ফিচার্ড লেখালেখি

ডাঃ মুরাদ বিভ্রান্তি আর কানেডিয়ান মূল্যবোধ  ||||| ড. শোয়েব সাঈদ

ডাঃ মুরাদ বিভ্রান্তি আর কানেডিয়ান মূল্যবোধ  ||||| ড. শোয়েব সাঈদ

ডাঃ মুরাদকে নিয়ে বিমান যখন আকাশে, বাংলাদেশের নামকরা বহু সংবাদপত্রে একটি  বিল্ডিং এর সামনে ছবি দিয়ে নিউজ হল তিনি এখন মন্ট্রিয়লে। নিউজটি প্রকাশের সময় দেখে মজা পেলাম, কারণ এমিরাটসের ফ্লাইট নামার সময় হয়নি তখনো; ইমিগ্রেশন, কোভিড সংক্রান্ত চেকিং, কাস্টমস  পার হয়ে টরেন্টো থেকে ৫৫০ কিলোমিটার দূরের মন্ট্রিয়লে বিমান বা সড়ক যেভাবেই হওক যেতে আরও ৬-১০ ঘণ্টা লেগে যাবার কথা। যারা নিউজটি ছেপেছেন বা সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন উনাদের বোধবুদ্ধি বিবেচনায় খবরটির সত্যতা একটু  যাচাই করে নেবার মানসিকতা ছিল বলে মনে হয়নি।

সংবাদপত্রে আরও খবর ছিল উনি টরেন্টো না হয়ে মন্ট্রিয়লে ল্যান্ড করবেন। কিন্তু মন্ট্রিয়লে এমিরাটসের কোন ফ্লাইট নেই এমনকি এয়ার কানাডার দুবাই মন্ট্রিয়ল ফ্লাইটও নেই, সেই ক্ষেত্রে মন্ট্রিয়লে ফ্লাইট আছে এমন দেশে গিয়ে বিমানে উঠতে হবে। এমিরাটসে আসলে টরেন্টোতে ইমিগ্রেশন করতে হবে।  যাত্রা শুরুর পয়েন্ট থেকে বোর্ডিং পাস পাবার পর ট্রানজিটে পরিবর্তন বেশ জটিল, লে-ওভার সময় এবং সিট প্রাপ্যতার উপর নির্ভরশীল। বিষয়টি আরও জটিল হবে যদি আনএকোম্পানিড বা প্লেনে দিয়ে দেবার লাগেজ থাকে। এই সব ক্ষেত্রে পাসপোর্ট লাল না সবুজ তাতে কিছু আসে যায় না। বাংলাদেশী লাল পাসপোর্টে সুবিধে কিছুটা বেশী কিন্তু অবাধ নয়, লাল পাসপোর্টে অনেক সীমাবদ্ধতা আছে যা সাধারণ পাসপোর্টে নেই।

কেউ কেউ তো আগ বাড়িয়ে মন্ট্রিয়লে জামালপুর/সরিষাবাড়ি সংশ্লিষ্ট কোন কোন বাড়িতে যেতে পারেন তারও হিসেব করা শুরু করলেন।

নানা রকম বিভ্রান্তিকর তথ্যের মাঝে সঠিক তথ্যে সঠিক ধারণায় দেখলাম প্রথম রিপোর্ট করেছেন টরেন্টো থেকে সাগর ভাইয়ের পত্রিকা নতুন দেশ। বছরে লক্ষাধিক মাইল ফ্লাই করা আর ইমিগ্রেশন নিয়মকানুনে আপডেট থাকার নিজস্ব অভিজ্ঞতায় ডাঃ মুরাদকে কানাডায় প্রবেশ করতে না দেবার সাগর ভাইয়ের তাজা খবরটি আমি তৎক্ষণাৎ শেয়ার করলাম বিশ্বাসযোগ্য হবার কারণে।

আমি খেয়াল করলাম বাংলাদেশের সংবাদপত্র এই খবরটি হজম করতে অনেক সময় নিল। প্রায় ৩-৪ ঘণ্টা হাইবারনেশনে থাকার পর বাংলাদেশের পত্রিকাগুলো খবরটি ছাপাতে শুরু করল। আমাদের সময় ডট কমের সাথে আমার কথা হয়েছিল এবং উনারা আগেবাগেই খবরটি ছেপেছেন।

নতুন দেশ আর সাগর ভাইকে জনগণের আগ্রহের অনুসন্ধানী এই সংবাদটি সংগ্রহে নেতৃত্ব দেবার জন্যে ধন্যবাদ।

তারপর বাংলাদেশে টকশোগুলোর পালা; সংবাদপত্র আর মিডিয়া জগতের দিকপালগণ কথা বলছেন এই বিষয়ে, সেখানেও  অনেকের বক্তব্যে তথ্যের গোঁজামিল। কোভিডের কাগজপত্র ঠিক নেই বলে কথা বলছেন অনেকেই। কানাডা বর্ডার সার্ভিসেস এজেন্সি অনেক কারণেই আপনার প্রবেশ আটকাতে পারে, ভ্যাকসিন না দেওয়া থাকলে আপনাকে ফিরিয়ে দেবারও ক্ষমতা রাখে, তবে সাধারণত এই ক্ষেত্রে কোয়ারেন্টাইনে পাঠানো হয়।

এমিরাটসের মত বিমান সংস্থা যে দেশে যাত্রী নিয়ে যাচ্ছেন,  সেই দেশের কোভিড গাইড লাইন বিশেষ করে টেস্ট আর ভ্যাকসিনেশনের মত মৌলিক বিষয় অমান্য করে যাত্রীকে বিমানে বহন করে মোটা অংকের পেনাল্টি গুনার তো কথা নয়। বাংলাদেশের বিমানবন্দরে ক্ষমতা দেখানো গেলেও দুবাই টরেন্টো ফ্লাইটে তো সেটি সম্ভব নয়।

এই ইস্যুতেও আবারো দেখলাম বাংলাদেশে নামী দামী সাংবাদিকদের পেশাগত দুর্বলতা।

দেখুন ঘর থেকে বাহির করে (ডিপোর্ট) দেওয়া আর ঘরে ঢুকতে না দেওয়া অর্থাৎ দরজা থেকে বিদায় করে দেওয়া দুটো ভিন্ন বিষয়। ডাঃ মুরাদের ক্ষেত্রে উনাকে কানাডাতে প্রবেশ করতেই দেওয়া হয়নি, ফলে ডিপোর্ট নয়, এটি হবে এন্ট্রি ডিনাইড।

বিভিন্ন দেশে আইনকানুনের গুরুত্ব বিভিন্ন রকম।  বহুজাতিগোষ্ঠীর কানেডিয়ান সমাজের নিজস্ব কিছু মূল্যবোধ আছে আপনি পছন্দ করুন বা না করুন। সমতা, শ্রদ্ধা, নিরাপত্তা এখানে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় লালিত। এখানে রাষ্ট্র জনগণের কথা শুনে, জনমত উপেক্ষিত নয়। ব্যক্তি বিশেষের আচরণে কিছু অসঙ্গতি থাকলেও রাষ্ট্র এই ব্যাপারে আপোষহীন।

কোন ক্রাইমে কতুটুকু গুরুত্ব, রাষ্ট্র বিশেষে হেরফের আছে। কানাডায় চোর আপনার বাড়ি খালি করে ফেললেও দেখবেন পুলিশের ভূমিকা বহু ক্ষেত্রে সিরিয়াস নয়, সরকারী সুবিধে কানাডায় অনেকেই অন্যায়ভাবে নিচ্ছে, সরকার জানে কিন্তু তেমন ধরপাকড় নেই। চীন বা অন্য দেশ থেকে বস্তা বস্তা অর্থ নিয়ে এসে বিনিয়োগে কানাডার নীরব আস্কারা কিন্তু জাতীয় স্বার্থেই। কানাডার এসব বিষয়ে যারা ট্রল করছেন তারা কিন্তু আমাদের ব্যর্থতা অর্থাৎ দেশ থেকে টাকা বের হবার বিষয়টি আমলে নিচ্ছেন না। সন্ত্রাসবাদজনিত মানিলন্ডারিং এ কিন্তু কানাডা ঠিকই কঠোর।

এই কানাডায় কোন মানুষের গায়ে হাত তুলে দেখুন, সাথে সাথে পুলিশ এসে হাজির। নারীকে অসন্মান বা নিরাপত্তার সমস্যায় মুহূর্তের মধ্যে পুলিশ এসে হাজির। ডাঃ মুরাদের বিরুদ্ধে বেশ কড়া ভাষায়, তথ্য উপাত্ত দিয়ে কানাডা কর্তৃপক্ষের কাছে অনেক অভিযোগ জমা হয় বলে জানা যায়। অভিনেত্রী মাহির সাথে উনার কথোপকথনের বিষয়টি টেনে নারী আর বর্ণ  বিদ্বেষের আলোকে উনাকে কানাডা সমাজের নিরাপত্তায় হুমকি হিসেবে দেখানো হয়। ফলে অভিযোগটি গুরুত্ব পেয়েছে। মহিলা সহকর্মীদের সাথে অসঙ্গত আচরণে কানাডায় শীর্ষ জেনারেলদেরও চাকুরী হারিয়ে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়।

বঙ্গবন্ধুর খুনীদের কানাডায় অবস্থান নিয়ে আমাদের ক্ষোভ আছে। ভয়ংকর অপরাধীরা কানাডার তৎকালীন শিথিল নিয়ম কানুনের সুযোগ নিয়ে ভেতরে ঢুকে গিয়ে আইন আর কানাডার সাংবিধানিক কিছু জটিলতার সুযোগ নিয়ে বহাল তবিয়তে আছে। এখনকার সময়ে সচেতন জনমতের শক্তিশালী অবস্থানে খুনীদের কানাডা প্রবেশ অসম্ভব হতো। বঙ্গবন্ধুর খুনী মহিউদ্দিন আহমেদ যুক্তরাষ্ট্র থেকে কিন্তু কানাডায় প্রবেশ করতে পারেননি জনমতের কারণেই। পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে রায় কার্যকর করা হয়।

ডাঃ মুরাদের কানাডায় প্রবেশ আটকে যাবার পর এর ক্রেডিট নিয়ে সুক্ষ্ম প্রচারণা লক্ষণীয়। ধারণা করা হচ্ছে যাদের করার কথা তাঁরা কানাডা বর্ডার সার্ভিস সিবিএসএ এর সাস্পিসিয়াস একটিভি (সন্দেহজনক কাজকর্ম ) সাইটে নীরবেই কাজটি করে দিয়েছেন।

 

লেখকঃ কলামিস্ট এবং মাইক্রোবিয়াল বায়োটেকনোলজিস্ট। কানাডার একটি বহুজাতিক কর্পোরেটে  ডিরেক্টর পদে কর্মরত। 





সর্বশেষ সংবাদ

দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com

সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

আমাদের ফেসবুক পেজ   https://www.facebook.com/deshdiganta.cbna24 লাইক দিন এবং অভিমত জানান

সংবাদটি শেয়ার করুন