মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বরাবরে স্মারকলিপি
১৯শে সেপ্টেম্বর, ২০২২
নিউ ইয়র্ক সিটি।
মাননীয়া গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী
জননেত্রী শেখ হাসিনা সমীপেষু।
বিষয়: বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান সংখ্যালঘু নির্যাতন বন্ধ করা প্রসঙ্গে।
মাননীয়া প্রধানমন্ত্রী:
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৭তম অধিবেশনে আপনার যুক্তরাষ্ট্রে আগমনকে আমরা স্বাগত জানাই, এবং এই সফরের সার্বিক সাফল্য কামনা করি। আপনার সুযোগ্য নেতৃত্বে দেশের সকল সেক্টরে যে অভাবনীয় উন্নয়ন সাধিত হয়েছে তৎজন্য আমরা আপনার প্রশংসা করি। আপনার সরকারের এই অর্জনের জন্য আপনি আমাদের আন্তরিক অভিনন্দন গ্রহণ করুন।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আমাদের এই স্মারকলিপির উদ্দেশ্য হল দেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর ক্রমবর্দ্ধমান সামপ্রদায়িক সন্ত্রাস বন্ধ করে এর একটি টেকসই, গ্রহণযোগ্য সমাধান খুঁজে বের করতে আপনার ব্যক্তিগত সাহায্য চাওয়া। বাংলাদেশের জন্মের অব্যবহিত পর থেকেই পাকিস্তানের ধারাবাহিকতায় দেশের সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার নিপীড়ন চলে আসছে। কোন সরকার কখনো সংখ্যালঘুর সুরক্ষা ও সম-অধিকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে আন্তরিকতা দেখায়নি। আপনি বঙ্গবন্ধু কন্যা এবং আমাদের শেষ ভরসাস্থল, তাই আমাদের আবেদন, আপনি এ সমস্যার একটি স্থায়ী সমাধান করে দিন।
মাননীয়া প্রধানমন্ত্রী, ২০১৩ সালে রামুর ঘটনা থেকে ২০২১ সালের পুজো এবং তৎপরবর্তী সময়ে ক্রমবর্দ্ধমান হারে সংখ্যালঘু নির্যাতন অব্যাহত থাকার কারণ হচ্ছে, এ’ বিষয়ে প্রশাসন ও সরকারের উদাসীনতা, এবং নির্যাতনকারীদের বিচার না করে তাদের প্রশ্রয় দেওয়া। এ’ছাড়া ১৯৭২’র সংবিধান পুন্:প্রতিষ্ঠা না করা এবং ৮ম ও ৫ম সংশোধনী বহাল রাখা সংখ্যালঘু নির্যাতনের অন্যতম কারণ। উপরন্তু, সামপ্রতিক কালে প্রায়শ:ই ক্রমবর্ধমান হারে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন সংখ্যালঘু নির্যাতনের নুতন অস্ত্র হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
জন্মগতভাবে বাংলাদেশ একটি ধর্মনিরপেক্ষ-গনতান্ত্রীক রাষ্ট্র, সেই দেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন কাম্য নয়, বিশেষত: বঙ্গবন্ধু পরিবারের কেউ যখন দীর্ঘদিন ক্ষমতায় আসীন। সংখ্যালঘু নির্যাতনের কারণে আপনার সরকারের প্রচারিত শান্তি সংস্কৃতি’র শ্লোগান অসাড় হয়ে পড়েছে; প্রতি বছরেই দেশের সংখ্যালঘু সমপ্রদায়ের ওপর সন্ত্রাস এবং সেটা বন্ধ করতে সরকারের অনীহা দেখে বিশ্ববাসী এই স্লোগানে বিশ্বাস করতে পারছে না। পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি আজও বাস্তবায়িত হয়নি। এতেও দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হচ্ছে এবং এই ব্যর্থতা আপনার সকল অর্জন ও সাফল্যকে ম্লান করে দিচ্ছে।
মাননীয়া প্রধানমন্ত্রী, জজ শাহাবুদ্দীন কমিশন বিচার-যোগ্য পাঁচ হাজারেরও অধিক সংখ্যালঘু নির্যাতক অপরাধীর একটি দীর্ঘ তালিকা আপনার হাতে রয়েছে, যাদের বিচার করতে আপনি অঙ্গীকারবদ্ধ। রামু থেকে শাল্লা হয়ে ২০২১ সালে শারদীয় পুজোর সময় পর্যন্ত সংঘটিত সকল সংখ্যালঘু নির্যাতকদের দীর্ঘতর তালিকা গোয়েন্দা বিভাগের কাছে রয়েছে। আপনি চাইলেই এদের বিচার হতে পারে। আমরা বুঝি না, আপনি কেন এই কলঙ্কের ভাগীদার হবেন! আপনার কাছে আমাদের তথা দেশের প্রগতিশীল মুসলমানদের চাওয়া-পাওয়া এর চেয়ে অনেক বেশি, কারণ আপনি শুধু বঙ্গবন্ধু কন্যা নন, আপনি অন্তর্জতিকভাবে স্বীকৃত একজন স্টেটসওমেন।
মাননীয়া প্রধানমন্ত্রী, সংখ্যালঘু নির্যাতনের বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে অবশিষ্ট হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রস্টিান ও আদিবাসী আগামী দুই-তিন দশকের মধ্যে নি:শেষ হয়ে যাবে। মৌলবাদী-সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী তাই চায়। কিন্তু বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের কাছে এটা কাম্য হতে পারে না। আপনি নিজে এবং আপনার সরকারের প্রতিনিধিগণ নিয়মিত বলছেন যে বাংলাদেশে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র যেখানে সকল নাগরিক সমান অধিকার ভোগ করছে; কিন্তু বাস্তবতা তো তা নয়। এটা আপনার লক্ষ্য বলে আমরা বিশ্বাস করি, আর আমরা জানি যে আপনি চাইলেই সংখ্যালঘুদের সুরক্ষার স্থায়ী ব্যবস্থা করে ওই লক্ষ্য অর্জন করতে পারেন। তাই, আপনার কাছে আমাদের আবেদন এই যে, আপনি সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিরুদ্ধে “জিরো টলারেন্স” ঘোষণা করুন, এবং আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে স্পষ্ট ভাষায় বলুন যে সংখ্যালঘু নির্যাতন সহ্য করা হবে না।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, নীচে আমরা কিছু সুপারিশ পেশ করছি। আমাদের বিশ্বাস আপনি এগুলো বাস্তবায়ন করলে সংখ্যালঘু নির্যাতন বন্ধ হয়ে যাবে।
সুপারিশসমূহ:
(১) ১৯৭২ সালের সংবিধান পুনর্বহাল করে দেশের সকল নাগরিকের সম-অধিকার প্রতিষ্ঠা করুন।
(২) হেইট স্পীচ্ ও ক্রাইম আইন পাশ করে সংখ্যালঘু নির্যাতকদের ওই আইনে বিচার করে শাস্তি দিন।
(৩) একটি বিচার বিভাগীয় কমিশন গঠন করে, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে এ’ পর্যন্ত সংঘটিত সকল সংখ্যালঘু নির্যাতনের শ্বেতপত্র তৈরি করে প্রকাশ করুন, এবং অবিলম্বে বিশেষ ট্রাইব্যুনালে জজ সাহাবুদ্দীন কমিশন রিপোর্টে চিহ্নিত সংখ্যালঘু নির্যাতকদের বিচার করে শাস্তি প্রদানের কাজ শুরু করুন।
(৪) একটি সংখ্যালঘু কমিশন ও সংখ্যালঘু মন্ত্রনালয় গঠন করুন, এবং একটি সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন পাশ করুন।
(৫) ইসলামিক ফাউন্ডেশনের আদলে হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃস্টান ফাউন্ডেশন গঠন করুন।
(৬) নির্যাতনের শিকার সকল সংখ্যালঘু মানুষকে পুনর্বাসনের ব্যস্থা করুন এবং ক্ষতিপূরণ প্রদান করুন।
(৭) অর্পিত সম্পিত্তি প্রত্যার্পণ প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে ব্যবস্থা গ্রহন করুন।
(৮) পার্বত্য শান্তিচুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়নে করুন।
(৯) ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের মিথ্যা অজুহাতে শাল্লার ঝুমন দাস সহ আটক নিরপরাধ সকল সংখ্যালঘু তরুণ-তরুণী এবং এই “অপরাধে” শাস্তিপ্রাপ্তদের অবিলম্বে মুক্তি দিন।
পরিশেষে আমরা আপনার সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘ কর্মময় জীবন কামনা করি।
ইতি।
বিনীত
অধ্যাপক নবেন্দু দত্ত, সভাপতি, ড. টমাস দুলু রায়, সভাপতি, ও রণবীর বড়ুয়া, সভাপতি
ড: দ্বিজেন ভট্টাচার্য্য, সাধারণ সম্পাদক; বিষ্ণু গোপ, যুগ্ন সাধারণ সম্পাদক
শিতাংশু গুহ, সিনিওর পলিসি এনালিস্ট; চন্দন সেনগুপ্ত, ডিরেক্টর; ড: জিতেন রায়, ডিরেক্টর
রূপকুমার ভৌমিক, ডিরেক্টর ; সুশিল সাহা, ডিরেক্টর
মতিলাল দেবরায়, ডিরেক্টর; প্রদীপ মালাকার, ডিরেক্টর; রীণা সাহা, ডিরেক্টর.