রাখাইনের রোহিঙ্গাদের রক্ষায় ব্যবস্থা নিতে মিয়ানমারকে আন্তর্জাতিক আদালতের নির্দেশ
রাখাইনে থাকা রোহিঙ্গাদের সুরক্ষায় মিয়ানমারের প্রতি অন্তবর্তী আদেশ দিয়েছে আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে)। আদেশে আদালত স্পষ্ট করেই বলেছে, নির্যাতিত ওই জনগোষ্ঠির নিরাপত্তাসহ সার্বিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে এখনই মিয়ানমার রাষ্ট্রকে পদক্ষেপ নিতে হবে। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী কিংবা অন্য যে কোন নিরাপত্তা বাহিনী যেনো আর রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে কোনো গণহত্যায় না জড়ায়, উস্কানি না দেয় কিংবা নির্যাতন না করে সে ব্যাপারেও ব্যবস্থা নিতে হবে মিয়ানমারকে। অতীতে রোহিঙ্গা নির্যাতনে জড়িত মিয়ানমারের সেনা বাহিনীর (দোষী) সদস্যদেরকে অবশ্যই বিচারের আওতায় আনতে হবে। মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গাম্বিয়ার দায়ের করা মামলায় আন্তর্জাতিক বিচার আদালত-আইসিজে বৃহস্পতিবার এ আদেশ দেন। হেগের স্থানীয় সময় সকাল ১০টায় (বাংলাদেশ সময় বিকেল ৩টা) সর্বসম্মত ওই রায় পড়া শুরু করেন আদালতের প্রেসিডেন্ট আব্দুল কাওয়াই আহমেদ ইউসুফ। আদালত বলেন, এ রায় মানতে মিয়ানমার বাধ্য। আদেশে বলা হয়Ñ অন্তবর্তীকালীন নির্দেশনা বাস্তবায়নের ব্যাপারে চার মাসের মধ্যে রিপোর্ট দাখিল করতে হবে মিয়ানমারকে।চূড়ান্ত রায় না দেয়া পর্যন্ত ছয় মাস অন্তর অন্তর রিপোর্ট দিতে হবে দেশটিকে।
দৃশ্যত গত মাসে আদালতে দেয়া মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলর অং সান সুচির বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে আদেশে। সুচি মামলাটি স্থগিতের পক্ষে আদালতে আবেদন এবং পাল্টা যুক্তি দিয়েছিলেন। কিন্তু আদালত সেটি খারিজ করে দিয়ে বলেছেন, গাম্বিয়ার পূর্ণ অধিকার আছে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করার। বিচারক বলেছেন, রোহিঙ্গা গণহত্যার দায় কোনভাবেই এড়াতে পারে না মিয়ানমার। মামলায় মিয়নমার যথাযথ সহযোগিতা করেনি বলেও অভিযোগ করেছেন আদালত। এই মামলা নিয়ে মিয়ানমারের আপত্তি খারিজ করে বিচারক খোলাসা করে বলেন, এখনও মিয়ানমারে থাকা আনুমানিক ৬ লাখ রোহিঙ্গা সামরিক বাহিনীর হাতে ‘চরম মাত্রায় সহিংসতার’ ঝুঁকিতে আছে। তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। প্রাথমিকভাবে গাম্বিয়ার অভিযোগের প্রমাণ পেলেও আদালত বলেছেন, অন্তবর্তীকালীন আদেশ চূড়ান্ত রায়কে প্রভাবিত করবে না। ২০১৭ সালের আগস্টে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর বর্বর হামলা চালায় মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। নির্বিচারে রোহিঙ্গাদের হত্যা, ধর্ষণ করা হয়। অগ্নিসংযোগ করা হয় তাদের বাড়িতে। আক্রমণের মুখে প্রায় সাতে সাত লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। এই নৃশংসতাকে গণহত্যা আখ্যা দিয়ে গত বছরের ১১ নভেম্বর আইসিজিতে মামলা দায়ের করে গাম্বিয়া। নেদারল্যান্সসের দ্য হেগের পিস প্যালেসে গত বছরের ১০ থেকে ১২ ডিসেম্বর মামলার শুনানি চলে। মামলায় গাম্বিয়ার প্রতিনিধিত্ব করেন দেশটির বিচারমন্ত্রী আবু বাকার তাম্বাদু। মিয়ানমারের নেতৃত্ব দেন অং সান সুচি।
রায়ের বিস্তারিত: মিয়ানমারের প্রতি মোটাদাগে চারটি অন্তবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন আদালত। প্রথমত: মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এবং অন্যান্য সশস্ত্রবাহিনীগুলোকে সব ধরনের গণহত্যার অপরাধ ও গণহত্যার ষড়যন্ত্র থেকে বিরত থাকতে হবে। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে সব ধরনের সুরক্ষা দেয়ার বাধ্যবাধকতা পূরণ করতে হবে মিয়ানমারকে। গণহত্যা সনদের ধারা-২ এর আওতায় আদালত এ নির্দেশনা দেন, যা আদালতের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সদস্যদের হত্যা, নিপীড়ন, বাস্তুচ্যুতির মতো পদক্ষেপ গ্রহণ থেকে বিরত রাখতে যে যে পদক্ষেপ নেয়া জরুরি তার সবটুকুই নিতে হবে মিয়ানমার রাষ্ট্র ও সরকারকে। সর্বপরি রোহিঙ্গাদের সুরক্ষায় সুনির্দিষ্ট অন্তবর্তী ব্যবস্থা নিতে হবে। আদালত বলেন, গণহত্যা সনদের ধারা-৪১ এর আওতায় অন্তবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণের আদেশের শর্তসমূহ বিরাজ করছে বলে আদালত মনে করেন। গাম্বিয়ার দায়ের অন্তবর্তী ব্যবস্থা সংক্রান্ত আদেশের আবেদনের প্রথম তিনটির রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সুরক্ষা সম্পর্কিত এবং তা আমলযোগ্য বলে মনে করেন আদালত। জাতিসংঘ তথ্যানুসন্ধানী দলের উপসংহার, যা জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে অনুমোদিত হয়েছে তাতে মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সহিংসতায় গণহত্যার উদ্দেশ্য ছিল বলে যা বলা হয়েছে সেটি আদালতের নজরে এসেছে। গণহত্যা সনদের ধারা-২ মতে রোহিঙ্গারা একটি বিশেষ সুরক্ষার অধিকারী গোষ্ঠী হিসেবে বিবেচ্য উল্লেখ করে আদালত বলেন, জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের প্রতিবেদনে যেসব বিবরণ উঠে এসেছে তার আলোকে গাম্বিয়া মিয়ানমারকে যে নোট ভারবাল বা কূটনৈতিক পত্র দিয়েছিল তা বিরোধের ভিত্তি হিসেবে গ্রহণযোগ্য বলে মনে করা যথেষ্ট।