভারসাম্য হারায়, উর্বরতার অভাব ঘটে, যার পরিনাম ভয়াবহ। গান্ধী ও ১৯১৮ সালে একই কথা বলেছিল পশ্চিমা সভ্যতার কুফলের উপর। বলেছিলেন আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা ও পশ্চিমা স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কিভাবে বিপদে ফেলতে যাচ্ছে মানবগোষ্ঠিকে। আজকের এই মহামারী আধুনিক যোগাযোগ ব্যাবস্থারই কুফল। এক দেশ থেকে আরেক দেশে ছড়িয়ে পড়ছে চোখের পলকে।
১৮৪৫ সালে ফ্রেড্রিরিথ এঙ্গেলস প্রকাশ করেন তার বই “ ইংলেন্ডের শ্রমিক শ্রেণীর অবস্থা”। তুলে ধরেন শিল্প বিপ্লবের সময়কার রোগ ব্যাধির প্রকোপের কথা ও শ্রেণীগত প্রভাব। তার মতে এটা হল গোটা সমাজ জুড়ে হত্যাযজ্ঞ। এর প্রায় ১০০ বছর আগে চার্লস ডারঊইন ও থমাস হাক্সলির শিষ্য এবং মার্ক্সের ঘনিষ্ট বন্ধু প্রানীবিদ রে ল্যাক্সটার ১৯১১ তে প্রকাশিত তার “কিংডম অফ ম্যান” গ্রন্থে “ নেচারস রিভেঞ্জ” বা “ প্রকৃতির প্রতিশোধ” অধ্যায়ে মানব সমাজ কে এই বলে সাবধান করেন যে,সব আধুনিক মহামারীর গোড়াতেই আছে পরিবেশের ক্ষেত্রে উন্নতির নামে মানুষের দ্বারা তৈরি বৈজ্ঞানিক পরিবর্তন। তিনি লিখেন “ বিপুল পরিমানে পশু ও শস্যের চাষাবাদের লোভ থেকে মানুষ ক্ষেতে খামারে নিজের ইচ্ছামত সীমাহীন ভাবে বিভিন্ন প্রজাতির ফসল ও জীব জন্তুর চাষ করছে।শহরে নগরে জড়ো করেছে নিজ প্রজাতির লাগামহীন ভিড়। তৈরি হয়েছে পরজীবী ভাইরাস আর ব্যাক্টিরিয়ার প্রসুত নানা রোগ। আবার বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে তার তৈরি বিভিন্ন প্রতিষেধক। লেখকের মতে বর্তমান বিশ্বের এই সমস্যরা জন্য দায়ী “বাজার” ও “ লগ্নিপুজির বহুজাতিক বেনিয়ারা”।
বর্তমান আধুনিক সভ্যতার সৃষ্টি হচ্ছে পুঁজিবাদ প্রজাতি, পরিবেশ-প্রতিবেশ ও বায়ুমন্ডলে তৈরি হয়েছে নানা ভাঙ্গন। জন্ম হয়েছে সমাজ-পরিবেশের সংকট। মুল কারন হচ্ছে বিরাজমান সমাজ ব্যাবস্থায় সম্পদ আরোহণের ক্ষেত্রে দ্বন্দ্ব। পুঁজির এই ব্যবস্থা শ্রেণীগত ও সাম্রাজ্যবাদী বৈষম্য তৈরি করে। নিশ্চিত করে সবচেয়ে গরীব ও অসহায়রা সব চেয়ে পরিবেশ গত ঝুঁকিতে থাকবে। ধনীরা থাকবে তুলনামূলক ভাবে নিরাপদ। ঠিক এঙ্গেলস এর মতবাদের “সামাজির হত্যার” নতুন রূপ। এবারের কোভিড ১৯ এর প্রকোপের সময় অনেক চূড়ান্ত ধনীরা ইয়টে, দ্বীপে, পুরো হোটেল বা রিসোর্ট ভাড়া করে নিরাপদে থাকার চেষ্টা চালিয়েছে। ওদের কারখানা চলছে গরীব শ্রমিকদের দ্বারা, মৃত্যুর সাথে পাল্লা দিয়ে। অবাক করা সমাজ ব্যাবস্থা তৈরি করেছে পশ্চিমা সভ্যতা। যার ঘানি টানছে পুরো বিশ্ব। ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে প্রকৃতি। তাই এবার প্রকৃতি ঝাপিয়ে পড়েছে সমস্ত মানব কুলের উপর তাঁকে বাচাতে। বুজাছে চাচ্ছে , এই পৃথিবী তোমাদের একার নয়। সবার। তাই একটু থমকে দাড়াও। নইলে সামনে আরও বড় আঘাত হানব, যা তোমরা সামলাতে পারবে না।
নস্ট্রাদামাস এর কথা আমরা কেউ কেউ জানি। ১৫৬১ সালে লিখেছিলেন “একটা জমজ বছর আসবে (২০২০), উঠে আসবে নতুন রানী ( করোনা), সে আসবে পূর্ব হতে (চীন), রাতের আঁধারে প্লেগের মত ছড়িয়ে যাবে, আঘাত হানবে সাত পাহারের দেশে (ইতালি) এবং মানুষের স্বপ্নকে ধুলায় মিশিয়ে দেবে, পৃথিবীকে ধ্বংস ও বিধস্থ করতে। এটাই হবে আমাদের জানা বর্তমান পৃথিবীর অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সমাপ্তি”। উনি অনেক কথা কবিতার মধ্য দিয়ে , রূপকের মত ভবিষ্যত বানী করে গিয়েছেন যা সবটাই ফলছে। অনেকটা আমাদের খনার বচনের মত।
ফিরে আসি বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায়। কিছুদিন আগে নোবেল বিজয়ী ডক্টর ইউনেসের একটি লিখা ছাপা হয় ইতালির একটি পত্রিকায়। একই লিখা ছাপা হয় জাপানের মে এর চার তারিখে “দি মাইন্নিচি” পত্রিকায়। পুরটাই বর্তমান ঘটনাকে কেন্দ্র করে। তিনি বলেছেন “আমাদের হয়ত অর্থনৈতিক অবস্থা ঠিক হতে দু বছর লাগবে। তার পর আমরা কি ভাবে এগোব? আমাদের মনে রাখতে হবে আমাদের এই ক্রমবর্ধমান উন্নয়নই জলবায়ু পরিবরতনের প্রধান কারন। আমাদের প্রযুক্তিবিদ্যা আমাদেরকে সবজায়গায় বিশাল পরিবর্তন ঘটিয়েছে। আধুনিক রবোট কেড়ে নিচ্ছে শ্রমিকদের কাজ। তাহলে আমাদের পরবর্তী পদক্ষেপ কি হবে? পৃথিবীর সম্পদ পুঞ্জিভুত হচ্ছে হাতে গনা দশ জনের হাতে। আমরা এটা চলতে দিলে আগামী পাঁচ বছর, তাহলে সবকিছুর মালিক হবে পৃথিবীর দুই অথবা তিন জন। আমরা এভাবে চলতে থাকলে পৃথিবীর ধংস অনিবার্য। করোনা আমদেরকে একটি সুজুগ এনে দিয়েছে পাল্টাবার।
আমরা দূষনমুক্ত পৃথিবী চাই। যার জন্য প্রযুক্তির প্রয়োজন কার্বন শোধনের জন্য। সবাই যাতে কিছু করে খেতে পারে তার ব্যবস্থা। সমাজে কেউ বেকার না থাকে তার দিকে খেয়াল রাখা। বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় আমারা অন্যের জন্য কাজ করি। আমরা হয়ে যাচ্ছি যন্ত্র। আমরা এই ভাবে চলতে থাকলে ভবিষতে অনেকে চাকুরি হারাবে। অদক্ষ শ্রমিকের কিছু করার থাকবে না। পৃথিবীর অর্থনীতির বুনিয়াদ গড়ে তুলা উচিৎ ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসার উপর। এই দিকে বেশী করে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। দক্ষ জনবল গড়ে তুলতে হবে, যাতে তাঁরা ছড়িয়ে পড়তে পারে পৃথিবীতে কাজ করতে”।
রোবট চালিত ফেডেক্স এর কাস্টমার কেয়ারের আমার ইদানীং অভিজ্জতার কথা বলছি। আমার হংকং এর বন্ধু আমার জন্য মাস্ক পাঠিয়েছিল। মাস্কটা ডেলিভারির সময় আমার পাশে দালানে দিয়ে যায়। আমি না পেয়ে কাস্টমার কেয়ার এ ফোন করি। সুন্দর নারী কন্ঠে কেউ বলল “ মে আই হেলপ উ”। আমি যথারীতি বললাম “আমার ডেলিভারি পাই নি। হংকং থেকে এসেছে । আজ ডেলিভারি দেবার কথা। আমি কি করবো” সে উত্তর দিল “ ইয়োর মেসেজ ইস টুঁ লং। প্লিজ মেইক ইৎ শর্ট অ্যান্ড টুঁ দা পয়েন্ট”। আমি তখন ট্রেকিং নাম্বার বললাম” একটু চুপ থেকে বলল “দি প্যাকেজ হাস বিন ডেলিভারড টুঁ ইয়োর এড্রেস এট ওয়ান পি এম”। আমি বললাম “পাই নি”। সে আগের কথাই রিপিট করলো। বুঝতে পারলাম এর সাথে কথা বলে কোনও লাভ নেই। ফোন রেখে দিলাম। পরে আমার মেয়ে এটা ট্রেক করে। প্রায় এক ঘন্টা রোবটের সাথে কথা বলে সে মানুষের কাছে পৌঁছায়। বুঝে নিন আগামী কি হতে যাচ্ছে। এখানকার অনেক দোকানে এখন নিজে পে করার রোবট বসিয়েছে। আমি ব্যাবহার করতে পারিনি এখনো। ফাস্ট ফুডের দোকানে মেশিন। মেনু সিলেক্ট ও অর্ডার দেয়া শুরু হয়ে গেছে। ভাবতে পারেন কত লোকের কাজ উধাও হয়েছে। তাই আমাদের সাবধান হতে হবে এখনি।
আমার এক স্কুল বন্ধু বলেছিল আগেও মহামারী হয়েছে। মানুষ সামলে নিয়েছে। এবারেও পারবে। মানুষ সামলে নেবে নিশ্চয় কিন্তু আগের মত কি আর হবে? আমরা আগের মহামারীরগুলোর দিকে তাকাই। যদি কলেরার কথা বলি, আমরা জানতাম এটা কিভাবে ছড়ায়। পচা খাবার ও ময়লা পানি থেকে। ম্যালেরিয়ার দিকে তাকালে খুঁজে পাই তার সমাধান। মশার কামোর থেকে হয়। সামলাতে পেরেছি। স্মল পক্স ভীষণ ছোঁয়াচে ছিল। ছড়াত গলিত পুজ ও কাশি ও সর্দির সাথে। আর এটা রুগি দেখলেই বুঝা যেত। আমার মনে আছে, পক্স এর রুগীদের কাপড় জামা পুড়িয়ে ফেলা হত। মানুষ তার টিকাও বের করে যখন জানতে পারে এটা গরুর পক্স থেকে ছড়াচ্ছে। যদি স্পেনিশ ফ্লুর দিকে তাকাই, তাও অন্য মানুষের শরীরে আসত অনেকটা বর্তমান কোভিড -১৯ এর মতো। হাঁচি, কাশি থেকে। এটাও ছিল ভাইরাস, যাকে আমরা ইনফ্লুয়েঞ্জার বা ফ্লু বলি। প্রায় একশ বছর পর মানুষ তার টিকা বের করতে পারে। তাও প্রতি বছর নিতে হয়। কারন প্রতিবছর ভাইরাস রূপ বদলায়। এন্টিবায়োটিক দিকে চিকিৎসা করা যায়। পশ্চিমে বিশ্বের লোকজন এটার সুফল পায়। প্রতি বছর নিয়ম করে সবাইকে দেয় সরকার। আমি কানাডায় না আসলে জানতাম না। আমি গত পাঁচ বছর ধরে শীতের আগে এই টিকা নেই। ভারতবর্ষে এর একটা খুব প্রচলন নেই। কিন্তু এবারের ব্যপার টা আরও ভয়ানক। এক মানুষ থেকে আরেক মানুষের কথা বলার মাধ্যমে ছড়ায়।যে জায়গা সে ব্যক্তি ছুঁয়েছে তার থেকে ছড়ায়। হাঁচি কাশি ত আছেই। তাই এটা গোটা মানব সমাজকে ভয়ানক বিপদে ফেলেছে, একসাথে ছড়িয়েছে সারা বিশ্বে। হিমশিম খাচ্ছে পশ্চিমা বিশ্ব ও পৃথিবীর উন্নত দেশ। ভারতবর্ষের কথা ছেড়েই দিলাম। আশা শুধু টিকা। সবাই আদা জল খেয়ে লেগেছে। দুর্ভাগ্য আমরা এখনো জানি না কিভাবে এটার সংক্রামণ ছড়ায়। কিছু সহসা কি আসছে? আসলে ভারতবর্ষের কি কোনও লাভ হবে? পশ্চিমাবিশ্ব এর মধ্যেই সব সিটিজেনের জন্য সিরিঞ্জ বুক করছে। বর্তমান ভাইরাস সমগ্র মানব জাতিকে ঘরে আটকে রেখেছে। মানুষ ভয় পেয়েছে ভীষণ। জীবন যাত্রার প্রণালী যাচ্ছে বদলে। সামনের দিনগুলো বলতে পারবে কবে এর প্রতিষেধক পাওয়া যাবে। আশায় বুক বেধে আছে সমগ্র মানব জাতি।
শেষ করার আগে আমি আবার আমার আগের কথায় ফিরত যাব। প্রকৃতিকে বাচাতে না পারলে , আমাদের এর থেকে মুক্তি নেই। বর্তমান অবস্থা আমাদের সামাজিকতার ফাটল ধরিয়েছে, আটকে দিয়েছে ভ্রমন, অন্তরঙ্গতা ও বিচ্ছিন্নতায় ভুগছে মানুষ। দাগ পরছে মানসিক ভারসাম্যে। আমাদের এখন ভাবতে হবে কিভাবে আমরা আমাদের প্রকৃতি মা কে বাঁচাতে পারি। এখনকার জীবন পদ্ধতিতে এটা প্রায় অসম্ভব। আমরা আমাদের সুখের জন্য যা করছি প্রায় সবটাই আমাদের আবহাওয়াকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এর প্রতিষেধক দরকার। আর তা এখনি ভাবার সময়। এখনকার শ্লোগান হওয়া উচিৎ- “ প্রকৃতিকে বাঁচাও”। “ এসো সবাইকে নিয়ে একসাথে বাঁচি”। সবশেষে সৈয়দ শামসুল হকের কালজয়ী গান “ হায়রে মানুষ রঙ্গিন মানুষ দম ফুরাইলেই ঠুশ, তবুতো ভাই কারোরই নাই একটু খানি হুশ”। কবিরা স্বপ্ন দ্রষ্টা, তাই আগেই একথা বলে গিয়েছেন। এখন আমাদের সময় এসেছে হুঁশ ফেরাবার।
–আবুল জাকের, প্রাক্তন রোটারি জেলা গভর্নর
সিএ/এসএস
দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে cbna24.com
সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন