সাহিত্য ও কবিতা

ধা রা বা হি ক গ ল্প – বিড়ালিনী ।।। নাজনিন নিশা

ধা রা বা হি ক গ ল্প – বিড়ালিনী ।।। নাজনিন নিশা
(প্রথম পর্ব )

বিড়ালিনী কোল ঘেষে চুপটি করে বসে আছে পৌষীর পাশে, আর পৌষী ড্রয়িং রুমের বন্ধ কাঁচের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ঝিরঝির করে নি:শব্দে ভেসে পড়া স্নো দেখছে সেই সকাল থেকে। বিড়ালিনীও পৌষীর সঙ্গে বাইরে তাকিয়ে স্নোইং দেখছে। কি আনন্দ দুজনের !! অনেকগুলো বছর ধরেই বিড়ালিনীটা এ বাড়িতে। পৌষী নিজের নামের সঙ্গে মিল করে ওর নাম দিয়েছিলো পুষ্পিতা।  কিন্তু কেন যেন পুষ্পিতা নামে ওকে ডাকা হয়নি কোনদিন। শুধু এনিম্যাল ক্লিনিক এর ফাইলে পুষ্পিতা নামটি দেয়া হয়েছিল। পৌষী সেই প্রথম দিন থেকেই বিড়ালিনী বলে ডেকে আসছে।  আর এ নামটিতে বিড়ালিনীও যেন অভস্ত্য হয়ে উঠেছে। পৌষীর   নিজেকে আজকাল কেন যেন এই বিড়ালিনীর মতই  মনে হতে থাকে।

বিড়ালিনীটা বেশিরভাগ সময়ই লুকিয়ে বেড়ায় ঘরের এই কোনা থেকে ঐ কোনা, আর ঐ কোনা থেকে সেই কোনা। বাঁশি খাবার একদম খেতে চায়না, পৌষীরও বিড়ালিনীর মত বাসি খাবারে অভক্তি সেই ছেলেবেলা থেকেই। বিড়ালিনীর পরিবার পরিজন আত্মীয়স্বজন কে কোথায় আছে সেসবের  কিছুই জানেনা বিড়ালিনী।  সে এ বাড়িতে আশ্রিতা হয়ে এসেছিলো কোন একদিন।

পৌষীও জানেনা কোথায় তার বাবা মা, কোথায় তার আত্মীয়স্বজন । আশ্রিতা হয়ে পৌষীও জীবনের খুব বড় একটা সময় যাদের সঙ্গে কাটিয়েছিলো তাদের সে মামা এবং মামী হিসেবে সম্মোধন করতো। যদিও তারা কেউই রক্তের সম্পর্কে সম্পর্কিত নয় পৌষীর সঙ্গে। কিন্তু এই মামার আশ্রয় এবং মামীর যত্নে পৌষী ভুলে গিয়েছিলো বাবা-মা কে কাছে না পাবার কষ্টগুলো ! কারণ মামা মামীই যেন তাঁর নিজের বাবা মায়ের স্থান দখল করে বসেছিলেন তার পুরো জীবন জুড়ে।

ছেলেবেলা থেকেই পৌষী খুব চটপটে স্বভাবের তবে ওর মনটা ভীষণ নরম। পড়াশোনায় ক্লাসের প্রতিটি বিষয়ে ভালো নম্বর পেলেও গণিতে পৌষী একেবারেই কাঁচা। বরাবরই গণিতে তাকে টেনেটুনে পাশ করতে হত। মামা তাই গণিতের একজন শিক্ষক জোগাড় করে বাড়ি আনলেন। যিনি প্রতি শুক্র এবং শনিবার বিকেল হলেই বাসায় চলে আসেন পৌষীকে গণিত করাতে। কিন্তু প্রথম দিন শিক্ষকের দিকে তাকিয়ে তার পোশাকের ধরণ দেখে পৌষীর তাকে কেনযেন কিছুটা হাবাগোবা ধরনের মনে হলো । তাছাড়া তিনি কথাও বলছেন কেমন অগোছালোভাবে । পৌষী ভাবলো তিনিতো কথাই বলতে পারছেননা ঠিক করে, অংক করাবেন কেমন করে ? অংক শিক্ষকের নাম মোর্শেদ। পৌষীর পড়ার টেবিলের একটা পাশে মোর্শেদ স্যার তার জন্য পেতে রাখা চেয়ারটিতে বসে আছেন। আর অন্যপাশে পৌষী বসে আছে তার নির্দিষ্ট চেয়ার এ। রুমে যথেষ্ট পরিমান লাইট এর আলো রয়েছে, কিন্তু রুমভর্তি মশা গিজগিজ করছে চারিদিকে। মশার কয়েল টেবিলের তলায় জ্বালানো থাকলেও এসব  কয়েলে মশার শরীর সয়ে গেছে, তাই কয়েলের উপরে এরা পাখা মেলে দাঁড়িয়ে ভনভন করতে থাকে। মশাদের যন্ত্রনায় মোর্শেদ স্যার একটু পর পর পা নাড়ছেন আর পৌষীকে গণিতের বই মেলে ধরে বোঝানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন। পৌষী অন্যদিকে মন দেয়া বাদ দিয়ে এবারে স্যারের দিকে তাকিয়ে তার কথায় মনযোগী হচ্ছে।

ঠিক এমন সময় পৌষী লক্ষ্য করলো একটা মশা স্যারের ঠিক নাকের ডগায় বসে চুপচাপ রক্ত চুষেই যাচ্ছে সেই কখন থেকে। কিন্তু স্যারের সেদিকে কোন ভ্রূক্ষেপ নেই, বরং তিনি পৌষীর দিকে মনযোগ দিয়ে তাকে পড়ানোর চেষ্টায় ব্যস্ত আছেন।

বিষয়টা দেখতে ভীষণ হাস্যকর লাগছে । একটা সময় পৌষী খিলখিলিয়ে হেসেই ফেললো। স্যার হয়ে গেলেন হতবিমুড়, তিনি কিছুতেই মিলাতে পারলেননা পৌষী কেন হাসছে। পৌষীকে হাসির কারণ জিজ্ঞেস করার আগে পৌষীই স্যারকে বলে ফেললো তাঁর নাকের ডগায় বসে থাকা মশাটাকে মেরে ফেলতে। স্যারও এতক্ষনে যেন টের পেয়ে তার একটা হাত নাকের উপরে চাপ দিতেই মশাটার শরীর থেকে পুরো রক্ত বের হয়ে স্যারের নাক মশার রক্তে ভেসে গেলো। তার একটু পরেই মোর্শেদ স্যার বিদায় হলেন, আর কোনোদিন  আসলেননা পৌষীকে গণিত করাতে। না আসার কারণও কোনদিন জানা হলোনা ।

কিছুদিন যেতেই মামা পৌষীর জন্য পাভেল নামক দ্বিতীয় আর একজন স্যার নিযুক্ত করলেন, যার পড়াশোনার ব্যাকগ্রাউন্ড অনেক উচ্চমানের। পড়াশোনায় তিনি ভীষণ তুখোড়। জীবনের এতটুকুন বয়সে প্রথম থেকে কোনদিন দ্বিতীয় হননি ।  তিনি দেখতেও ভীষণ ভালো।  কিন্তু কথা বলার সময় প্রতিবার বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছেন তাঁর নিজের দ্বারা। কেননা তিনি একই শব্দ দুবার, তিনবার করে উচ্চারণ করছেন এবং কিছু কিছু শব্দ ভীষণ টেনে টেনে বলছেন, আর এভাবেই কথার লাইনগুলো তিনি শেষ করছেন। অর্থাৎ খুব সহজেই বোঝা যাচ্ছে, তিনি সোজা বাংলায় তোতলা। স্ট্যামারিংজনিত সমস্যায় ভুগছেন। তার কাছে পৌষীর অংক বুঝতে কিছুটা কষ্ট হলেও সে ধর্য্য হারা হচ্ছেনা। তাই স্যারও নিয়মিত আসছেন । যে করেই হোক গণিতে পৌষীকে তিনি ভালো নম্বর পাইয়ে ছাড়বেন এটাই পাভেল স্যারের একমাত্র চাওয়া ।

এবারের মত স্যার এর অক্লান্ত পরিশ্রম এবং পৌষীর নিজের চেষ্টায় সে গণিতে ভালো নম্বর পেতে শুরু করলো ।  মামামামি পৌষীর উপরে কোনোদিন অখুশি না থাকলেও পৌষীর গণিত পাশের খবরে তাদের খুশির মাত্রা যেন চতুর্গুণ হয়ে গেলো । এদিকে পৌষীর জন্য তারা ভালো পাত্রের সন্ধান করতে লাগলেন । ভালো পাত্রে পৌষীকে শপে দেয়া এখন তাদের গুরু দায়িত্বের মধ্যে পড়ে বলে তারা মনে করেন।

সেদিন ছিল শুক্রবার।  এই দিনটি অন্যান্য দিনগুলো থেকে বরাবরই যেন একটু আলাদা ধাঁচের হয়।  কারণ এ দিনে জুম্মার নামাজ আদায় করার জন্য সব পুরুষ মানুষগুলো দলবেঁধে মসজিদের দিকে দৌড়াতে থাকে। আর তাই এই দিনের অন্য কাজগুলো সবাই তাড়াতাড়ি সম্পন্ন করে অথবা পরের দিনের জন্য জমা করে রাখে। পৌষীর প্রিয় মামা সেদিন নামাজ শেষ করে খুব তড়িৎগতিতে পৌষী۔۔ পৌষী۔۔۔ করে ডাকতে ডাকতে পৌষীর ঘরে এসে ঢুকলেন। পৌষী কিছুটা অবাক হয়ে বিছানা থেকে নেমে মামার সামনে এসে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো —

“কি হয়েছে মামা۔۔۔? তূমি এত চিৎকার দিয়ে ডাকছো কেন۔۔? আমিতো তোমার সামনেই আছি ।”

মামা বললেন — “তোর মামী কোথায়۔۔? তাকেতো দেখছিনা, ডেকে নিয়ে আয়, তারপর দুজনকে একসঙ্গে বলি।”
কথাগুলো বলতে বলতে মামা নিজেই পৌষীর মামীকে
“কইগো۔۔۔ শুনছো ?” এটা বলে বলে কয়েক দফা ডেকে ফেললেন।
মামার ডাকে মামি তৎক্ষণাৎ সামনে এসে হাজির। মামা কোনোরকম কোন ভনিতা ছাড়াই বলে ফেললেন–
“আল্লাহ আমার পৌষীর দিকে মুখ তুলে তাকিয়েছেন। পৌষীর জন্য আমি পাত্র পেয়েছি। পাত্র খুব অমায়িক, পৌষীকেও তারা পছন্দ করে নিতে চেয়েছে ।”
মামার কথা থামিয়ে মামী বললেন —
“কবে۔۔? কখন۔۔? কোথায়۔۔? কিভাবে পাত্র পেলে ? আগে খুলে বলবেতো !”
মামা বললেন — “মসজিদে জুম্মার নামাজের মোনাজাত পড়ে বাইরে বের হতেই পাশের গলির ইমতিয়াজ চৌধুরী সাহেব এবং তার ছেলের সঙ্গে মুখোমুখি দেখা হয়ে গেলো। ইমতিয়াজ ভাই আমাকে একটু দূরে ডেকে নিয়ে গেলেন, তারপর বললেন তার ছেলে পৌষীকে স্কুলে আসতে যেতে দেখে সবসময়। পৌষীকে তার ছেলের খুব মনে ধরেছে, তাই ছেলে তার বাবাকে জানিয়েছে পৌষীকে সে বিয়ে করতে চায়। ছেলে আমি নিজে  দেখেছি, খুব ভালো চাকরি করে। গায়ের রং টা একটু শ্যামলা তবে চেহারাটা মন্দ নয়, পৌষীর সঙ্গে খুব মানাবে।”
মামার কথা মামী খুব মনযোগ দিয়ে শুনলেন এবং পৌষীর দিকে তাকাতেই পৌষী বললো — “আমার কোনো আপত্তি নেই তোমরা যা ভালো মনে করবে আমি তাই মেনে নেবো।”
মামা আবেগাপ্লুত হয়ে চোখের জ্বল মুছে পৌষীকে জড়িয়ে ধরলেন, মামীও তাদের সঙ্গে মিলে গেলেন।  মামা  শুরুতে রাজি থাকলেও কিছুদিন যেতেই  কিছুটা আপত্তি জানালেন এই ভেবে۔۔۔ যেখানে পৌষী মাত্র দশম শ্রেণীর ছাত্রী সেখানে পাত্র বি এ পাশ দিয়ে চাকরিতে ঢুকেছে। তাদের দুজনের বয়সের যথেষ্ট ফারাক রয়েছে ! কিন্তু মামী মামাকে বুঝিয়ে বললেন মেয়েমানুষের বড় হতে সময় লাগেনা। তাছাড়া ভালো পাত্র সবসময় মিলবেনা। বাবা মা হারা সন্তান, আমরা মরে গেলে ওকে দেখার কেউ থাকবেনা। এসব শুনে মামার মন আরো একবার গলে গেলো।
একমাস পর মামার সাধ্যমত বিয়ের সানাই বাজিয়ে, ধুমধাম করে লোকজন খাইয়ে পৌষীর বিয়ে হয়ে গেলো ইমতিয়াজ চৌধুরীর ছেলে- চাকুরী করা বি এ পাস ছেলেটির সঙ্গে। এখন এই ছেলেটি পৌষীর বর। যার নাম আরাফ, আরাফ চৌধুরী।

শশুর বাড়িতে প্রবেশ করেই পৌষী গৃহবধূ সেজে সংসার নামক মায়ার জ্বালে ধীরে ধীরে আটকে যেতে লাগলো তার বর আরাফকে নিয়ে। যথাযথভাবে বাঙালির উত্তরীয় প্রথায় সংসার শুরুর দিন থেকে বর বাসায় আসবার আগেই ঘরের সমস্ত কাজগুলো শেষ করে তার অপেক্ষায় খাবার নিয়ে বসে থাকে সে প্রতিদিন। কিন্তু মনে মনে অপেক্ষা করে তার বর ঘরে ঢুকে জানতে চাইবে সারাটাদিন পৌষীর কেমন কাটল ?  কোন অসুবিধে হয়নিতো ঘরের কাজ করতে গিয়ে ? নিজে খাবার আগে একবার জানতে চাইবে পৌষী খেয়েছে কিনা কিংবা তার আঙুলের ডগা দিয়ে ভাতের একটি লোকমা তুলে দিবে পৌষীর মুখে ।
পৌষীর এসব ছোট ছোট আশা কিংবা প্রত্যাশাগুলো নিতান্তই অবান্তর হতে হতে নিরশ হতে লাগলো যেন। এদিকে মামা-মামী চাইলেন পৌষী স্কুল টা পাশ করুক। অবশ্য পৌষীর নিজের ইচ্ছেটাও তাই। কিছুদিন পর সবার ইচ্ছেটা পৌষী তার বরকে জানালো। প্রথমদিকে আরাফ কিছুটা দ্বিমত পোষণ۔۔ করলেও মামা মামীর অনুরোধ ফেলতে না পেরে রাজি হয়ে গেলো। আর সেই সুবাদে পরীক্ষার ক’দিন আগ থেকে পাভেল স্যার নিয়ম করে বাসায় আসতে লাগলেন পৌষীকে গণিত করাতে ।

এদিকে পাভেল স্যার পৌষীকে পড়াতে বাসায় আসলেই প্রতিদিন কোননা কোন ছুতোয় আরাফ  পৌষীর সঙ্গে কিছুটা খটিমটি করতে শুরু করে দিলো। পৌষী শুরুতে এ বিষয়টা নিয়ে কষ্ট কিংবা বিরক্ত হলেও শেষের দিকে আরাফের এসব বিষয়গুলো গায়ে না নিয়ে পড়াশোনায় মনযোগী হতে থাকে। পাশাপাশি সংসারের হালটাও সুনিপুন ভাবে সামলে যাবার চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে।
একদিন হঠাৎ মনে হল বিয়ের পর এতগুলো দিন এবং মাস কেটে গেলো অথচ পৌষী এ অব্দি কোথাও যায়নি তার বরকে নিয়ে। গত কয়েকটা দিন পৌষী তার বরকে একটু পীড়া দিতে লাগলো তাকে নিয়ে বাইরে কোথাও ঘুরে আসার জন্য। অবশেষে বর তার রাজি হলো কিন্তু পৌষী তার মনের মত করে সেজেগুজে বরের সঙ্গে সেদিন বাইরে যেতে পারেনি। কিছুটা গোছালো এবং কিছুটা অগোছালো ভাবেই পৌষী বেরিয়ে পড়ে।
রিকশায় উঠার সময় পায়ের দিকে নজর পড়তেই দেখা গেলো পৌষী ঘরে পড়ার অনেক দিনের পুরোনো নিচু হিলটা পড়েই রিক্সায় উঠছে। কিছুদূর যেতেই রাস্তার পাশে চটপটির দোকান চোখে পড়লো, তাজা চটপটি মশলার ঘ্রানে রিকশা এবং গাড়ি থামিয়ে সবাই রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে, কেউবা বসে চটপটি এবং ফুচকার থালা হাতে। এ দৃশ্য দেখে খাবার লোভ সামলানো ভারী মুশকিল! পৌষী রিকশাওয়ালাকে রিকশাটা থামাতে বললো। রিকশা থেকে নেমে চটপটিওয়ালার কাছে অর্ডার করতেই পৌষীর চোখে চোখ পড়ে গেলো পাশের বেঞ্চিতে বসে থাকা তার অংকের শিক্ষক পাভেল স্যারের দিকে, যিনি তার বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে বসে বসে ফুচকা খাচ্ছেন। পৌষী তাকে হাসিমুখে সালাম দিতেই ওর বর মুখ ঘুরে তাকালো। পাভেল আরাফকে সালাম দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে নিজের জায়গাটা তাকে দেখিয়ে বললো
ব۔۔۔সুন ভাই।
আরাফ “ঠিক আছে۔۔۔”, একথাটা বলেই অন্যপাশটায় চলে গেলো বসার জন্য।
পৌষীও তার পেছন পেছন এসে বসলো। ততক্ষনে চটপটিওয়ালার চটপটিও রেডি। কিন্তু পৌষীর বর  চটপটি না খেয়েই লোকটির পয়সা চুকিয়ে উঠে দাঁড়ালো এবং পৌষীকে বললো চল চলে যাই।  কোন কথা না বাড়িয়ে বরের পেছন পেছন পৌষী গিয়ে রিকশায় চেপে বসলো। যাবার সময় পেছন ফিরে একবার ঘুরে তাকালো পাভেল স্যার তাকিয়ে আছেন বলে। রিকশায় কিছুদূর গিয়ে হঠাৎ আরাফ পৌষীকে বলে উঠলো—

“তোমার পাভেল স্যার কে তূমি চটপটির দোকানে থাকতে বলেছিলে ?”
আরাফের এমন অপ্রাসঙ্গিক কথায় পৌষী ভীষণ আহত হলো,  রাগতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিলো। আরো কিছুদূর এগিয়ে আরাফ  রিকশাওয়ালাকে রিকশা থামাতে বললো এবং পৌষীকে নিয়ে কোন একটা রেস্তোরাঁয় ঢুকে পড়লো। কিছুক্ষন পর খাবার এলো। পৌষী দু একটি কথা বললেও আরাফ  কোন কথা না বলেই ভীষণ গম্ভীর মুখ করে খাবার খেলো। পৌষী খুব একটা খেতে পারলোনা। অসমাপ্ত খাবার রেখেই সেদিন রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে এলো বরের সঙ্গে।
সময় গড়িয়ে পৌষী এস এস সি পরীক্ষাটা দিয়ে ফেললো। তিন মাস পরেই রেজাল্ট বেরুনোর অপেক্ষায় দিন গুনতে লাগলো। পাভেল স্যার এখন আর পড়াতে আসেননা। তবে পৌষীর রেজাল্ট বেরোনোর এক সপ্তাহ পর একদিন সন্ধ্যা বেলায় কলিংবেলের আওয়াজে আরাফ দরজা খুলে দেখে পাভেল স্যার বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন। আরাফকে তিনি সালাম দিলেন। এবং বললেন পৌষীর মামামামীর কাছে গিয়েছিলেন তিনি রেজাল্ট জানতে, কিন্তু তারা বাসায় নেই তাই তিনি সরাসরি  এ বাসায় চলে এলেন পৌষীর কাছে ওর রেজাল্ট শুনতে। তবে পাভেল স্যারের তোতলামোর কারণে তিনি কথাগুলো বলতে গিয়ে ভীষন বাধাগ্রস্থ হলেন, অনেক টাইম নিয়ে কথাগুলো শেষ করলেন। ততক্ষনে পৌষীও পেছনে এসে দাঁড়ালো। আরাফ সামনে থেকে সরে গিয়ে পাভেলকে ভেতরে ঢুকতে দিলো। পাভেল স্যার ভেতরে ঢুকে সোফায় বসতে বসতে ভীষণ কৌতুহলী হয়ে পৌষীর দিকে তাকিয়ে ওর রেজাল্ট জানতে চাইলো। পৌষী বললো স্যার অমি খুব ভালো করেছি, A+ পেয়েছি। তবে মার্কস এখনো হাতে আসেনি। পাভেল স্যার খুব খুশি মনে আর দেরি না করে উঠে যেতে চাইলো, পৌষী চা সাধলো স্যার কে। স্যার আর বসলেননা। তিনি চলে যাবার পর পৌষী দরজা লাগিয়ে আরাফকে চায়ের কথা জিজ্ঞেস করলো ও চা চায় কিনা।  আরাফ কোন কথার জবাব দিলোনা পৌষীকে।
পৌষীর খুব ইচ্ছে কলেজে ভর্তি হবার, কিন্তু আরাফকে বলার সাহস সে পাচ্ছেনা। মামা-মামীকে দিয়ে রাজি করবে ভাবলেও এ মুহূর্তে আরাফের যেরকম মেজাজ সে দেখতে পাচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে মামা-মামীকেও হয়তো  কঠিন কিছু শুনিয়ে দিতে পারে। তাই আপাতত আর এ বিষয় নিয়ে কথা না বলাই ভালো মনে করলো পৌষী।

সময়ের চাকায় দিন ঘুরে রাত, রাত পেরিয়ে নতুন আরেকটি দিন, সপ্তাহ, মাস এভাবে কাটতে কাটতে পৌষীর বিয়ের তারিখটি যেন ঠিক মাথার উপর দাঁড়িয়ে আছে। আর মাত্র ক’টা দিন কাটলেই বিয়ের তারিখটা মাথার উপর থেকে ঠিক নিচে এসে দাঁড়াবে। অবশ্য এই এক বছরের ভেতরে পৌষী আরাফকে রাজি করে কলেজে ভর্তি হয়ে ক্লাস করে যাচ্ছিলো। সেই সুবাদে কলেজে কিছু নতুন বন্ধু তৈরী হয় পৌষীর। তাই বিবাহ বার্ষিকীর দিনটিকে নিয়ে পৌষীর অনেক কিছু করার ইচ্ছে থাকলেও সেসবের কিছুই প্রকাশ না করে এর ঠিক দুদিন আগে আরাফকে বললো সে এ দিনটিকে স্বরণীয় করে রাখার জন্য মামা-মামীসহ কাছের কয়েকজন বন্ধুকে কোন একটি রেস্টুরেন্ট এ খাওয়াতে চায়। আরাফ এতে খুব একটা আপত্তি টানলোনা।

তারিখমতো মামা-মামীসহ পৌষীর সব বন্ধুরা চলে এলো নির্দিষ্ট রেস্টুরেন্ট এর ঠিকানায়। যদিও ঠিকানাটা পৌষীর আগে জানা ছিলোনা। বাসা থেকে বের হবার ঠিক আগ মুহূর্তে আরাফ পৌষীকে এড্রেস টা দিয়েছিলো এবং পৌষীও মামা-মামি এবং তার সেই দু-তিনজন বন্ধুকে জানিয়ে দেয়। একঘন্টার মধ্যেই পৌষী আর আরাফ পৌঁছে গেলো সেখানে। গিয়ে দেখলো তার মামা-মামি রেস্টুরেন্ট এর সামনেই দাঁড়িয়ে, বাকি তিন বান্ধবী তারাও মাত্র এসে পৌঁছলো। সবাই মিলে ভেতরে ঢুকে পড়লো। বাইরের কাঠফাটা রোদ থেকে রেস্টুরেন্ট এর ভেতরে এসে শরীরে এয়ার কন্ডিশনের নরম, কোমল আর শীত শীত আবহাওয়া অনুভূত হতে লাগলো সবার। যেন সবাই নরক থেকে স্বর্গে প্রবেশ করেছে। চারদিকে তাকিয়ে দেখা গেলো প্রতিটি টেবিল এবং তার সঙ্গের চেয়ারগুলো সাদা কাপড়ে আবৃত। পুরো রেস্টুরেন্ট জুড়ে মৃদু নরম আলোর ঝলকানি। যদিও দিনের বেলায় এমন আলো না হলেও চলে । কিন্তু রেস্তোরার ভেতরটা এ আলোতে প্রতিটি টেবিলকে অনেকবেশি ঝলমলে করে তুলেছে। এখানে এসে এরকম আলোর নিচে গিয়ে বসার ইচ্ছে যে কারোই জাগতে পারে। টেবিলের উপর ফুলদানিগুলোতে তাজা ফুলের বাড়তি সমাহার। ভীষণ অন্যরকম একটি পরিবেশ! এরকম ফকফকে সাজানো গোছানো একটা পরিবেশে এলে হাজারো কষ্ট ভুলে মানুষের মন এমনিতেই নরম হয়ে যায়।

আরাফ কোনার দিকের একটা টেবিল দেখে পৌষীকে ইশারা করতেই পৌষী সবাইকে নিয়ে ঐ টেবিলটায় বসলো। পছন্দ অনুযায়ী খাবারের অর্ডার দেয়া হলো। সবাই খাবারের অপেক্ষায় । মাঝারি আকৃতির এ রেস্টুরেন্ট এ অনেক মানুষের আনাগোনা। কেউ ওদেরই মত খাবারের অপেক্ষায়, কেউ খাবার শেষ করে বিল চুকিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে। আবার অনেকেই খাবার খেতে  ভেতরে ঢুকছে, ঠিক এমন সময় ভেতরে প্রবেশ করা দুজন আগুন্তকের দিকে একই সঙ্গে চোখ পড়ে গেলো আরাফ এবং পৌষীর। আগুন্তকের একজন পাভেল স্যার এবং অন্যজন হয়তো তার কোন বন্ধু কিংবা পরিচিত। পৌষী এবং আরাফের চোখে চোখ পড়তেই তিনি এদিকটায় এগিয়ে এসে আরাফ এবং মামামামীসহ সবাইকে সালাম দিতে গিয়ে মুখে কিছুটা বাঁধলেও দু’বারে সালাম দেয়া শেষ করে দূরে একটি টেবিলে গিয়ে বসলেন।
জীবনের কিছু কিছু ঘটনা একটি আরেকটির সঙ্গে অনেকসময় মিলে গেলেও ঘটনাগুলোর একটি  থেকে আরেকটি থাকে সম্পূর্ণই অপ্রত্যাশিত কিংবা কাকতালীয়। চটপটি খাওয়া কিংবা  আজকের এ দিনে পাভেল স্যার এর রেস্টুরেন্ট এ আসার বিষয়টিও ঠিক এরকমই ছিল।

একটু পরেই আরাফ পৌষীকে বললো তোমরা বস, খাবারের বিল পরিশোধ করা হয়েছে, অমি কিছুক্ষনের মধ্যেই ফিরে আসছি। আজকের মত আরাফ এখানেই বিদায় নিলো এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই, সেটা আর কেউ বুঝতে না পারলেও পৌষীর বুঝে নিতে কোন সমস্যা হয়নি। এই এক বছরের সংসার জীবনে পৌষী আরো অনেক কিছুই বুঝে ফেলেছে আরাফের।

বাসায় ফিরে আজকের রাতটিতে পৌষী আরাফের সঙ্গে এ বিষয় নিয়ে কোন কথাই বললোনা । দু তিনদিন পর পৌষী আরাফের কাছে জানতে চাইলো– কেন আরাফ রেস্টুরেন্ট এ সেদিন এমন সিনক্রিয়েট করে চলে এলো ?

আরাফ পৌষীকে বললো– “তূমি পাভেল স্যারকে সেদিন ঐ রেস্টুরেন্ট এ যাবার কথা আগেই বলে রেখেছিলো, তা না হলে এত রেস্টুরেন্ট থাকতে তিনি বেছে বেছে ওখানেই কেন গেলেন ?”

আরাফ এমনটিই বলবে, সেটা পৌষী আগেই জানতো, তাই বিষয়টি নিয়ে কোন উচ্চবাক্য না করে চুপ হয়ে নিজেকে সেদিনের মত সামলে নিলো ।

সংসারের সময় দীর্ঘ হতে হতে পৌষীকে নিয়ে আরাফের সন্দেহের মাত্রাও যেন দীর্ঘ থেকে আরো দীর্ঘ হতে শুরু করে।

এরই ভেতরে পাভেল স্যার পি এইচ ডি করতে আমেরিকায় চলে গেছেন, এবং সেখানে তার স্ট্যামারিং বা তোতলামো রোগটিরও তিনি চিকিৎসা করাবেন। যাবার আগে পৌষির মামা মামীর কাছে বিদায় নিতে এসে তিনি ঠিক এমনটিই বলে গেলেন।

কলেজে পড়তে এসে পৌষী আর অংকে ঠিক সেই স্কুলের মত আটকে যাচ্ছেনা । পাভেল স্যারের কারণেই পৌষী এস এস সি পরীক্ষায় অংকে পাশ করে যেতে পেরেছে। শুধু এই একটি বিষয় ভাবলে পৌষীর কৃতজ্ঞতা অনেক বেড়ে যায় স্যার এর প্রতি ।

সংসার মানে জীবনের সমস্ত চাওয়া, আবেগ, উচ্ছাস, ভালোলাগা, ভালোবাসাকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকা। সংসার মানে ঘরের বারান্দায় রাখা বেলি ফুলের মিষ্টি সুগন্ধ! যার সৌরভে মৌ মৌ করবে ঘরের প্রতিটি কোনা। আর এর পাশাপাশি সংসার মানে কখনো তেল ফুরিয়ে যাওয়া, কখনো নুন ফুরিয়ে যাওয়া কিংবা রাতে ঘুমানোর আগে  মশারি কে টানবে অথবা ঘুমানোর আগে  বেডরুমের বাতিটা কে নিভাবে, এসব  ছোটখাট বিষয়গুলো নিয়ে একে অন্যের সাথে খটিমটিতে লেগে থাকা। আবার পরক্ষনেই রাগ অভিমান ভুলে একজন আরেকজনকে নিবিড় আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরা। পৌষী তার বিয়ের আগে সংসারটাকে ঠিক এমন করেই ভাবতে শিখেছিল। কিন্তু বিয়ের পর এসব ধারণা পাল্টে সম্পূর্ণ নতুন ধারণা তৈরী হল যার সঙ্গে পৌষীর স্বপ্নে দেখা ধারণাগুলোর কোনরকম মিল নেই।
চলবে…

নাজনিন নিশা- সংগীত শিল্পী, উপস্থাপিকা ও লেখক। মন্ট্রিয়ল।



এসএস/সিএ
সংবাদটি শেয়ার করুন