লেখালেখি

চার জন মানুষ আর গুনে গুনে চারটি ডালের পেঁয়াজু

চার জন মানুষ আর গুনে গুনে চারটি ডালের পেঁয়াজু, আলিফ আলম

 

চার জন মানুষ আর গুনে গুনে চারটি ডালের পেঁয়াজু

আমার পাশের বাসার প্রতিবেশী দাদু, ছোটবেলায় যার বাড়িতে রাগ করে ঢিল ছুঁড়তাম , তার নাম রেজিয়া তবে ছোট করে তাকে সবাই রেজু বলে ডাকে । ইফতার বানানোর সময় প্রায়েই তার কথা আমার অবচেতন ভাবেই মনে পড়ে যায় । মুক্তিযুদ্ধের সময় দাদা মারা যান , তারপর থেকেই ছোট ছোট ছয় বাচ্চা নিয়ে দাদুর জীবন সংগ্রাম শুরু । সেই সময়ে দাদার রেখে যাওয়া এক বিশাল পাকা দালানেই বলে দেয় , দাদা বেঁচে থাকলে তার জীবন কতই না সুন্দর হত ! আর এখন বাজারে একটা দোকান আর একটা আধা-পাকা ঘর যার ভাড়ার টাকা দিয়ে তার এত বড় সংসার চলে ।

দাদুর বিশাল বড় পাকা দালানের গা ঘেঁষে লাগোয়া এক চালা রান্নাঘর দেখতে বড় বেমানান লাগে । মাটির মেঝে আর হাজারও ছিদ্র করা টিন দিয়ে ঘেরাও করা, এক ছোট রান্নাঘর তার । ঘরের শেষ প্রান্তে মাটি কেটে উনুন বানানো হয়েছে । বৃষ্টি-বাদল আর বিদ্যুৎবিহীন দিন গুলোতে এই মাটির উনুনেই ভরসা । ঝকঝকে উনুনের ঠিক বাম পাশে একটা ছোট ,খোলা কাঠের তাক যেখানে সে রান্না শেষে খুব যত্ন করে ছোট ন্যাকড়া দিয়ে পাতিলের গা মুছে , তারপর সেই তাকে তুলে রাখে । তার ঠিক পাশে একটা মাটির পাত্র যা দাদু ভাতের মাড় ফেলার জন্য ব্যবহার করে । একটা ছোট চিকন কাঠের কাঠি যা খুব যত্ন করে পানি দিয়ে ধুয়ে টিনের গায়ের কাঠের মধ্যে গুঁজে রাখা হয়েছে । রান্নাঘরের বাঁ পাশে একটা শিল নোড়া উলটো করে দাঁড় করানো । এই তার ছিমছাম রান্নাঘর তবে ভীষণ ঝকঝকে আর পরিপাটি । মাটির মেঝে বলে রান্নাঘরে প্রায়েই ছোট ছোট গর্ত দেখা দেয় । ছোট বালতিতে মাটি আর পানি নিয়ে দাদু খুব যত্ন করে গর্ত বন্ধ করে, মাঝে মাঝে মেঝেটা লেপে দেয় । তার রান্নাঘরের এই বেহাল দশা দেখে তার আর্থিক অবস্থা খুব সহজেই অনুমান করা যায় । দাদা বেঁচে থাকলে হয়ত তার এই কষ্টের মুখ দেখতে হত না।

বিকাল হলেই তার বাড়িতে হানা না দিলে, আমার যেন চলত না । এমন হতদরিদ্র একটা রান্নাঘরে কি করে দাদু এত সুন্দর করে গুছিয়ে কাজ করে, তা দাঁড়িয়ে দেখাই ছিল আমার একটা প্রিয় কাজ । রোজার বিকেল গুলোতে প্রায়েই দাঁড়িয়ে দেখতাম, দাদু কড়াইয়ে খুব যত্ন করে সামান্য তেল ঢেলে তাতে মাত্র চারটে ডালের পেঁয়াজু খুব যত্ন করে ভেজে তুলছে । বাসার সদস্য সংখ্যা এখন সবে চার জন, বাকী মেয়েরা শ্বশুর বাড়িতে তাই চারটে পেঁয়াজুতেই তাদের দিব্যি চলে যায় ।

ইফতারের আগে আমাদের বাসায় ফিরে এসে দেখতাম , প্রতিজনের জন্য আলাদা আলাদা প্লেটে ইফতার সাজানো । মা দাদুর কথা জানতেন বলে , আমাকে দিয়ে প্রায়েই দাদুর বাসায় ইফতার পাঠাতেন । আজানের কিছুক্ষণ আগে ইফতার দিতে গিয়ে দেখতাম , প্রতিদিনকার বানানো চারটে ডালের পেঁয়াজু একটা বড় পাত্রে সামান্য ছোলা ভুনা, মুড়ি আর সর্ষের তেল দিয়ে মাখিয়ে সবাই ইফতার করার জন্য বসে আছে । এক পাত্র থেকে সবাই মিলে ইফতার করার মজাই আলাদা তবে তাদের ক্ষেত্রে এক সঙ্গে খাওয়ার উদ্দেশ্য ছিল ভিন্ন রকম । খেয়াল করতাম আমাদের বাসার ইফতার পেয়ে সবার চোখে কেমন আনন্দ খেলে যেত । বাসায় ফিরে এসে দেখতাম আমার একার প্লেটেই পাশের বাসার দাদুর বাসার চার জনের সমান ইফতার সাজানো ।

রোজার বিকেলে ইফতার বানাতে গিয়ে কেন যেন দাদুর কথা খুব মনে পড়ে । কড়াইয়ে পেঁয়াজু ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চারপাশ থেকে গরম তেল এসে কি অস্থিরভাবে পেঁয়াজুগুলোকে ঘিরে ধরে, ঠিক যেন আমাকে আমার ভাবনার মত।

আলিফ আলম, কথাসাহিত্যিক ।  মন্ট্রিয়ল

 

সিবিএনএ/এসএস


সর্বশেষ সংবাদ

দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে cbna24.com

সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

 

সংবাদটি শেয়ার করুন