ফিচার্ড সাহিত্য ও কবিতা

ধা রা বা হি ক গ ল্প – বিড়ালিনী ।।। নাজনিন নিশা

ধা রা বা হি ক গ ল্প – বিড়ালিনী ।।। নাজনিন নিশা

দ্বিতীয় পর্ব : পূর্ব প্রকাশের পর…

পৌষীর এখন শুধু মনে হয় সংসার মানে তিক্ততা, সংসার মানে সন্দেহের দেয়াল।

পৌষী তার স্বপ্নে দেখা সংসার হতে নিজেকে বিচ্যুত করতে চায়না। আর তাই কলেজ শেষ করে সেই আগের মত প্রতিদিন বাসায় ফিরে আরাফের জন্য এটাসেটা রান্না করে টেবিল সাজিয়ে অপেক্ষায় থাকে। এদিকে সন্ধ্যে হতেই আরাফও অফিস থেকে বাসায় ফিরে। কিন্তু ওর মুখে কোনদিন হাসি দেখেনি পৌষী।

সে ভাবে হয়তো আরাফ ক্লান্ত। পৌষীর প্রতিটি কথায় প্রতিটি কাজেই আরাফ কেন যেন বিরক্ত হয়ে যায়। উচ্চস্বরে জবাব দেয়।
আজকাল পৌষীর এসব একদম সয়ে গেছে । শুনেও না শোনার ভান করে থাকে, দেখেও না দেখার ভান করে থাকে।
কলেজ শেষ করে পৌষী ইউভার্সিটির গন্ডিতে পা রাখলো। গত এক বছর ধরেই সে ইউনিভার্সিটিতে যাচ্ছে। গণিতে ফেল করা পৌষী আজ গণিত নিয়েই অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে পড়াশোনা করছে। ৭’টা ৫৫ মিনিটে প্রতিদিন ক্লাস শুরু হয় । আজও ঠিক তাই। বাসা থেকে বেরিয়ে রিকশা খুঁজে ইউনিভার্সিটিতে পৌঁছুতে পৌঁছুতে ৫ থেকে ৭ মিনিট দেরি হয়ে যায় প্রায়শই। আজও ঠিক ৫ মিনিট দেরি হলো। তড়িঘড়ি করে ক্লাসে ঢুকতে ঢুকতে ক্লাস প্রফেসরকে সালাম দিতে গিয়ে পৌষী ভীষণ চমকে গেলো। কৌতূহল ভেতরে রেখেই  শুধু বললো পাভেল স্যার আপনি এখানে?  পাভেল স্যারও পৌষীকে দেখে কিছুটা চমকে গেলেন !  নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন তূমি এই ইউনিভার্সিটি পড়ছো? আমি ভীষণ আনন্দিত যে আমার একজন স্কুল ছাত্রীকে অমি ইউনিভার্সিটির ক্লাসেও পেয়ে গেলাম। ক্লাসের সবাইকে পাভেল স্যার খুলে বললেন পৌষীর স্কুল জীবনে তিনি তাকে অঙ্ক করিয়েছিলেন। একটু পরই পৌষী পাভেল স্যারের মুখে জানতে পারলো তিনি আমেরিকা থেকে ম্যাথ এর উপরে পি এইচ ডি করে এসেছেন। এই ইউনিভার্সিটিতে তিনি আজই প্রথম ম্যাথ টিচার হিসেবে ক্লাস নিতে শুরু করেছেন। পুরো ক্লাস জুড়েই সমস্ত ছাত্রছাত্রীরা পাভেল স্যারকে ভীষণ এটেনশন দিলো। স্যার এর পড়ানোর ধাঁচেই বোঝা গেলো তিনি খুব ব্রিলিয়ান্ট! অতিরিক্ত মেধা সম্পন্ন একজন শিক্ষক! পৌষীরও একটানা মনযোগ স্যার এর দিকে। কিন্তু মনযোগ দিতে দিতে পৌষী লক্ষ্য করলো অন্য আরেকটি বিষয়। যে বিষয়টি সে পূর্বে দেখেছে স্যার এর ভেতরে তার বিন্দুমাত্র এখন নেই। স্যার অনর্গল ম্যাথ বুঝিয়ে যাচ্ছেন ক্লাসের সবাইকে। একটি কথাও তার আটকাচ্ছেনা কোথাও কিংবা তিনি টেনে টেনে কোন কথাই বলছেননা। পৌষী বুঝতে পারলো স্যার সেই পূর্বের তোতলামো কিংবা স্ট্যামারিংজনিত সমস্যায় আর ভুগছেননা। স্যার কে অবশ্য এ বিষয়ে পৌষী একটি কথাও জিজ্ঞেস করেনি । পৌষীর সেটা জিজ্ঞেস করবার কথাও নয়।

আজ ভীষণ চিন্তিত মন নিয়েই বাসায় ফিরতে ফিরতে সে ভাবলো আরাফ যদি কোনভাবে জানতে পারে পাভেল স্যার এই ইউনিভার্সিটির  প্রফেসর তাহলে হয়তো এ যাত্রা আর বেঁচে যাওয়া কিছুতেই সম্ভব নয়। আপাতদৃষ্টিতে এ বিষয়টি খুবই সাধারণ একটি বিষয় হলেও আরাফের চোখে পাভেল স্যার এবং পৌষীর বিষয়টি ভীষণ সন্দেহজনক সেই বিয়ের পর থেকেই ।
পৌষী একবার ভাবলো ইউনিভার্সিটি বদলে অন্য নতুন কোনটিতে ভর্তি হবে। কিন্তু আরতো মাত্র একটি বছর অনার্স শেষ হতে। দেখতে দেখতে বছরটি শেষ হয়ে যাবে এই ভেবে পৌষী এই ইউনিভার্সিটিতেই রয়ে গেলো।

সপ্তাহের প্রতি শুক্রবার আরাফকে বাজারে যেতে হয়। আজও শুক্রবার। পৌষী ঘরের কিছু প্রয়োজনীয় বাজারের ফর্দ ধরিয়ে দিলো আরাফকে। সকাল ১০ টা নাগাদ চা নাশতা শেষ করেই আরাফ বাজারের দিকে চলে গেলো। বাজার শেষ করে রিক্সায় উঠতে যাবে এমন সময় আরাফ দেখতে পেলো তার রিকশার পেছনেই এসে আরেকটি রিকশা থামলো এবং সে রিকশা থেকে পাভেল স্যার নামলেন। অনেকদিন পর দেখতে পেয়ে একটু অন্যরকম মনে হলেও আরাফ ঠিকই চিনতে পেরেছিলো পাভেল স্যারকে।আরাফের মুখোমুখি হতেই তিনি আরাফের দিকে তাকিয়ে বললেন —

“আস্সালামুআলাইকুম, কেমন আছেন আরাফ?”

“ওয়ালাইকুমআসসালাম, আপনি ? কোথা থেকে এতদিন পর ? কেমন আছেন ?”

“কেন পৌষী আপনাকে বলেনি ? আমিতো ঐ ইউনিভার্সিটিতে পড়াই এখন, এক সপ্তাহ হল শুরু করেছি।”

“ও আচ্ছা, জ্বি ভালো থাকবেন, আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে, আসি আমি আজ।” এ কথা বলেই আরাফ রিকশা ডেকে উঠে গেলো।

বাসায় ফিরে বাজারগুলো হাত থেকে নামিয়ে আরাফ পৌষীকে ডেকে বললো এগুলো গুছিয়ে রাখতে। পরক্ষনেই বললো তূমি প্রতিদিন ইউনিভার্সিটিতে যাচ্ছ নাকি তোমার পাভেল স্যার এর সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছ?

আরাফের এরকম আক্রমণাত্মক কথায় পৌষী আরাফকে রুক্ষ ভাষায় কিছু বলতে চেয়েছিলো, কিন্তু তা না করে শুধু আরাফের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে শান্ত নরম স্বরে বললো—

“আরাফ তূমি বরাবরই আমাকে ভুল সন্দেহ করে আসছো।” তোমার এ সন্দেহ করা তূমি বন্ধ কর।

এ সংসারে আরাফের সাথে প্রতিটা মুহূর্তে নিজেকে খাপ খাওয়াতে খাওয়াতে পৌষী ভীষণ ক্লান্ত আজ। পৌষীর সারাক্ষনই মনে হতে থাকে তাদের দুজনের সম্পর্কটা আজকাল খুবই নড়বড়ে একটি সাঁকোর উপরে দাঁড়িয়ে আছে। যে কোন বাতাসেই যেন সাঁকোর দুপাশের বাঁধন খুলে সাঁকোটি ঠিক নিচে তলানিতে চলে যেতে পারে। তখন আর একে খুঁজে পাওয়া যাবেনা।

পৌষী আর এই ইউনিভার্সিটিতে যাবেনা বলে সিদ্ধান্ত নিলো। অন্য যে কোন ইউনিভার্সিটিতে সে  ভর্তির কথা ভাবলো।

গত কয়েকদিন যাবৎ আরাফ পৌষীর সঙ্গে একদমই কথা বলছেনা। পৌষী কিছু জিজ্ঞেস করলেও ভীষণ মেজাজ দেখিয়ে জবাব দিচ্ছে। সে মেজাজের মাত্রা যেন আগের তুলনায় দ্বিগুন।  এভাবে কথা না বলে এই পরিস্থিতিতে ঘরের ভেতরে থাকতে যেয়ে যেন দম বন্ধ হয়ে আসতে লাগলো।
পৌষী কিছুদিন তার মামামামীর কাছে যেয়ে থাকবে বলে সিদ্ধান্ত নিলো এবং আরাফকে কথাটা বলতেই সে বলে উঠলো —

“মামামামীর কাছে গিয়ে থাকলে কি খুব সুবিধে হয়?  ইউনিভার্সিটিতেতো প্রতিনিয়ত স্যার এর সঙ্গে তোমার দেখা হচ্ছেই, তাহলে ?”

আরাফের কথা শেষ হওয়া মাত্রই এই প্রথমবারের মত পৌষী কিছুটা উচ্চবাক্য করে উঠলো আরাফের সঙ্গে !
পরক্ষনেই কিছুটা শান্ত হয়ে আরাফকে বললো — “আরাফ তূমি যা সন্দেহ করছো তা ভুল, এবং সম্পূর্ণই ভুল, এসব সন্দেহের  কোন ভিত্তি নেই, তোমার আমার সম্পর্কের মাঝে তূমি ভীষণ জটিল এক দেয়াল তুলেছো এই মিথ্যে অপবাদের রেশ টেনে। অমি চাই তূমি আমাকে এমন সন্দেহ করা থেকে বেরিয়ে আসো, আমরা নির্ভেজাল একটা সংসার করি ।”

পৌষীর কথা শেষ হতেই আরাফ ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। রাত ঠিক ১০ টা নাগাদ বাসায় ফিরে এসে পৌষীকে বললো–
“তূমি তোমার মামামামীর কাছে চলে যাও। আমি  তোমার সঙ্গে আর থাকতে চাইনা।” একথা বলে পৌষীর পাশ থেকে বালিশ খানা নিয়ে সোফায় গিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো।
পুরো রাত একা একা বিছানায় শুয়ে ভীষণ এক অস্বস্থিকর পরিস্থিতি নিয়ে রাত পার করলো পৌষী।

সকাল হতেই মনে হলো এ বিষয়টি সম্পর্কে পাভেল স্যার কে এবারে জানাতেই হবে । ওনাকে নিয়ে যেহেতু এতো কথা সেখানে অবশ্যই তাকে সবকিছু খুলে বলতেই হবে। সবকিছুর একটা সীমারেখা থাকে। সেটা যখন অতিক্রম করে ফেলে তখন তাকে আটকানোর চেষ্টা করা উচিত।
পরের দিন ক্লাসের অবসরে পৌষী বিষয়টি পাভেল স্যার কে পুরোপুরি খুলে বললো। মামামামিকেও বিষয়টি বললো ।
মামামামী আরাফের সঙ্গে কথা বললেন এবং তাকে অনেক বোঝালেন। কিন্তু আরাফ কিছুতেই চাইছেনা পৌষীর সঙ্গে থাকতে । পৌষীকে সে নিয়ে যেতে বললো তাদের কাছে।
অপমান অবহেলা সবকিছুর দ্বারপ্রান্তে এসে পৌষীরও মনে হলো কিছুদিনের জন্য ওর আরাফ থেকে দূরে সরে গিয়ে নিজেকে সময় দেয়া উচিত। এতে হয়তোবা আরাফেরও মনের পরিবর্তন হতে পারে।
পৌষী পরের দিনই মামার সঙ্গে তাদের বাসায় চলে গেলো। নিজের মনের সাথে বোঝাপড়া করতে গিয়ে পৌষীও পারছেনা ক্লাসে মনযোগী হতে। তাই ইউনিভার্সিটিতে যাওয়া কিছুদিনের জন্য বন্ধ রাখলো। দিন পনের বাদে পৌষী আবার  ইউনিভার্সিটিতে যাওয়া শুরু করলো। এ কয়দিনে ওর যথেষ্ট ক্ষতি হয়েছে ক্লাস না করতে পেরে। বন্ধু বান্ধবদের থেকে যতটুকুন সম্ভব তাকে সাহায্য নিতে হলো।

প্রায় তিনমাস ধরে পৌষী মামামামীর সঙ্গেই আছে। এই তিনমাসে আরাফকে দেখতে দু দুবার ওর বাসায় ফেরত গিয়েছে। কিন্তু আরাফ পৌষীকে প্রতিবারই অপমান করে তাড়িয়ে দেয়।

আরো কয়েকটি মাস কেটে যায়। পৌষী খুব অপেক্ষায় থাকে আরাফের। আরাফ হয়তো ওকে নিতে আসবে। কিন্তু সে অপেক্ষা শুধু অপেক্ষাতেই রয়ে যায়।

এদিকে পরীক্ষার সময় ঘনিয়ে এসেছে। ইদানিং পৌষী পড়াশোনায় নিজেকে এত ব্যস্ত রাখতে শুরু করেছে যে আরাফের দেয়া যন্ত্রনা আর  অপবাদগুলো যেন ভুলতে বসেছে। গত কয়েকটা দিন পাভেল স্যারও ক্লাসে আসেননি। ছুটিতে ছিলেন। পাভেল স্যারকে ছাড়া কারোরই যেন ক্লাস জমে উঠেনা, নিরশ মনে হয়। ছুটি কাটিয়ে আজ হঠাৎ করে পাভেল স্যার ক্লাসে ঢুকা মাত্রই সবাই মহা খুশি। পৌষী স্যার এর দিকে এক পলক তাকিয়ে বইয়ের দিকে মনযোগ দিতে লাগলো। বই থেকে মুখ তুলে আবারো পৌষী স্যার এর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো নিজের অজান্তেই। হঠাৎ যেন তার নিজেকে নিজের ভীষণ অস্থির মনে হতে লাগলো। স্যার বুঝতে পারলেন পৌষী ক্লাসে মনযোগ দিতে পারছেনা। কোন কারণে হয়তো কিছুটা অসামঞ্জস্যতা তৈরী হয়েছে। তিনিও পৌষীকে একটু পর পর ঘুরে ঘুরে দেখছিলেন । এবং এক পর্যায়ে তিনি পৌষীকে বললেন —

“পৌষী তোমাকে কিছুটা ক্লান্ত মনে হচ্ছে, তূমি চাইলে কিছু সময় ক্লাসের বাইরে থেকে হেঁটে আসতে পারো ”

ক্লাস থেকে পৌষী বের হতেই স্যারও আসলেন পৌষীর পেছন পেছন। স্যার পেছন থেকে পৌষীকে ডেকে বললেন —

“পৌষী কি হয়েছে? তোমাকে ভীষণ অন্যমনস্ক দেখাচ্ছে, তূমি ঠিক আছো ?

পৌষী স্যার কে কিছু বলতে গিয়েও পারলোনা বলতে, তবে নিজের মনের অজান্তেই যেন কিছু একটা পৌষী বলতে চাইছে এই প্রথমবারের মত । এর আগে সে কখনোই এমনটি ভাবেনি। আজ কি হয়েছে সে জানেনা। অথচ মানুষের মনের উপরে কোন জোর নেই, কোন হাত নেই। পৌষী পাভেল স্যার এর দিকে তাকিয়ে আবারো কিছু একটা বলতে চেষ্টা করে আটকে গেলো। নিজের মনকে নিজে বোঝালো। আর মনকে বললো আজ নয় অন্যদিন পৌষী তার মনের কথাটা স্যারকে বলবেই।

স্যার এর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে পৌষী সোজা বাইরে বেরিয়ে রিকশা নিলো। টকটকে রোদের প্রচন্ড তাপে রিকশার হুডি ফেলে চলতে শুরু করলো ঘরের  উদ্দেশ্যে । মামামামীর ঘরই এখন তার নিজের ঘর ।

ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে কলিংবেল চাপতেই মামী দরজা খুলে দিয়ে পৌষীকে জড়িয়ে ধরলেন। পৌষীর কপোলে চুমু দিয়ে বললেন ওপরওয়ালা এবারে তোর দিকে মুখ তুলে তাকিয়েছেন ।
পৌষী ঠিক বুঝতে পারলোনা এসব কথার মানে কি। ওদের শব্দ পেয়ে মামাও এসে হাজির । চোখের গ্লাস নামিয়ে চোখ মুছতে মুছতে মামা পৌষীকে বললেন —

“আরাফ এসেছিলো আজ। তোকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চাইলো। ও তার নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে। সেজন্য সে ক্ষমা চাইলো আমাদের কাছেও তোকে কষ্ট দিয়েছে বলে। তু্ই মা তোর কাপড়চোপড় গুছুয়ে ready থাক, ও আবার এসে তোকে নিয়ে যাবে বললো।”

পরের দিন পৌষী আর ক্লাসে গেলোনা। নিজের সঙ্গে সারাদিন বোঝাপড়া করতে লাগলো। মনকে প্রশ্ন করলো “কোন ভুল করে ফেলেনিতো?”
মন বললো “মোটেইনা। তোমার নিজের স্বাধীনতাকে কেন তূমি বিসর্জন দিবে ? তোমার ইচ্ছের মূল্য যখন সে দেয়নি তাহলে সবকিছু শেষের পর তূমি কেন দিবে? সে যখন চাইবে, তূমি তখন তার সংসার করবে, সে যখন চাইবে তখন তোমাকে ছুঁড়ে ফেলে দিবে, আবার যখন চাইবে, তখন তোমাকে কাছে টানবে! হয়তো আবারো কোনদিন সে তোমাকে যে কোন অজুহাতে দূরে ঠেলে দিবে। তূমি নিশ্চই রক্ত মাংসে গড়া কারো খেলার পুতুল নও! কারো ইচ্ছের কাছে কেন তূমি বলিদান হবে ?”
এতদিনের অবহেলা, অপমান, অসম্মান তার ভেতরে আরাফের সাথে এতটাই দূরত্বের সৃষ্টি করলো যে নিজের মনকে হাজারো বুঝিয়েও  পৌষী তার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে পারলোনা ! আরাফকে সে ফিরিয়ে দিবে এমন সিদ্ধান্তে অনড় থাকলো।

নিয়ম করে পৌষী প্রতিদিন ইউনিভার্সিটিতে যাচ্ছে। এবং পাভেল স্যার এর সঙ্গেও প্রতিদিন তার দেখা হচ্ছে। আরাফ কিংবা কেউ দেখে ফেলবে, জেনে ফেলবে সে বিষয় নিয়ে এখন আর পৌষী মোটেও ভীত নয়, বিব্রত নয়।

কয়েকটাদিন এভাবে যেতেই খুব বৃষ্টির এক সন্ধ্যেবেলা পাভেল স্যার ক্লাস শেষে তার গাড়িতেই পৌষীকে মামামামীর বাড়িতে নামিয়ে দিলেন।
ভেতরে ঢুকে পৌষী কিছুটা আঁতকে উঠলো। প্রায় এক বছর পর পৌষী আরাফকে দেখছে। পৌষীকে দেখে চায়ের কাপটা নিচে নামিয়ে আরাফ পৌষীর খুব কাছে এসে দাঁড়ালো। মামামামি দুজনই ওদেরকে ছেড়ে ভেতরের রুমের দিকে চলে গেলেন । আরাফ ফট করে পৌষীর ডান হাতটি জড়িয়ে ধরলো। পৌষী অনেক কষ্টে নিজের হাত আরাফের শক্ত হাতের মুঠো থেকে সরিয়ে নিতেই আরাফ কিছুটা কান্নার স্বরে পৌষীকে বলে উঠলো —

আমাকে মাফ করে দাও পৌষী,  আমি ভীষণ অন্যায় করে ফেলেছি তোমার সঙ্গে, সেটা এখন বুঝতে পেরেছি, আর তাই সেদিন এসেছিলাম তোমাকে তোমার সংসারে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চিরদিনের মত।

আরাফের সব কথাগুলো পৌষী ওর দিকে নিষ্প্রাণ দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে শুনলো। কিন্তু আরাফের জন্য তার মনের কোথাও কোন প্রতিক্রিয়া হলোনা।  নিজের অজান্তেই আরাফকে বলতে লাগলো —

“আরাফ তূমি ফিরে যাও, আমার সঙ্গে তূমি যা করেছো অমি তার জন্য তোমাকে ক্ষমা করে দিয়েছি। অমি এখন আর পারবোনা তোমার সঙ্গে ফিরে যেতে, কারণ তূমি অনেক দেরি করে ফেলেছো।”

“দেরি কেন বলছো পৌষী ? তুমিতো এখনো এখানেই আছো, তাহলে !”

“আরাফ আমি তোমার জন্য অনেক অপেক্ষায় ছিলাম। কিন্তু অপেক্ষায় থাকতে থাকতে আমার পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে, ঐ বাড়ি থেকে এসে আমি ভীষণ নিঃস্বঙ্গ, দুর্বিসহ একটা জীবন কাটিয়েছিলাম তোমাকে ছাড়া। তূমি ফিরে যাও।”

“না পৌষী, আমি তোমাকে নিয়েই ফিরতে চাই, তূমি ফিরে চলো। আমার মনের সে দেয়াল অমি ভেঙে۔۔ ফেলেছি।”

“আরাফ তূমি চলে যাও। আমি চাইলেও এখন আর তোমার সঙ্গে ফিরে যেতে পারবোনা। কারণ আমি অন্য কাউকে ভালোবেসে ফেলেছি আরাফ।”

“আমি তোমার কথা বিশ্বাস করিনা পৌষী, তূমি মিথ্যে বলছো। তূমি এটা করতে পারোনা।”

“আমি পেরেছি, তোমাকে ছেড়ে অন্য কাউকে আমি ভালোবাসতে শুরু করেছি।”

“তুমিতো আমার অপেক্ষায় ছিলে। তাহলে কিভাবে, কেমন করে তূমি অন্য কাউকে ভালোবাসতে শুরু করেছো ?” কবে থেকে ??

“যেদিন থেকে তূমি আমাকে সন্দেহ করা বন্ধ করে  মামামামীর কাছে এসে বলেছো তূমি আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চাও, তূমি তোমার ভুল বুঝতে পেরেছো, ঠিক সেদিন থেকেই আমি পাভেল স্যারকে প্রথম ভালোবাসতে শুরু করেছি এবং আমি তাঁকে কথা দিয়েছি।”

মেঘের আড়ালে লুকিয়ে থাকা নিরবিচ্ছিন্ন  অতীতের ডায়রিটা ঘাটতে ঘাটতেই পৌষী টের পায় — বিড়ালিনীটা হঠাৎ করে তার পাশ থেকে দৌড়ে চলে গেলো বাইরের কলিং বেলের টুংটাং আওয়াজে। কারণ এ সময়টা রূমঝুম স্কুল শেষ করে বাসায় ফিরে। পৌষীর একমাত্র মেয়ে রূমঝুম। ক্লাস থ্রীতে পড়ে। স্কুল বাস এসে ওকে বাসার সামনে নামিয়ে দিয়ে যায় প্রতিদিন ঠিক এই সময়টাতে। অতীত স্মৃতির সাথে বাইরের স্নোইং দেখতে দেখতে পৌষী আজ টেরই পেলোনা স্কুল বাসটা কখন এসে থামলো ওর দরজায় ?

নাজনিন নিশা- সংগীত শিল্পী, উপস্থাপিকা ও লেখক। মন্ট্রিয়ল।



এসএস/সিএ

 

সংবাদটি শেয়ার করুন