ফিচার্ড সাহিত্য ও কবিতা

ছোট গল্প ।। দেবোত্তর  ||| কৃষ্ণা গুহ রায়

ছোট গল্প ।। দেবোত্তর  ||| কৃষ্ণা গুহ রায়

সেই কোন ছেলে বেলায়  চৌধুরী বাড়িতে  বউ হয়ে এসেছিলেন  প্রভাবতী৷  ঘোষ বাড়ির জন্মাষ্টমীর পূজায়  প্রভাবতীকে পছন্দ করেছিলেন, প্রভাবতীর  শ্বশুর মশাই নৃপেন্দ্র নারায়ন৷  তার বড় ছেলে  দেব নারায়ন এর জন্য ৷ নৃপেন্দ্র নারায়ণের আরও তিন ছেলে , ব্রজ নারায়ণ, গোপি নারায়ন আর হরি নারায়ণ৷ সুন্দরী  প্রভাবতীর বাপের বাড়ির অবস্থা তেমন ভালো ছিল না ৷  প্রভাবতীর বাবা  গৌরাঙ্গ দাসের  কীর্তন গানের  দল ছিল৷  তিনি  সে সময়  ওই গান গেয়েই  যেটুকু রোজগার করতেন৷  আর কিছু জমিজমা ছিল,  তাতে  সারা বছরের  খাবার জন্য  চালের ব্যবস্থা হয়ে যেত ৷ প্রভাবতী বড় সন্তান,  তারপর  দুই ছোট ছেলে৷  কাজেই  নৃপেন্দ্র বাবু  যখন   নিজেই সাজিয়ে গুজিয়ে  প্রভাবতীকে  তার ঘরে  বড় ছেলের  বউ করে আনার  প্রস্তাব দিলেন, গৌরাঙ্গ বাবু  হাতে যেন চাঁদ পেলেন৷ শুধু একটাই শর্ত  মেয়ে কোনওদিন বাপের বাড়ি যেতে পারবে না ৷ যদি কোনওদিন  গৌরাঙ্গ বাবুদের  মেয়েকে দেখবার  ইচ্ছে জাগে , তাহলে তারা এসে নৃপেন্দ্র নারায়ণ বাবুর বাড়িতে  মেয়েকে দেখে যাবেন৷  মেয়ের সুখের কথা ভেবে গৌরাঙ্গ বাবুরা  তা মেনেও নিলেন ৷ ধুমধাম করে  বিয়ে হল প্রভাবতীর ৷

প্রভাবতীর বিয়ের কয়েক বছরের মধ্যে অন্য তিন ভাইয়েরও বিয়ে দেওয়া হল৷ এর মধ্যে ব্রজ নারায়ণের জীবনটাই বেসুরো হয়ে গেল৷

প্রভাবতীর মেজজা নলিনী বালা অর্থাৎ ব্রজ নারায়ণের স্ত্রীও খুব গরিব ঘরের মেয়ে ছিল৷ সেও পনেরো বছর বয়সে এই বাড়িতে বউ হয়ে এল৷ তার ক্ষেত্রেও বাপের বাড়ি যাওয়া বারণ ছিল৷ প্রভাবতীর সঙ্গে নলিনী বালার খুব ভাবও ছিল৷ কিন্তু নলিনী বালার জীবনটা ছিল বঞ্চনায় ভরা৷ বিয়ের পর কোথা দিয়ে কয়েকটা বছর কেটে গেল নলিনীবালা জানতেই পারল না৷ স্বামীর সোহাগ শরীরের উত্তাপের পর নারীত্বের অনুভূতি৷ বাড়ির পুরনো দাসী বলেছিল, এবার তুমি মা হবে৷

রাতের বেলায় নলিনীবালাকে শরীরের বাঁধনে বেঁধে ফেলে ব্রজ নারায়ণ বলেছিল, এবার আমি সন্তান চাই৷ কিন্তু র্দুভাগ্য নলিনীবালার৷ তার কোল আলো করে কেউ এল না৷ মানসিক এক যন্ত্রণার মধ্যে নলিনীবালা অনুভব করতে পারত স্বামী তো বটেই, সংসারের অন্যান্যরাও তাকে বাঁজা বলে এড়িয়ে চলে৷ একমাত্র প্রভাবতী দিদির মতন সান্তনা দেয়৷ এর মধ্যেই ব্রজনারায়ণের আবার বিয়ে দেওয়া হল৷ নলিনীবালার স্থান হল ঠাকুর দালানের পাশের ঘরে৷ সারা দিন বাড়ির প্রতিষ্ঠিত বগলা মায়ের সেবা করে নলিনী বালা৷ ব্রজনারায়ণের সংসারের টুকরো টাকরা খবরও তার কানে আসত৷ মাস, বছর পেরিয়ে যায় নতুন মানুষের খবর আর আসে না৷ একদিন শেষ রাতে খবর আসে ব্রজ নারায়ণের নতুন বউ ছাদের ঘরে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছে৷ তারপরই ব্রজ নারায়ণ পাল্টে গেল৷ মদের নেশায় সব সময়ে চুড় হয়ে পরে থাকত৷ এভাবেই কয়েকটা বছর কেটে গেল৷ এর মধ্যে ব্রজ নারায়ণ কঠিন অসুখে পরলেন৷ ডাক্তার জবাব দিয়ে গেলেন৷ রোগ শয্যায় ব্রজনারায়ণ নলিনীবালার জন্য আকুল হলেন৷ মেয়েদের মন, নলিনীবালাও আর স্থির থাকতে পারলেন না৷ ছুটে গেলেন স্বামীর রোগ শয্যার পাশে৷ নলিনীবালা এতদিনের সব বঞ্চণা ভুলে ব্রজ নারায়ণের সেবা যত্ন করলেন৷ শেষ মুহূর্তে ব্রজ নারায়ণ নলিনীবালার হাতটা ধরে বাড়ির সকলের সামনে বলে গেলেন, সন্তান না হবার জন্য তোমার কোনও দোষ নেই, সব দোষ আমার৷

নলিনীবালার সেদিন মনে হয়েছিল তার যেন শাপ মুক্তি হল৷ ব্রজনারায়ণের মৃত্যুর বছর না ঘুরতেই ম্যালেরিয়া হয়ে নলিনীবালাও ইহ জগতের মায়া ত্যাগ করলেন৷

তখনও প্রভাবতীর শ্বশুর,শাশুরী বেঁচেছিলেন৷ দাস, দাসী, ঠাকুর, চাকর, প্রভাবতীর অন্য দুই দেওর,জা, তাদের ছেলে, মেয়ে নিয়ে বিশাল যৌথ পরিবার ৷ প্রভাবতীরও দুই ছেলে, এক মেয়ে৷ সময় এগিয়ে চলে৷ প্রভাবতীর শ্বশুর, শাশুরীও গত হলেন৷  দেব নারায়ণের অন্য ভাইয়েরা আর এখানে থাকতে চাইলেন না৷   ভায়েদের চাহিদা মতন অর্থ দিয়ে দিলেন দেব নারায়ণ৷ তারা  তাদের অংশ দেব নারায়ণকে লিখে দিয়ে ছেলে মেয়েদের কাছে কলকাতায় চলে গেলেন৷ দেব নারায়ণ আর প্রভাবতীর সন্তানেরাও সব কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত৷

কুড়ি বিঘা জমির উপর প্রাসাদের মতন বাড়ি, বাগান, দিঘি আর পুরনো কর্মচারীদের নিয়ে থেকে গেলেন ওরা৷ হঠাৎ একদিন তুমুল হৈ চৈ৷ বাগানের মালি মাধু কাকার ছেলে রতন দিঘিতে নেমে এক ডুব দিতেই হাতে একটা শক্ত কিছু ঠেকলো৷ রতন আবার ডুব দিয়ে ওই জায়গায় হাত দিয়ে ওই শক্ত জিনিসটাকে দিঘির জল থেকে তুলে আনলো৷ তারপর দেখল সেটা শ্রীকৃষ্ণর মুর্তি৷  ওর চেচামেতিতে বাড়ির সবাই দীঘির পারে চলে এল৷ দেব নারায়ণ হাতে মুর্তিটিকে নিয়ে ভালো করে পরীক্ষা করে দেখলেন অষ্টধাতুর কৃষ্ণমূর্তি৷ সেদিন রাত্রেই প্রভাবতী স্বপ্ন দেখলেন স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ মন্দির প্রতিষ্ঠা করার জন্য বলছেন৷ তারপর সাদা পাথরের বিশাল মন্দির তৈরি করে সেখানে অষ্টধাতুর মুর্তিটিকে প্রতিষ্ঠিত করা হলো৷

এই ঘটনার দুই বছর পরে দেব নারায়ণ  হঠাৎ করেই হার্ট এটার্কে চলে গেলেন৷ শ্রাদ্ধ শান্তি মিটলে পরে ছেলে, মেয়েরা বলল, মা তোমার অংশটুকু রেখে আমাদের অংশটুকু বিক্রি করে দেবো৷ প্রভাবতী কোনও উত্তর দিলেন না৷ সেদিন সারাদিন মন্দিরে শ্রীকৃষ্ণর কাছে বসে রইলেন৷ মনে মনে ভগবানকে বললেন, মানুষটা কষ্ট করে সারা জীবন তার বাবার ভিটে আগলে পরে রইল৷ এখন এই ভিটে ওরা ভাগ করে বিক্রি করতে চায়৷ সবই তো তোমার তুমি যা চাইবে তাই হবে৷

পরদিন  দেব নারায়ণের ঘরের লোহার সিন্দুক খুলে  রেজিস্ট্রি করা যে দলিলটা পাওয়া গেল, তাতে স্পষ্ট করে লেখা, আমি গিরিধারীর মন্দির তৈরি করার পর সজ্ঞানে আমার জমিসহ বাড়িটি দেবোত্তর সম্পত্তি করে দিলাম৷ আমার বংশধররা এখানে সেবায়েত হিসেবে থাকতে পারবে৷

ছেলে মেয়েদের মুখগুলো থমথম করতে লাগল৷ ওরা কিছুক্ষণের মধ্যেই তৈরি হয়ে কলকাতায় রওনা দিল৷ প্রভাবতী  দলিলটা নিয়ে যথাস্থানে রেখে দিয়ে গিরিধারীর পায়ে লুটিয়ে পরলেন৷

কৃষ্ণা গুহ রায় একজন সাহিত্যকর্মী৷ নিবাস -পশ্চিমবঙ্গ, ভারত ৷

 





সর্বশেষ সংবাদ

দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com

সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

আমাদের ফেসবুক পেজ   https://www.facebook.com/deshdiganta.cbna24 লাইক দিন এবং অভিমত জানান

 

সংবাদটি শেয়ার করুন