ছাত্র ও জনতার ২৩ দিনের দেশ কাঁপানো আন্দোলনে পতন হলো আওয়ামী লীগ সরকারের। শেখ হাসিনা গতকাল সোমবার রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের কাছে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগপত্র জমা দেন। এরপর বঙ্গভবন থেকেই হেলিকপ্টারে দেশ ছাড়েন। সে সময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন তাঁর বোন শেখ রেহানা।
শেখ হাসিনার পদত্যাগের মধ্য দিয়ে তাঁর টানা সাড়ে ১৫ বছরের শাসনের অবসান হলো। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনে জনগণের বিপুল সায় নিয়ে তিনি ক্ষমতায় বসেছিলেন। এরপর নিজের শাসনামলে আর কোনো গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন তিনি হতে দেননি।
শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে ভোটাধিকার ও বাক্স্বাধীনতা হরণ, মানবাধিকার লঙ্ঘন, ব্যাপক দুর্নীতি ও অর্থ পাচার, দেশকে স্বজনতোষী পুঁজিবাদের কবলে ফেলা, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করা, ঋণের নামে ব্যাংক লুটের সুযোগ দেওয়া, আয়বৈষম্য চরম পর্যায়ে নিয়ে যাওয়াসহ বিস্তৃত অভিযোগ রয়েছে। এসবের বিপরীতে তিনি ঢাল হিসেবে ব্যবহার করতেন অবকাঠামো ও অর্থনৈতিক উন্নয়নকে। কিন্তু শেষ সময়ে অর্থনীতিকেও সরকার সংকটে ফেলেছিল। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত (রিজার্ভ) কমে গেছে, খেলাপি ঋণ ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে, দ্রব্যমূল্য সীমিত আয়ের মানুষের নাগাল ছাড়া হয়ে গেছে।
দেশের মানুষের এসব সমস্যা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হলে শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকারের মন্ত্রীদের মুখে উপহাস শোনা যেত। কেউ কেউ বলতেন, দেশ সিঙ্গাপুর হয়ে গেছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, সমাজের সব শ্রেণি ও পেশার মানুষের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ তৈরি হয়েই ছিল। সেটার বহিঃপ্রকাশ ছিল শুধু সময়ের অপেক্ষা। উপলক্ষ তৈরি করে দেয় সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের আন্দোলন। এর আগেও ২০১৮ সালে নিরাপদ সড়ক আন্দোলন এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভ্যাট (মূল্য সংযোজন কর) আন্দোলনে (২০১৫) যার লক্ষণ দেখা গিয়েছিল।
কোটা সংস্কার আন্দোলন লাগাতারভাবে শুরু হয় গত ১ জুলাই। ১৪ জুলাই প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনার ‘রাজাকার’ সংক্রান্ত এক বক্তব্য ও শিক্ষার্থীদের দাবিকে আইন-আদালতের চক্করে ফেলার পর তাঁর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যান শিক্ষার্থীরা। সেদিন রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী বেরিয়ে এসে স্লোগান দেওয়া শুরু করেন, ‘তুমি কে, আমি কে, রাজাকার, রাজাকার; কে বলেছে, কে বলেছে, স্বৈরাচার, স্বৈরাচার।’
বাংলাদেশে বিগত সাড়ে ১৫ বছরে শেখ হাসিনাকে নিয়ে প্রশ্ন তোলার সাহস কেউ পায়নি। নিবর্তনমূলক আইন, গুম, গ্রেপ্তার, হয়রানি ও চাপের মুখে নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যম ছিল কোণঠাসা। এই প্রথম শিক্ষার্থীরা শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গেলেন, স্লোগান দিলেন; শুরু হলো কোটা সংস্কার আন্দোলনের নতুন যাত্রা।
১৫ জুলাই শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের দিন ছাত্রলীগকে নামিয়ে দেওয়া হয় শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে। ওই দিন এক সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকার’ স্লোগানের জবাব ছাত্রলীগই দেবে। তারা প্রস্তুত। এরপরই ছাত্রলীগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর ব্যাপকভাবে হামলা চালায়। দফায় দফায় ছাত্রীদেরও ধরে ধরে পেটানো হয়। গুলি করা হয় শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে।
১৭ জুলাই বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদকে খুব কাছ থেকে গুলি করে খুন করে পুলিশ। সেই ভিডিও চিত্রই কাজ করেছে বারুদে একটি দেশলাইয়ের কাঠির মতো। এরপর দেশজুড়ে বিক্ষোভ শুরু হয়। স্লোগান দেওয়া হয় এই বলে যে ‘বুকের ভেতর অনেক ঝড়, বুক পেতেছি, গুলি কর।’
সত্যিই গুলি করা হবে, তা হয়তো ভাবতে পারেননি বিক্ষোভকারীরা। সাধারণ মানুষও ভাবতে পারেননি, কয়েক দিনেই ২০০ জনের বেশি শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষকে মেরে ফেলা হবে। কেউ হয়তো ভাবতে পারেননি, ঘরের মধ্যে থাকা শিশু, ছাদে থাকা কিশোরী, বারান্দায় থাকা মানুষ গুলিতে নিহত হবেন। যদিও ১৯ জুলাই কারফিউ জারি করার বিষয়টি জানিয়ে ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, ‘শুট অন সাইট’ বা দেখামাত্র গুলির নির্দেশ জারি করা হয়েছে।
বাংলাদেশে যা কখনো হয়নি, তা-ই হলো; বিপুল সংখ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়শিক্ষার্থীদের গুলি করে মারা হলো, কলেজশিক্ষার্থীদের গুলি করে মারা হলো, স্কুলশিক্ষার্থীদের গুলি করে মারা হলো। মায়েরা কাঁদলেন, বাবারা কাঁদলেন, সহপাঠীরা কাঁদলেন। ক্ষোভে ফুঁসে উঠল দেশ। একে একে শিক্ষক, অভিভাবক, আইনজীবী, শিল্পী, সাহিত্যিক, সংস্কৃতিকর্মী, সাংবাদিক, অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা সমর্থন জানাতে শুরু করলেন শিক্ষার্থী ও তরুণদের আন্দোলনে।
শিক্ষার্থীদের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কেরা ৯ দফা দাবি জানিয়েছিলেন। সেই দাবি পূরণের বদলে বেছে নেওয়া হয় নির্যাতন ও গণগ্রেপ্তারের পুরোনো পথ, যা শেখ হাসিনা তাঁর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ১৫ বছর ধরে প্রয়োগ করেছেন। কয়েক দিনের মধ্যে ১০ হাজারের বেশি মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়। বাদ যায়নি এইচএসসি পরীক্ষার্থীরাও। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম, সারজিস আলম, হাসনাত আবদুল্লাহ, আসিফ মাহমুদ, আবু বাকের মজুমদার ও নুসরাত তাবাসসুমকে তুলে নিয়ে আটকে রাখা হয় ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) কার্যালয়ে। সেখান থেকে জোর করে আন্দোলন প্রত্যাহারের ভিডিও বার্তা দেওয়ানো হয়।
মানুষের প্রতিবাদ এবং সমন্বয়কদের অনশনের মুখে তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হয়। ২ আগস্ট ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে ৯ দফা দাবিকে এক দফায় রূপান্তর করা হয়। বলা হয়, সরকারকে পদত্যাগ করতেই হবে। ওদিকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী জনগণের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে অস্বীকৃতি জানায়। পুলিশ আর গুলি করতে রাজি ছিল না। শেখ হাসিনা শেষ চেষ্টা হিসেবে নামিয়ে দেন তাঁর রাজনৈতিক শক্তিকে।
৪ আগস্ট ঢাকার রাস্তায় এবং দেশজুড়ে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা-কর্মীরা বিক্ষোভকারীদের ওপর হামলা করেন। তাঁদের কারও কারও হাতে ছিল আগ্নেয়াস্ত্র, অনেকের হাতে ছিল দেশীয় অস্ত্র। ওই দিন সংঘর্ষে নিহত হন অন্তত ১১৪ জন মানুষ।
যদিও ছাত্র-জনতার প্রতিরোধের মুখে আওয়ামী লীগ বেশি সময় রাজপথে টিকতে পারেনি। ওই দিনই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে ‘মার্চ টু ঢাকা’ বা ঢাকামুখী গণযাত্রার ডাক দেওয়া হয়। গতকাল এই কর্মসূচির দিন সকালে কয়েকটি জায়গায় পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষ হয়। দুপুর নাগাদ স্পষ্ট হয়ে যায় যে সরকার নড়বড়ে হয়ে গেছে। বেলা আড়াইটায় হেলিকপ্টারে করে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা, যিনি কদিন আগেই (১ আগস্ট) বলেছিলেন, ‘আওয়ামী লীগ বা শেখ হাসিনা কখনো পালিয়ে যায় না।’
শেখ হাসিনা বঙ্গভবন থেকে একটি সামরিক হেলিকপ্টারে তাঁর বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে উড্ডয়ন করেন। তিনি ভারতের আগরতলা হয়ে দিল্লি যান।
সব মিলিয়ে ১৪ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট—শিক্ষার্থীরা শেখ হাসিনার মুখোমুখি অবস্থান নেওয়ার পর ২৩ দিনে বাংলাদেশের মানুষ মুক্তি পায় ‘অপশাসন’ থেকে।
শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার খবর শুনে যোগাযোগ করা হয় আওয়ামী লীগের এক শীর্ষস্থানীয় নেতার সঙ্গে। তিনি নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, শেখ হাসিনা কারও কথা শোনেননি। তাঁর কারণেই রোববার আওয়ামী লীগকে মাঠে নামতে হয়েছে। নিহত হয়েছেন ১১৪ জন মানুষ। শেষ পর্যন্ত তিনি দলের নেতা-কর্মীদের চরম সংকটে রেখে বিদেশ চলে গেলেন। তিনি বলেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে শেখ হাসিনার একগুঁয়েমি ও বারবার ভুল পদক্ষেপের ফলে আওয়ামী লীগ এখন অস্তিত্বের সংকটে। নেতা-কর্মীরা হত্যার ঝুঁকিতে।