প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে মিয়ানমারের ২৬৪ জন বাংলাদেশে
মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপির পর সেনাবাহিনী, পুলিশ, কাস্টমস ও বেসামরিক ব্যক্তিরাও প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিচ্ছে। রাখাইন রাজ্যে বিদ্রোহী আরাকান আর্মির সঙ্গে জান্তা অনুগত সামরিক বাহিনীর চলমান সংঘর্ষের মধ্যে গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যা পর্যন্ত অন্তত ২৬৪ জন বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার খবর পাওয়া গেছে। সংঘাতের কারণে সীমান্ত এলাকা থেকে বাংলাদেশিদের সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। মিয়ানমার থেকে ছোড়া মর্টার শেলের আঘাতে গত সোমবার কক্সবাজারের তুমব্রুতে এক বাংলাদেশিসহ দুজন নিহত হয়।
ওই ঘটনাসহ সীমান্ত পরিস্থিতির বিষয়ে প্রতিবাদ জানাতে গতকাল ঢাকায় মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত অং কিয়াও মোকে তলব করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এরপর মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র জানান, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মিয়ানমার অনুবিভাগের মহাপরিচালক মিয়া মো. মইনুল কবির রাখাইন রাজ্যের সহিংসতা সীমান্তের এপারে বাংলাদেশে এসে পড়ায়, বিশেষত ওই সহিংসতায় কক্সবাজারে দুজনের মৃত্যু ঘটার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, রাষ্ট্রদূতকে একটি কড়া প্রতিবাদ বার্তা দিয়েছে বাংলাদেশ। রাষ্ট্রকে বলা হয়েছে, সীমান্তে যা ঘটছে তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
রাষ্ট্রদূত বলেছেন, তিনি তাঁর সরকারকে বাংলাদেশের প্রতিবাদের কথা জানাবেন।
এদিকে নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠেয় বাংলাদেশ ও ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে মিয়ানমার সীমান্ত পরিস্থিতি উঠবে বলে জানা গেছে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের বিরোধ নেই। সেখানে যা ঘটছে তা তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়।
শুধু মিয়ানমার নয়, কারো সঙ্গেই বাংলাদেশ যুদ্ধে জড়াতে চায় না।
বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিজিবি) জানায়, গত দুই দিনে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিজিপি) সদস্য, সরকারি ও সেনা কর্মকর্তাসহ ২২৯ জন বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। তাদের মধ্যে গত সোমবার বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ও তুমব্রু সীমান্ত দিয়ে দুই দিনে ১০৬ জন, উখিয়ার পালংখালীর রহমতের বিল এলাকা দিয়ে ১২৩ জন প্রবেশ করে। গতকাল সকাল পর্যন্ত সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া মিয়ানমার বাহিনীর মধ্যে সেনাবাহিনীর দুজন সদস্য, সিআইডির চারজন, পুলিশের পাঁচ সদস্য, স্পেশাল ব্রাঞ্চের ৯ জন, ইমিগ্রেশন সদস্য ২০ জন ও চারজন অসামরিক লোক রয়েছে। তাদের নিরস্ত্র করে কক্সবাজার বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধীনে নিরাপদ আশ্রয়ে রাখা হয়।
গতকাল বিকেল নাগাদ মিয়ানমার থেকে এসে আশ্রয় নেওয়া ব্যক্তির সংখ্যা ২৬৪-তে দাঁড়ায় বলে জানা গেছে।
উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরী জানান, ‘মিয়ানমারে আরাকান আর্মির আক্রমণের মুখে আমার এলাকার সীমান্ত দিয়ে ১১১ জন বিজিপি সদস্য পালিয়ে আসেন। তাঁরা এখন বিজিবি হেফাজতে রয়েছেন। তাঁদের মধ্যেও অনেকে আহত রয়েছেন।’
সীমান্ত এলাকার বাসিন্দাদের নিরাপদে সরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ
মিয়ানমারের রাখাইনে চলমান সংঘাতে গুলিবর্ষণ, মর্টার শেলসহ বিস্ফোরণের শব্দে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম সীমান্ত এলাকাজুড়ে থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। গত সোমবার ঘুমধুমের জলপাইতলী গ্রামে মর্টারের গোলা পড়ে বাংলাদেশি নারী ও রোহিঙ্গা ব্যক্তি মারা যাওয়ার পর থেকে স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে যারা সীমান্তের কাছাকাছি বাস করছে তারা খুবই আতঙ্কে আছে। এর আগেই জেলা প্রশাসনের নির্দেশনা মেনে স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে সীমান্তের লোকজনকে অন্যত্র সরিয়ে নিতে বলা হয়েছিল। কিন্তু আশ্রয়ের জায়গার অভাবে এবং সামর্থ্য না থাকায় অনেকে সীমান্ত এলাকা থেকে সরেনি। এমন প্রেক্ষাপটে বান্দরবান জেলা প্রশাসন তাদের সরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে।
বান্দরবানের জেলা প্রশাসক শাহ মুজাহিদ উদ্দিন বলেন, সীমান্ত পরিস্থিতি উত্তেজনাকর। এমন পরিস্থিতিতে স্থানীয় বাসিন্দারা ঝুঁকিপূর্ণ। প্রাথমিক অবস্থায় ঘুমধুম ও তুমব্রু সীমান্তের মানুষকে নিরাপদে আশ্রয়ে যেতে বলা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিরা কাজ করছেন।
জেলা প্রশাসনের নির্দেশনা মেনে নাইক্ষ্যংছড়ির উপজেলা প্রশাসন উত্তর ঘুমধুম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও কচুবনিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে আশ্রয়কেন্দ্র ঘোষণা করা হয়। এর আগের দিন সীমান্ত পরিস্থিতি বিবেচনা করে পাঁচটি স্কুল অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অধিদপ্তর। আশ্রয়কেন্দ্র ঘোষণার পর তুমব্রু, মধ্যমপাড়া, পশ্চিমকুল, ঘোনারপাড়া ও জলপাইতলী এলাকার কিছু পরিবারের সদস্য সেখানে আশ্রয় নিয়েছে বলে জানা গেছে।
এদিকে পরিস্থিতি বিবেচনায় কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফ সীমান্ত এলাকার লোকজনকে নিরাপদে সরানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে কক্সবাজার জেলা প্রশাসন। গতকাল বিকেলে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ শাহীন ইমরান ও জেলা পুলিশ সুপার মাহফুজুল ইসলাম উখিয়া ও টেকনাফের কয়েকটি সীমান্তবর্তী গ্রাম পরিদর্শন করেন।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ শাহীন ইমরান জানান, মিয়ানমারে সংঘাত বেড়েছে। মিয়ানমার থেকে ছোড়া গুলি ও মর্টার শেল এসে পড়ছে সীমান্তের এপারে বসতঘরে। এর পরিপ্রেক্ষিতে মিয়ানমারের কাছাকাছি সীমান্তে বসবাসরত লোকদের নিরাপদে সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশনা রয়েছে।
সীমান্তের এপারে ফের মর্টার শেল
সোমবার সন্ধ্যা থেকে গতকাল ভোররাত পর্যন্ত বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রু সীমান্তে মিয়ানমারের মর্টার শেল ও গোলাগুলি অব্যাহত ছিল। গতকাল ভোরে তুমব্রু মধ্যমপাড়ার এক বাড়ির উঠানে একটি মর্টার শেল পড়েছে। ঘুমধুম সীমান্তের এপারে গত সপ্তাহে ১৪টি মর্টার শেল পড়েছে।
ঘুমধুমের ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত নারী সদস্য খালেদা বেগম বলেন, অনেক মর্টার শেল ধানক্ষেতে বা পাহাড়ে পড়েছে। লোকজন তেমন ঘর থেকে বের হচ্ছে না। তাই সেগুলো চোখে পড়ছে না।
এপারে ২৩ রোহিঙ্গা
বিজিপির পাশাপাশি ২৩ জন রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে। গতকাল সকালে উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়নের রহমতের বিল সীমান্ত দিয়ে তারা এসেছে। তাদের পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে রাখা হয়েছে।
এর আগে গত সোমবার টেকনাফ হোয়াইক্যং উলুবনিয়া সীমান্ত দিয়ে পাঁচ সদস্যের একটি রোহিঙ্গা পরিবার অনুপ্রবেশের চেষ্টা করলে বিজিবি তাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠায়। সোমবার রাতে সীমান্ত দিয়ে তঞ্চঙ্গ্যা সম্প্রদায়ের আটজনের একটি দল ঢুকেছে। তাদেরও বিজিবি হেফাজতে নেওয়া হয়েছে বলে জানা যায়।
এদিকে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন গতকাল ঢাকায় সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশ পুলিশের প্রতিটি সদস্য দেশের প্রয়োজনে দায়িত্ব পালনের জন্য প্রস্তুত আছেন। ঘুমধুম সীমান্ত এলাকায় বিজিবির সঙ্গে সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী পুলিশ কাজ করছে।
বিজিবির নবনিযুক্ত মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী গোপালগঞ্জে সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘সীমান্ত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। আমরা ধৈর্য ধারণ করে মানবিক দিক থেকে এবং আন্তর্জাতিক সুসম্পর্ক বজায় রেখে পরিস্থিতি মোকাবেলার চেষ্টা করছি।’
সূত্র: কালের কন্ঠ