পঞ্চম পর্ব
ভয়াবহ বিমান ভ্রমণের অভিজ্ঞতা ও অনুষঙ্গ ৫
বগুড়ার আব্দুল খালেক খসরু পাকিস্তান বিমান বাহিনীর একজন কম্যান্ডো হিসেবে কর্মরত থাকা অবস্থায় একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। তিনি পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। স্বাধীনতার পর আওয়ামী যুবলীগ গঠিত হলে তিনি বগুড়া জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক/সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। বঙ্গবন্ধুহত্যার পর সেপ্টেম্বরের প্রথম দিকে তিনি বগুড়া থেকে ঢাকায় চলে আসেন এবং সাময়িকভাবে আশ্রয় নেন আমার বড়োভাই আওরংজেব আলমগীরের (Aurangzeb Alamgir) ঢাকার আরজত পাড়ার বাসায়। তিনি আমার ভাবীর ফার্স্ট কাজিন। পরে আমরা দুজনেই ভারতে চলে যাই এবং কাদের সিদ্দিকীর সাথে যোগ দেই। পরে ০৭ অক্টোবর কাদের সিদ্দিকীসহ আমরা ২৮ জন নৌপথে বাংলাদেশে প্রবেশ করি। তার আগে এই ২৮ জনকে নিয়েই এক প্রতিরোধ বাহিনী গঠন করা হয় যার প্রধান ও উপপ্রধানের দায়িত্বে ছিলেন যথাক্রমে আব্দুল কাদের সিদ্দিকী ও আব্দুল খালেক খসরু। আমরা যমুনা নদীর উপর দিয়ে টাঙ্গাইলের দিকে আসার পথে ১২ আক্টোবর ১৯৭৫ সিরাজগঞ্জের কাজিপুর উপজেলার নিশ্চিন্তপুর গ্রামে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাথে এক সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিয়ে জীবন দেন বঙ্গবন্ধুর এই সাচ্চা অনুসারী ও বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল খালেক খসরু। তিনি হলেন প্রতিরোধ সংগ্রামীদের মাঝে প্রথম শহীদ। তাঁর নামও রাজাকারের তালিকায় – বিজয়ের মাসে! খুব আঘাত পেয়েছি মনে। মনের চাপ থাকায় শারীরটা আরো দুর্বল হয়ে পড়েছে। একদিকে জামালপুরে শহীদ খুররম স্মৃতিস্তম্ভকে সফলভাবে গড়ে তুলতে পারার প্রশান্তি; অন্যদিকে খসরু ভাইয়ের নাম রাজাকারের তালিকায় দেখতে পাওয়ার কষ্ট! কী অসাধারণ বৈপরিত্য নিয়ে আমরা পথ চলছি!
আরও পড়ুনঃ ভয়াবহ বিমান ভ্রমণের অভিজ্ঞতা ও অনুষঙ্গ ৪
সারারাত না ঘুমিয়ে ১৯ ডিসেম্বর ভোরে যখন ময়মনসিংহ থেকে ঢাকার দিকে রওনা দেই তখন শরীর আমার বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছে। অপরাহ্ন ১টা ৫০ মিনিটে আমার ফ্লাইট। ঠিক করলাম হাতে আর কিছুই বহন করবো না। তাই ঢাকার হযরত শাহ জালাল (রাঃ) এয়ারপোর্টে ঢুকে হ্যান্ড-ক্যারিয়ারটিকেও লাগেজ হিসেবে দিয়ে দিলাম বোর্ডিং পাস নেয়ার সময়। এরপর থেকে লাউঞ্জে বসে আছি বিমানে উঠার ডাকের অপেক্ষায়। তখনই একদল ওমরাহ যাত্রী এসে লাউঞ্জ ভরিয়ে দিলেন। সাদা রঙয়ের ছোটো দুপাটি রোব দিয়ে শরীর ঢেকে রাখা। দেখতে পেলাম ৭/৮ বছরের দুটি ছেলেও আছে তাঁদের সাথে। আমার শরীরে ঘুম দরকার। কিছুক্ষণের মধ্যেই তন্দ্রা লেগে গেলো, কিন্তু সে চন্দ্রা কেটেও গেলো নতুন এক ঘোষণায়ঃ জেদ্দামুখী যাত্রীদেরকে এখন অন্য একটি লাউঞ্জে যেতে হবে। আমি বিস্মিত! তবু অন্য সবার সাথে আমিও হাঁটতে শুরু করলাম। এক জায়গায় এসে থামতে হলো এবং লাইনে দাঁড়াতে হলো। বাঙালির লাইন কি আর সহজে লাইন হয়? ঠ্যালা-ধাক্কা করতে করতেই বেশ সময় গেলো। এরই মধ্যে ওমরাহযাত্রীদের নাম ও নম্বর ধরে ডাকতে শুরু করলেন কর্তব্যরত ব্যক্তিরা। তাঁদেরকে আলাদা লাইনে দাঁড়াতে হবে এবং তাঁরাই আগে উঠবেন বিমানে। মোমিন সাহেব কি আমাকে ওমরাহ ফ্লাইটে ঢুকিয়ে দিয়ে তাঁর কর্তব্য সেরে ফেলেছেন? বিমানে উঠার পর বসে আছি জল-পানির অপেক্ষায়। দীর্ঘ দুই ঘণ্টার মধ্যেও কেউ কোনো ড্রিঙ্কস ট্রে নিয়ে এলেন না – একজন কেবিন ক্রুর চেহারাও দেখা গেলো না। ক্রমেই আমি ধৈর্যহারা হয়ে যাচ্ছি। এক সময় খাবার দেয়া হলো, কিন্তু অধিকাংশই আমার খাওয়ার অযোগ্য।
আরও পড়ুনঃ ভয়াবহ বিমান ভ্রমণের অভিজ্ঞতা ও অনুষঙ্গ ১
প্রায় ৭ ঘণ্টা পর জেদ্দা এয়ারপোর্টে নেমে আগের নিয়মে সেখানকার আন্তর্জাতিক লাউঞ্জে গিয়ে একটি সিট পেয়ে বসে গেলাম আর অপেক্ষায় থাকলাম কখন শেষ হবে পরবর্তি ৮ ঘণ্টার দুঃসহ ট্রানজিট! রাত বাড়ার সাথে সাথে লাউঞ্জে ভিড়ও বেড়ে গেলো প্রচুর – আগের মতোই। একটু পর পর মাইক্রোফোনে একেকটি ঘোষণা আসতে থাকলো – ইংরেজি, আরবি ও উর্দুতে। ঘুমের কথা মাথায় আনা হবে পাগলামি; আপাতত বসে থাকার জায়গাটি রাখতে পারলেই হয়! অবশেষে, প্রায় সাড়ে ৮ ঘণ্টার মাথায় লন্ডনের উদ্দেশ্যে আরেকটি সৌদি বিমানে উঠা সম্ভব হলো। বলে রাখি, সিঁড়ি বেঁয়ে বিমানে উঠার সময় শেষ দুটি ধাপে পা তুলতেই পারছিলাম না। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সদয় ফ্লাইট এটেন্ড্যান্টটি হাত বাড়িয়ে দেয়ায় উঠে আসতে সক্ষম হলাম। আবারো মোমিন সাহেবের কথা মনে পড়ে গেলো। তবে ঠিক সময়ে লন্ডনে পৌছতে পেরে হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। …চলবে.. আগামীকাল থাকবে ভয়াবহ বিমান ভ্রমণের অভিজ্ঞতা ও অনুষঙ্গ ৫ (শেষ পর্ব)