ভ্রমণ

ভয়াবহ বিমান ভ্রমণের অভিজ্ঞতা ও অনুষঙ্গ শেষ পর্ব

বিল্লাহ ভাই

শেষ পর্ব

 

ভয়াবহ বিমান ভ্রমণের অভিজ্ঞতা ও অনুষঙ্গ শেষ পর্ব।।  লন্ডনে ৭ ঘণ্টার কিছু বেশি সময়ের ট্রানজিট – বেলা ১টায় এয়ার ক্যানাডা ধরবো। প্রায় ৬ ঘণ্টা অপেক্ষার পর ঘোষণা এলো ১টার ফ্লাইট বিকেল ৪টায় যাবে – কারিগরি ত্রুটি সেরে নেয়া হচ্ছে। এর পরের ঘোষণা এলো বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে। বলা হলো নির্ধারিত ফ্লাইটটি বাতিল করা হয়েছে এবং পরদিন সকাল ৮টায় এয়ার ক্যানাডার নতুন ফ্লাইট ধরতে হবে। আটকে যাওয়া যাত্রীদের জন্য হোটেলের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যে বাস এসে যাত্রীদেরকে হোটেলে নিয়ে যাবে।

আমার লাগেজের কী হবে এখন? সেগুলি তো মন্ট্রিয়ল পর্যন্ত যাওয়ার কথা! বলা হলো ফ্লাইট নম্বর অনুযায়ী নির্ধারিত বেল্টে সেগুলি পাওয়া যাবে। নির্দেশ ফলো করে ইমিগ্রেশন চেক আউটের পর লাগেজ বেল্ট খুঁজতে শুরু করলাম। প্রায় ২৫০ জন যাত্রী; কে কার আগে যাবে তারই প্রতিযোগিতা! স্বাভাবিকভাবেই আমি অনেক পেছনে পড়ে গেলাম। একটি ট্রলি নিয়ে বেল্টের কাছে যাওয়ার সময় বুঝতে পারলাম ট্রলিটি চালানো সহজ কাজ নয়। যেদিকে পুশ করি সেদিকে সহজে নেয়া যায় না – ঘুরে যায় অন্যদিকে। বেল্টের কাছে এসে দাঁড়ানোর বেশ কিছু পর আমার লাগেজ এলো সামনে। কিন্তু আমি ছোটো লাগেজটি ধরেও নামাতে পারছিলাম না। তখনই পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক যাত্রী দ্রুত আমার ব্যাগদুটি ধরে নামালেন এবং ট্রলিতেও তুলে দিলেন। ভদ্রলোককে ধন্যবাদ দিয়ে এগুতে থাকলাম বাস ধরার জন্য। কিন্তু সেটি কোথায়? এক কাউন্টারে গিয়ে জিজ্ঞেস করলে যেতে বলে অন্য কাউন্টারে। সেখান থেকে আবার অন্যস্থানে। আমি কি এতোক্ষণ ধরে ট্রলি ঠেলে ঠেলে এসব করতে পারি? শরীর দিয়ে দর দর ঘাম ঝরছে। শেষাবধি পৌঁছতে পারলাম বাসস্টপে। বহু মানুষের ভিড় – লম্বা লাইন দিয়ে সবাই দাঁড়িয়ে আছে বাসে উঠার জন্য। এক এক করে ৩টি বাসে উঠে যাত্রীরা চলে যাওয়ার পর ৪ নম্বর বাসটি আমাদের সামনে এসে দাঁড়ালো। এখন সমস্যা দেখা দিলো ট্রলি থেকে ব্যাগ দুটি নামাবো কী করে! এমন সময় আমার হাতে লাঠি দেখে এক ভদ্রলোক এগিয়ে এসে আমাকে সাহায্য করলেন এবং ব্যাগদুটি বাসের ট্র্যাঙ্কে ঢুকানো সম্ভব হলো। পরে বাসের ছোটো ছোটো সিঁড়ি বেয়ে উঠতে গিয়েও অন্য একজনের স্বতস্ফুর্ত সাহায্য পেলাম। নিশ্চয়ই আমরা এতোক্ষণে সভ্যতার ভিন্ন সীমানায় ঢুকে পড়েছি।

আরও পড়ুনঃ ভয়াবহ বিমান ভ্রমণের অভিজ্ঞতা ও অনুষঙ্গ ৫

বাসচালক শ্রীলংকান অরিজিন এক ব্রিটিশ জোয়ান। পুরো সময়টা নানাধরণের জোঁক বলতে বলতে আমাদেরকে হোটেলে নিয়ে এলেন। দুর্ভোগে পড়া যাত্রীরা তা বেশ উপভোগও করলেন মনে হলো। তবে ৫ মিনিটের পথ শেষ করতে লেগে গেলো প্রায় ৪৫ মিনিট। হঠাৎ করেই যানজট লেগে গিয়েছিলো। হোটেলে পৌঁছেও মাল-সামানা নিয়ে লম্বা লাইনে দাঁড়াতে হলো। বোঝা গেলো অল্প সময়ের নোটিশে এতোগুলি গেস্টকে রিসিভ করতে গিয়ে হোটেলটি কাবু হয়ে পড়েছে। তবে আমি কাবু হয়েছি অনেক বেশি। এখন আর লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি আমার নেই। হাঁটু দুটি মাটিতে ভেঙ্গে পড়তে চাইছে। অবশেষে লাইন প্রায় শেষ হয়ে এলো – আমিসহ ৪ জন বাকি। তখন হোটেল কর্মচারিটি জানালেন আর কোনো রুম এই মুহুর্তে রেডি নেই। অপেক্ষায় থাকতে হবে আরো আধো ঘণ্টা। এই ফাঁকে তিনি আমাদেরকে খেয়ে নিতে বললেন। পাশেই খাবার ব্যবস্থা। কিন্তু পা ফেলে সেখানে এগিয়ে যাওয়াও কঠিন মনে হচ্ছে। মোমিন সাহেব, একটু দোয়া-দরুদ পড়ুন আমার জন্য। জানি, এই যান্ত্রিক ত্রুটির জন্য আপনি দায়ী নন।

পরে আমারও রুম হলো – রাতে কিঞ্চিত ঘুমও হলো। ভোরে বাসে উঠে এয়ারপোর্টেও আসা হলো। লাগেজ টানার ব্যাপারে আগের মতোই সাহায্য পেতে থাকলাম অন্য যাত্রীদের কাছ থেকে। বোর্ডিং পাস নেয়ার পর থেকে হুইলচেয়ার সুবিধা পেতে থাকলাম। বিমানে উঠতেও কোনো অসুবিধা হলো না। ক্রুদের আচরণও ভালো। অবশেষে, মন্ট্রিয়লে এসে পৌছলাম ২১ ডিসেম্বর সকাল ১০ টার দিকে। পৌঁছার কথা ছিলো আগের দিন বেলা সাড়ে ৩টায়। শেষ ঘটনাটি ঘটলো ট্র্যুডো এয়ারপোর্টে বিমান থেকে নেমে টানেল ধরে হেঁটে আসার সময়। হঠাৎ আমার বাম পা পিছলে গেলো এবং আমি কাঁত হয়ে পড়ে গেলাম ফ্লোরের উপর। একক চেষ্টায় উঠতে পারছিলাম না। তখনও এক যাত্রীর সাহায্য নিয়ে আমাকে উঠে দাঁড়াতে হয়। অন্য কোনো স্বাস্থ্যবান যাত্রীর ক্ষেত্রে এই ঘটনাগুলিকে হয়তো অতিরিক্ত ঝক্কি হিসেবে দেখা যেতো, কিন্তু আমার শরীর-স্বাস্থ্যের বিচারে এটি ছিলো এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতা।

মন্ট্রিয়ল; ২৬ ডিসেম্বর ২০১৯

কানাডা প্রবাসীদের অনুষ্ঠানের ভিডিও দেখতে হলে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের চ্যানেল

সংবাদটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

nine + sixteen =