দেশের সংবাদ ফিচার্ড

ছয়দিনে তছনছ সম্প্রীতির বাংলাদেশ

ছবি: সংগৃহীত

ছয়দিনে তছনছ সম্প্রীতির বাংলাদেশ

মো. ফরহাদ উজ্জামান ।। কুমিল্লায় একটি পূজামণ্ডপে কোরআন অবমাননার জেরে গত ছয়দিনে তছনছ সমপ্রীতির বাংলাদেশ। এ ঘটনায় ঢাকা, কুমিল্লা, ফেনী, কিশোরগঞ্জ, চাঁদপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মন্দির ও পূজামণ্ডপে হামলা হয়েছে। তবে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ও সংখ্যালঘু নির্যাতন এ দেশে নতুন কোনো ঘটনা নয়। এ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর পাল্টাপাল্টি অভিযোগ করলেও সব সরকারের আমলজুড়ে সংখ্যালঘু নির্যাতন ও তাদের সম্পত্তি দখলে পিছিয়ে নেই কোনো রাজনৈতিক দলই। এই তালিকায় আছেন সংসদ সদস্য, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ রাজনৈতিক প্রভাবশালীরা।

সংখ্যালঘু নেতারা মনে করেন, সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতনে সাম্প্রদাতিকতা যেমন আছে, তেমনি রাজনৈতিক কারণও আছে।

অব্যাহতভাবে সংখ্যালঘু নির্যাতনের কারণ হিসেবে বিচারহীনতা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গাফিলতি ও দায় এড়ানোর সংস্কৃতিকেই দায়ী করছেন সংখ্যালঘু নেতারা। এ ঘেড়াটোপেই ঘুরপাক খায় সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিষয়টি। বুধবার থেকে শুরু হওয়া এসব সহিংসতায় এখন পর্যন্ত ছয়জনের মৃত্যু হয়েছে, আহত হয়েছে কয়েকশ’ মানুষ।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কুমিল্লার পূজামণ্ডপের ঘটনা নিয়ে এখন চুলচেরা বিশ্লেষণ হবে, রাজনৈতিক নেতৃত্ব একে অপরকে দায়ী করে লম্বা বিবৃতি দেবে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ডজনখানেক মামলা করবে, সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের পাকড়াও করে জেলখানায় পাঠাবে। কিন্তু তাতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের মনে যে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে, হৃদয়ে যে রক্তাক্ত হয়েছে, তার উপশম হবে না।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত ৯ বছরে বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর সাড়ে ৩ হাজারের বেশি হামলা হয়েছে।

আসকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩ সাল থেকে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৮ বছর ৯ মাসে হিন্দুদের ওপর ৩ হাজার ৬৭৯টি হামলা হয়েছে। এর মধ্যে ১ হাজার ৫৫৯টি বাড়িঘর ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা। এই সময়ে হিন্দুদের ৪৪২টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুর ও আগুন দেয়া হয়েছে। প্রতিমা, পূজামণ্ডপ, মন্দিরে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে এক হাজার ৬৭৮টি। এসব হামলায় আহত হয়েছে ৮৬২ জন হিন্দু ধর্মাবলম্বী, নিহত হয়েছে ১১ জন।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত বাংলাদেশ জার্নালকে বলেন, প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশি। দুর্গাপূজার মধ্যে গত ১৩ অক্টোবর কুমিল্লার একটি মণ্ডপে কোরআন অবমাননার কথিত অভিযোগ তোলা হয়। এ ঘটনার জেরে গত কয়েকদিনে দেশের বিভিন্ন স্থানে ৭০টির বেশি পূজামণ্ডপে হামলা-ভাঙচুর-লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে।

হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের এই নেতা বলেন, বাংলাদেশ তৈরি হয়েছিল বাঙালিত্বের ধারণা থেকে। এই ধারণা থেকে বাংলাদেশ অনেক সরে এসেছে। সংবিধানকে সাম্প্রদায়িক করা হয়েছে। এই সংবিধান সাম্প্রদায়িক শক্তিকে উৎসাহিত করছে। বিএনপি সাম্প্রদায়িক শক্তিকে ক্ষমতার অংশীদার করেছিল। বর্তমান সরকার তাদের ক্ষমতার অংশীদার না করলেও সাম্প্রদায়িক শক্তির কাছে এক রকম আত্মসমর্পণ করেছে। তাদের সঙ্গে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের আঁতাত চলছে। এ কারণে পাঠ্যপুস্তকে পর্যন্ত সামপ্রদায়িক শক্তির নির্দেশনার ভিত্তিতে পরিবর্তন আনা হয়েছে। এই কারণে এখন সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের শিকারদের পক্ষে পুলিশ, প্রশাসন কাউকে পাওয়া যায় না।

জাতীয় পার্টি, বিএনপির আমলে হিন্দু সমপ্রদায়ের ওপর হামলার তথ্য তুলে ধরে তিনি বলেন, ১৯৯০ সালে এরশাদের আমলে তিন দিন, ১৯৯২ সালে খালেদা জিয়া ক্ষমতায় আসার পর ২৭ দিন এবং ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াতের আমলজুড়ে সংখ্যালঘু নির্যাতন হয়েছে।

রাজনৈতিক দলের পাল্টাপাল্টি দোষারোপ

ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনায় বরাবরই দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে পাল্টাপাল্টি দোষারোপ চলে। এবারও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতারা বিএনপি এবং তাদের জোটসঙ্গী দলগুলোকে দায়ী করেছে হিন্দুদের ওপর হামলার জন্য।

আবার বিএনপি নেতারা দাবি করছেন, ক্ষমতাসীনরাই এসব ঘটিয়েছে। এ বিষয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দাবি করেছেন, সারা দেশে পূজামণ্ডপে হামলার ঘটনা ‘সরকারি মদদেই’ হয়েছে। দাঙ্গা, সামপ্রদায়িক সমপ্রীতি বিনষ্ট করা, এটা ক্ষমতাসীনদের মদদ ছাড়া সম্ভব নয়।

বিভিন্ন মন্দির ও পূজা মণ্ডপে হামলায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকার সমালোচনা করে মির্জা ফখরুল বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উদাসীনতার কারণে এগুলো হয়েছে। তারা নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছে গোটা বিষয়ে। সরকারের মদদপুষ্ট হয়ে এ ঘটনাগুলো ঘটছে। আওয়ামী লীগ যখনই ক্ষমতায় এসেছে, তখনই সংখ্যালঘু সমপ্রদায়ের ওপর হামলা ও তাদের ঘরবাড়ি ভাঙচুর হয়েছে।

অন্যদিকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতা গ্রহণের পর হিন্দুদের যেই নির্যাতন চালিয়েছিল, তারই পুনরাবৃত্তি আবার নতুন করে ঘটছে। তারা নতুন করে সামপ্রদায়িকতাকে উসকে দিচ্ছে এবং সহযোগিতা করছে।

তিনি বলেন, বিএনপির শাসনামলে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের জন্য প্রতিটি রাত ছিল দুঃস্বপ্নের মতো। শুধু তা নয়, সনাতন ধর্মালম্বীদের জন্যও প্রতিটি রাত ছিল দুঃস্বপ্নের এই বুঝি মন্দিরে, বাড়িঘরে হামলা হলো। শেখ হাসিনা সরকারের আমলে প্রতিটি দুর্গাপূজা শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে। অথচ এবারই শান্তি বিনষ্ট করা হয়েছে।

এদিকে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ করলেও সংখ্যালঘু নির্যাতন ও তাদের সম্পত্তি দখলে পিছিয়ে নেই কোনো রাজনৈতিক দলই। এই তালিকায় আছেন সংসদ সদস্য, স্থানীয় প্রতিনিধিসহ রাজনৈতিক প্রভাবশালীরা।

জানতে চাইলে রানা দাশগুপ্ত বলেন, তাদের সাহস এতটাই বেড়েছে, প্রধানমন্ত্রীর হুঁশিয়ারির পরের দিনই ১৫ অক্টোবর দেশের প্রায় শতাধিক মণ্ডপে প্রতিমা ও সংখ্যালঘুদের বাড়িঘরে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করা হয়। পুলিশের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তারা।

তিনি বলেন, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর আমরা আশা করেছিলাম এই ধারার পরিবর্তন হবে। কিন্তু ২০১১ সাল থেকে গত কয়েকদিনের হামলা পর্যন্ত একই ধারায় সংখ্যালঘু নির্যাতন হয়ে আসছে। এগুলো কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, সবই পরিকল্পিত। এই হামলার পেছনে ৫টি কারণ রয়েছে বলে মনে করেন তিনি।

প্রথমত, সামপ্রদায়িক শক্তি চাইছে এ দেশ থেকে সংখ্যালঘুদের তাড়িয়ে তাদের সম্পত্তি দখল করতে। এখানে রাজনৈতিক শক্তিও কাজ করছে।

দ্বিতীয়ত, এ দেশ থেকে সংখ্যালঘুদের তাড়িয়ে কিছুটা জনসংখ্যার ভার হ্রাস করা।

তৃতীয়ত, দেশটাকে মুসলিম রাষ্ট্রে পরিণত করা।

চতুর্থত, এ দেশে যে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটছে, তাকে বাধাগ্রস্ত করা

পঞ্চমত, আগামী জাতীয় নির্বাচনকে লক্ষ্য রেখে তারা একটা অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করতে চাইছে।

এ বিষয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, কুমিল্লার এই ধারাবাহিক সহিংসতাকে আর বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলার সুযোগ নেই। আমরা আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করলাম, রাজনৈতিক দোষারোপের ঘেরাটোপে আটকে আছে এসব ঘটনা। বিচার না হওয়ায় এ ধরনের সহিংসতা আরও বেশি ঘটছে। তাই কুমিল্লার ঘটনা কেন্দ্র করে দেশব্যাপী হিন্দু সম্প্রদায়ের মন্দির, বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ জীবন-জীবিকার ওপর প্রায় সপ্তাহব্যাপী চলমান সামপ্রদায়িক হামলা বন্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ মাঠ প্রশাসন দুঃখজনক ব্যর্থতার পরিচয় দিল।

তিনি বলেন, ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর শতাধিক মামলায় কয়েক হাজার আসামি করা হলো। অথচ চিরাচরিত রাজনৈতিক দোষারোপের বাইরে এখন পর্যন্ত অধিকাংশ স্থানেই প্রকৃত অপরাধীদের চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি। এই ঘটনার পূর্ববর্তী সব সহিংসতাতেও আমরা একই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি দেখতে পাই। এতে প্রকৃত অপরাধীরা আড়ালে চলে যায় এবং নিয়মিত বিরতিতে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ঘটতেই থাকে।

এ প্রসঙ্গে রানা দাশগুপ্ত বলেন, আমরা বলেছিলাম একটি সংখ্যালঘু কমিশন ও সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন গঠন করা হোক। কিন্তু আড়াই বছর হলেও বর্তমান সরকারি দল তার নির্বাচনী অঙ্গীকার রাখেনি। ২০০৮ সালে নির্বাচনে সংখ্যালঘুদের ওপর সহিংসতার ঘটনার বিষয়ে হাইকোর্টে একটি রিট হয়েছিল। বিচারপতি শাহাবুদ্দীন কমিশনে আমরা ১৫ হাজার কেসের তথ্য-উপাত্ত দিয়েছিলাম। ২০১১ সালে তার একটা রিপোর্ট দেয় কমিশন। কিন্তু এ পর্যন্ত তা আলোর মুখ দেখেনি। আমরা চাই সরকার এই মেয়াদে সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন বাস্তবায়ন করবে, সংখ্যালঘু কমিশন গঠন, বৈষম্য বিলোপ আইন প্রণয়ন, অর্পিত সম্পত্তি আইনের বাস্তবায়ন প্রকৃত মালিকদের হাতে হস্তান্তর এবং সরকারের জিরো টলারেন্স নীতির পূর্ণ বাস্তবায়ন চাই।

এদিকে কুমিল্লার ঘটনা কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন স্থানে পূজামণ্ডপ, মন্দির ও হিন্দু জনপদে ‘সামপ্রদায়িক হামলা’র ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৭১টি মামলা হয়েছে। এসব ঘটনায় জড়িত সন্দেহে ৪৫০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাংলাদেশ জার্নালকে এ তথ্য জানান পুলিশ সদর দপ্তরের মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স উইংয়ের কর্মকর্তা মো. কামরুজ্জামান ।

তিনি বলেন, মণ্ডপকেন্দ্রিক অপ্রীতিকর ঘটনায় এ পর্যন্ত ৭১টি মামলা হয়েছে। আরও কিছু মামলা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এসব ঘটনায় জড়িত সন্দেহে ৪৫০ জনকে আটক করা হয়েছে, আটকের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।

গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, সাম্প্রদায়িক শান্তি বিনষ্টের জন্য কিছু ব্যক্তি ও গোষ্ঠী উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব ছড়িয়ে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা করছে। অনেক ক্ষেত্রে চক্রান্তকারীরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের পোস্ট বা তথ্য বিকৃত করে, অপব্যাখ্যাও দিয়ে বিভিন্ন মাধ্যমে ছড়িয়ে সংঘাতমূলক পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টায় লিপ্ত থাকে। খুব দ্রুত দোষীদের আইনের আওতায় আনা হবে। বাংলাদেশ জার্নাল

 

এসএস/সিএ


সর্বশেষ সংবাদ

দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com

সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

সংবাদটি শেয়ার করুন