গণতন্ত্রের আবেগাপ্লুত বিজয় |||| ডঃ শোয়েব সাঈদ
সদ্য অনুষ্ঠিত নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পদ পরিবর্তনের খবরে বিশ্বব্যাপী সঞ্চারিত আবেগের কোন তুলনা যুক্তরাষ্ট্রের সমসাময়িক নির্বাচনী ইতিহাসে নেই। শনিবার, নভেম্বর ৭, সকাল এগারোটার কিছু পরে যখন পেনসিলভেনিয়ার ইলেক্টোরাল ভোটগুলো জো বাইডেনকে যুক্তরাষ্ট্রের “প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত” বানিয়ে দিল, আবেগ সামলাতে পারেনি প্রেসিডেন্ট ওবামার সাবেক উপদেষ্টা টিভি ব্যক্তিত্ব ভন জোন্স।
সিএনএন টিভিতে অশ্রুসিক্ত নয়নে বলছিলেন চরিত্র, সত্যবাদিতা আর সর্বোপরি ভাল মানুষ হওয়াটা ম্যাটারস অর্থাৎ জীবনের তরে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ট্রাম্প এগুলোর কোন কিছুরই ধার ধারেননি। বর্ণ, ধর্মে, জাতিতে বিদ্বেষ ছিল গত ৪ বছরের প্রধান কাজ। টুইটারে মিথ্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে মিডিয়া হিসেব করতে শুরু করল প্রেসিডেন্ট প্রতিদিন কি পরিমান মিথ্যে বলেন, অবমূল্যায়িত হতে হতে হাস্যকর হয়ে যাচ্ছিল প্রেসিডেন্ট পদের মর্যাদা। ভন জোন্সের এই আবেগের প্রতিচ্ছবি দেখেছি বিশ্বব্যাপী এমনকি বাংলাদেশী আমেরিকানদের চোখে মুখেও। ৩রা নভেম্বর রাত থেকেই টেনশনে ছিল পরিবর্তনকামী প্রতিটি মানুষ। নভেম্বরের ৪ তারিখ সকালে দেখলাম ফলাফলের ট্রেন্ডে যুক্তরাষ্ট্রের বাঙ্গালিদের মন খারাপ। মার্কিন মিডিয়ায় নির্বাচন বিশ্লেষণ, কোভিড ইমপ্যাক্ট আর ডাকযোগে ব্যালট বিপ্লবের বিষয়টি নিয়ে ধারণা থাকায় বন্ধুদের সান্ত্বনা দিলাম, অপেক্ষা করুন, নিরাশ হবার কিছু নেই। গত তিনদিনের আশা নিরাশার দোলাচল, ট্রাম্প আর তাঁর দলবলের হুঙ্কার, গুণ্ডামি মার্কিনীদের ধৈর্যকে প্রান্তিক অবস্থানে নিয়ে যাচ্ছিল। নভেম্বরের ৭ তারিখ বাইডেনের বিজয়ে অবস্থার দ্রুত পরিবর্তন ঘটে, মনে পড়ছিল বাংলাদেশে আমাদের ছাত্রজীবনের শেষ পর্যায়ে এরশাদ পতন আন্দোলনের অনুভূতির কথা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রেকর্ড পরিমান ভোটারের উপস্থিতির এই নির্বাচনের আজকের ফলাফল মার্কিন রাজনীতি, গণতন্ত্র আর বৈশ্বিক সভ্যতায় অবদানের মাইলস্টোন বটে।
বাংলাদেশি আমেরিকানদের বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ এই বিগোট বা গোঁয়ার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বিদায় চেয়েছিল নানা কারণে। যুক্তরাষ্ট্রকে নিজের দেশ মনে করা এই বিপুল বাংলাদেশীরা দ্বিতীয় শ্রেনীর নাগরিক হিসেবে চিহ্নিত হতে চাননি। দ্বিতীয় দফার ট্রাম্প নির্বাচিত হলে হারানোর কিছু নেই জেনে ট্রাম্পের যা খুশী করতে পারার মানসিকতা আর হোয়াইট সুপ্রিমেসী আদর্শজনিত অদ্ভুত সব এক্সেকিউটিভ অর্ডারে ন্যাচারালাইজড নাগরিকদের হেনস্তা হবার সম্ভাবনা তো ছিলই। হোয়াইট সুপ্রিমেসীর দগদগে ক্ষতটুকু ট্রাম্প যেভাবে পক্ষে বিপক্ষে উন্মুক্ত করে দিয়েছে তাতে যুক্তরাষ্ট্রের বিভাজিত সমাজে অন্য দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে স্থিতু হওয়া মানুষদের নার্ভাস হবারই কথা। আমরা দেখেছি ২০১৬ সালে ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পরপর যুক্তরাষ্ট্র-কানাডা সীমান্তে কানাডায় আশ্রয় চাওয়া হাজার হাজার মানুষের ডেস্পারেট মুভমেন্ট।
বাংলাদেশ থেকে অনেকে বলেছেন, আমেরিকার কে প্রেসিডেন্ট হলো না হলো তাতে আমাদের কি এসে যায়। আমি বলবো অনেক কিছু এসে যায়, বিস্তারিত ব্যাখা না করে শুধু এতটুকু বলা যায় যে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী আমার আপনার লাখ লাখ আত্মীয়-স্বজনদের আজকের মুখের এই হাসিটুকুতে আমাদের অনেক কিছু আসে যায়। জঙ্গি ধরণের সাম্প্রদায়িক মানসিকতার কিছু বিকারগ্রস্ত মানুষ ছাড়া অভিবাসী বাংলাদেশীদের বিপুল অংশের মুখের এই হাসিটুকু অনিশ্চয়তার ব্ল্যাকহোল থেকে বেঁচে যাবার এক স্বস্তিদায়ক অনুভূতি। গত চার বছর বিদেশী শিক্ষার্থীদের জন্যে যুক্তরাষ্ট্র ছিল আকর্ষণহীন জটিল ভেন্যু। আশা করা যাচ্ছে এই অবস্থার অবসান হবে।
অনেকেই বলছেন ট্রাম্পের ক্রেডিট মধ্যপ্রাচ্যে অন্য প্রেসিডেন্টদের মত যুদ্ধে জড়িত না হওয়া। এটি আপাত সত্য; বিভ্রান্তিকর এই আপাত সত্যের পেছনের আসল সত্যটি হচ্ছে ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য নীতি যুদ্ধের চেয়েও ভয়ংকর ক্ষতি করেছে মধ্যপ্রাচ্যে। ট্রাম্পের জামাতার ভূমিকা, জেরুজালেমকে রাজধানীর স্বীকৃতি মধ্যপ্রাচ্যে ব্যাপক অবিচারের কারণ। ইয়েমেন যুদ্ধ, ইরান নীতি মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ না করেও আগুন নিয়ে খেলার সামিল।
একজন কানেডিয়ান হিসেবে গত চার বছর যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কানাডার বানিজ্য, ইমিগ্রেশন ইত্যাদি নিয়ে তীব্র টানাপোড়েন বিষয়ে নিয়মিত আপটুডেট থেকেছি। নাফটা নিয়ে, এলুমিনিয়াম ট্যারিফ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আচরণ বন্ধসুলভ ছিলনা। প্রধানমন্ত্রী ট্রুডুকে ট্রাম্পের নাস্তানাবুদ করার মানসিকতা সবচেয়ে কাছের বন্ধু দেশ কানাডার জন্যে মর্যাদাজনক ছিলনা। যুক্তরাষ্ট্রের আবদার রাখতে গিয়ে হোয়াওয়ে চীফ ফাইনানশিয়াল অফিসারকে আটক করে কানাডা চীনের সাথে সম্পর্কে বড় ঝুঁকি নিয়েছে, চীন প্রতিশোধ নিতে গিয়ে আটক করে মৃত্যুদণ্ডের মুখোমুখি করেছে বেশ কয়েকজন কানেডিয়ানকে। ১৯৬৯ সালে নিক্সনের সময় কানাডার সাবেক প্রধানমন্ত্রী পিয়েরে ট্রুডু কানাডার সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ককে হাতির সাথে ঘুমানো বলে তুলনা করেছিলেন। হাতি যতই বন্ধুসুলভ হোক না কেন, সামান্য নাড়াচড়ায় আহত হবার সম্ভাবনা থাকে। আর ট্রাম্পের আমলে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কানাডা সম্পর্ক হচ্ছে বন্য হাতির সাথে ঝুঁকি নিয়ে ঘুমানো। এই অস্বস্তিকর পরিস্থিতির অবসানের প্রয়োজন ছিল, দ্বিতীয় টার্মে ট্রাম্পের আচরণ আরও অবন্ধুত্বসুলভ হবার সম্ভাবনা ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের ফলাফল বেরোবার সাথে সাথে জো বাইডেনকে সর্বপ্রথম অভিনন্দন জানিয়ে ট্রুডু’র টুইটকে অস্বস্তি থেকে দ্রুত মুক্তির আনন্দ বলা যায়। মন্ট্রিয়লের ওয়েস্ট মাউন্ট হাইস্কুলের গ্রাজুয়েট ভাইস প্রেসিডেন্ট ইলেক্ট কমলা হারিসের টিনএজ সময় কেটেছে এই মন্ট্রিয়লে। প্রেসিডেন্ট ইলেক্ট জো বাইডেন ওবামার সময় থেকেই ট্রুডু’র সাথে সুসম্পর্কে আবদ্ধ। আমেরিকায় ডেমোক্রেটদের আগমন কানাডার লিবারেলদের জন্যে খুবই ভাল বোধ করার অনুভূতি, কেননা উভয় দলই রক্ষনশীলদের আক্রমনের লক্ষ্যবস্তু।
এশিয়া, ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য থেকে মেক্সিকো, সর্বত্রই ট্রাম্পের বিদায়ে স্বস্তির বাতাস। তবে জানুয়ারির ২০ তারিখ ক্ষমতা ত্যাগের আগে ট্রাম্প আর কি কি করে যায় সেই অস্বস্তিতে আছে মার্কিনীরা। সুখবর হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রে সিস্টেম মহাপরাক্রমশালী ব্যক্তির চেয়েও পরাক্রমশালী। নির্বাচনী কাজে নিয়োজিত দেশপ্রেমিক কর্মকর্তারা লাভজনক পক্ষপাতিত্বের রুচিহীনতায় আক্রান্ত নন, বাধ্যও নন। ফলে এটি ধরে নেওয়া যায় দিনশেষে যুক্তরাষ্ট্রের সিস্টেমই আপাতত লিটিগেশন বা আইনি আশ্রয়ে মোহাবিষ্ট ক্রমশ বন্ধুহীন হয়ে যাওয়া ট্রাম্পকে সোজা পথে নিয়ে আসবে।
গণতন্ত্রের আবেগাপ্লুত বিজয় |||| ডঃ শোয়েব সাঈদ
লেখকঃ কলামিস্ট এবং মাইক্রোবিয়াল বায়োটেক বিষয়ে বহুজাতিক কর্পোরেটে ডিরেক্টর পদে কর্মরত এবং সিবিএনএ-এর উপদেষ্টা।
সিএ/এসএস
দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com
সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন