ফিচার্ড লেখালেখি

নেপাল-গোপাল : সুশীল কুমার পোদ্দার

নেপাল-গোপাল

নেপাল-গোপাল : সুশীল কুমার পোদ্দার

নেপাল আর গোপাল দুই ভাই । আমি ওদের চিনি সেই ছোট্ট বেলা থেকে । বড় ভাই গোপাল ওদের বাবা মরিয়া যাইবার পর সংসারের সকাল দায়িত্ব আপন কাঁধে তুলিয়া লইয়াছিল । সংসারের ঘানী টানিতে যাইয়া তাহার আর তেমন পড়ালেখা হয় নাই। মৃত্যুকালে সে বাবাকে কথা দিয়াছিল, সে তাহার সবটুকু দিয়া ছোটভাই নেপালকে পড়ালেখা শিখাইবে, মানুষের মতো মানুষ করিবে। তাই সে তাহার নিজের স্বপ্নকে ছিকায় তুলিয়া  নেপালকে ভালো স্কুলে দিয়াছে,  বাড়িতে  মাস্টার রাখিয়াছে । কিন্তু বিধি বাম ! তার ভাইটি পড়ালেখা উপেক্ষা  করিয়া  shortcut পথে প্রতিষ্ঠিত হইতে যাইয়া খারাপ সঙ্গে মিশিয়া গেল। তাহার বড় ভাইরা তাহাকে পরামর্শ দিল- পড়ালেখা করিয়া কেউ কখনো বড় হতে পারে নাই, বড় হইবার একমাত্র পথ হইলো রাজনীতি করা। নেপাল সেই শিক্ষায় দীক্ষিত হইয়া স্থানীয় ইলেকশনে চেয়ারম্যানের হইয়া  মিছিল করিল, প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করিবার জন্য সে অস্ত্র হাতে তুলিয়া লইল। খুব অল্প সময়েই সে কেন্দ্রের নেক নজরে পড়িয়া গেল। চেয়ারম্যানের প্রত্যক্ষ সমর্থন পাইয়া সে ভূমি দখল করিল, খাল বিল নদী নালা দখল করিয়া ‘এ জমি আমার’ বলিয়া সাইনবোর্ড লাগাইয়া দিল। সে  এখানেই থামিয়া থাকিল না। ব্যাংক হইতে বিশাল আকারের ঋণ লইয়া খুব অল্প সময়েই পরিকল্পিত ভাবে ঋণ খেলাফী হইয়া সামান এফ রহমানের  খাতায় নাম লেখাইল।

গোপাল  তাহার এই অধঃপতনে অতিশয় দুঃখিত হইলো । তাহার ভবিষ্যৎ লইয়া সে শঙ্কিত হইল। তাহাকে সাবধান করিতে যাইয়া তাহার সাথে তাহার দ্বন্দ্ব চরমে উঠিল। এদিকে একবার ব্যাংক হইতে টাকা লইয়া যে টাকা ফেরত  দিতে হয় না –  এমন সহজ কথা না  বুঝার জন্য সে তাহার দাদাকে মূর্খ বলিয়া গালি দিতেও দ্বিধাবোধ করিল না।

যতটুকু চরিত্রের স্খলন ঘটিলে লোকে তাহাকে পি কে হালদারের সাথে এক সারিতে দাঁড় করাইতে পারে,  সে তাহার কোন চেষ্টাই বাকি রাখিল না। মাঝে  মধ্যে তাহার  মনের মাঝে অপরাধবোধ জাগিয়া উঠিলে তাহা পরিশুদ্ধ করিতে  সে কলিকাতার বাংলা সিরিয়াল , স্টার জলসার  আশ্রয় লয়। তাহারা তাহাকে কক্ষনো নিরাশ করে না। সে তাহার কৃতকর্মের অনুরুপ উদাহরণ ঐ সমস্ত সিরিয়ালে বার বার দেখিতে দেখিতে আরও বড় কিছু করিতে অনুপ্রাণিত হইল।

তাহার চোখ পড়িল তাহার পৈতৃক ভিটার দিকে। তাহাদের এতবড় একটা  সম্পত্তি পড়িয়া থাকিতে দেখিয়া তাহার মনে হইল, আহা, যদি সবটুকু আমার হইত! তাহার ভালো মন বলিয়া উঠিল – তোমার দাদা তোমার জন্য এত কিছু করিয়াছে, সংসারের জন্য লোকটা তাহার সকল স্বপ্নকে বিসর্জন দিয়াছে, সেই দেবতাসম ভাইয়ের সাথে এমন প্রতারণা করিয়া তুমি কখনো সুখী হইতে পারিবে না। পর মুহূর্তেই তাহার কালো মন বলিয়া উঠিল – objection overruled – বড় বড় মুনি ঋষিরাই বলিয়া গিয়াছেন – কা তব কান্তা, ভাই ভাই ঠাই ঠাই।

যথাশীঘ্র উপযুক্ত পরামর্শ লইতে নেপাল তাহারই অপকর্মের সহযোগী পরম বন্ধু আব্দুলের শরণাপন্ন হইল। বন্ধু আব্দুল তাহার কথা শুনিয়া দমকে দমকে হাসিয়া উঠিল। ‘আরে নেপাল, এটাতো আমার বা হাতের খেল। এমন ঘটনা কতো ঘটাইছি। এই বয়সে পাঁচ পাঁচটা সম্পত্তি কি এমনি  হইছে? তুই এক কাজ কর, তোর অংশটা আমায় লিখে দে। আমি তোর গোপাল দাদাকে কেমন করে তাড়াই – শুধু চাইয়া চাইয়া দেখবি’। আবদুলের কথায় নেপাল খুব বেশি ভরসা পাইল না। বার বার বলিল – আব্দুল ভাই, তুমি কি দাদাকে তাড়াইয়া সমস্ত সম্পত্তি আমার হাতে তুলিয়া দেবে? ধূর্ত আব্দুল নেপালের মাথায় হাত রাখিয়া বলিল – নেপাল কোন ভয় নাই – উপড়ে আল্লা, আর নীচে আমি।

নেপাল যথারীতি তাহার অংশ আব্দুলকে লিখিয়া দিল। আব্দুল সে সম্পত্তি দখল করিয়াই দোতলা ঘর তুলিল। যাহা করিলে গোপালের মনে কষ্ট দেওয়া যায় তাহার সব পরিকল্পনা পূরণ করিতে সে বিশাল এক ছক কাটিল। গোপালরা চিরকালেই বোকা কিছিমের মানুষ। আর কিছু থাক বা থাক – তাহাদের আছে টনটনে আত্মসম্মান  বোধ। এদিকে নিজের ছোট ভাইয়ের প্রতারণায় সে অর্ধেক মরিয়া গিয়াছে, তাহার উপর তাহার পৈত্রিক ভিটার উপর গরু জবাইয়ের ঘটনায় তাহার মন ভাঙিয়া গেল। সে নিজের সাথে যুদ্ধ করিতে করিতে ক্লান্ত হইয়া  রাতের অন্ধকারে অনিশ্চিত পথে পা বাড়াইল।

নেপাল, আব্দুল উভয়েই অত্যন্ত পুলকিত বোধ করিল। কিন্তু তাহাদের এই আনন্দ বেশীদিন স্থায়ী হইল না। কে বা কারা এক গভীর অভিসন্ধি লইয়া তাহাদের এই অপকর্ম প্রকাশ করিয়া দিল অত্যন্ত অভিনব উপায়ে। আমরা সমাজের অভিভাবকেরা অনেক কথা, অনেক ঘটনা সহজেই ভুলিয়া যাই, কিন্তু তরুণেরা সহজে ভোলে না। তাই তারা এবারের তীর ছুড়িল তরুণদের লক্ষ্য করিয়া। নেপাল আব্দুলদের সামনে আনিয়া তাহারা সুকৌশলে একটা সুক্ষ বার্তা পাঠাইয়া দিল,যাহার প্রতিক্রিয়া বড় সূদুর প্রসারী।  বিবেকবান মানুষ সবাই প্রতিবাদ জানাইল। টিভিতে টক সো হইল, বিজ্ঞেরা বলিলেন – এ সবই নষ্ট রাজনীতি, আর নষ্ট সংস্কৃতির ফসল। নেপাল আর আব্দুল অত্যন্ত বিপন্ন বোধ করিয়া চেয়ারম্যানের শরণাপন্ন হইল। চেয়ারম্যান হাসিয়া বলিল – কয়েকটা দিনের জন্য গা ঢাকা দে, দেশের মানুষ খবর চায়, নতুন কোন খবর আসিলেই ওরা পুরানো খবর  ভুলিয়া যাইবে।


।। সুশীল কুমার পোদ্দার , ওয়াটারলু, কানাডা নিবাসী ।  ফলিত পদার্থ বিদ্যা ও ইলেকট্রনিক্স,  মাস্টার্স,  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় , বাংলাদেশ ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স,   ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, পি, এইচ, ডি,   ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। সিস্টেম ডিজাইন ইঞ্জিনিয়ারিং, ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স,  ওয়াটারলু, বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডা ।।



সংবাদটি শেয়ার করুন