#বিলেতে কমলগঞ্জের শতজন #
মুক্তিযোদ্ধা এম এ রহিম : মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে মহিমান্বিত করেছেন যিনি
আর দশজন মানুষের মতো তিনিও একজন মানুষ,তারপরও তিনি অন্যদের চেয়ে অনন্য ; আলাদা এবং ব্যতিক্রমী। দেশ মাতৃকার প্রতি অসীম মমত্ববোধ,শোষণ বঞ্চনার বিরুদ্ধে তাঁর প্রতিবাদী সোচ্চার কন্ঠ এবং অধিকার আদায়ের প্রশ্নে আপোষহীন অবিচলতা তাঁকে দিয়েছে পুরোপুরি স্বাতন্ত্র। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদানকে ইতিহাস পরম মমতায় ধারণ করে আছে।
এইসব কথামালা যাঁকে নিয়ে উচ্চারিত ,তিনি এক আলোকিত ব্যক্তিত্ব -নাম আব্দুর রহিম অন্য নাম দুধ মিয়া। বৃহত্তর সিলেটের মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলাধীন শমশেরনগরের তিনি এক কৃতি পুরুষ। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সমৃদ্ধ ইতিহাসের সাথে জড়িয়ে আছে এম এ রহিমের নাম। দীর্ঘদিন এই মানুষটি বিলেত প্রবাসী। যাপিত জীবন প্রবাসে হলেও তাঁর মন ও প্রাণ অহর্নিশ ছুটে বেড়ায় বাংলাদেশে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ‘অগ্নিগর্ভা শমসেরনগর ’ এর সংগ্রামী উপাখ্যান এক স্বর্ণোজ্বল অধ্যায় হিসাবে বিবেচিত। স্বাধীনতার কাঙ্খিত রক্ত সূর্যকে ছিনিয়ে আনতে মরিয়া হয়ে উঠা এই জনপদের মানুষ এক বৃহৎ সংহতি গড়ে তুলে মহান মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নের আগে থেকেই। স্বাধীনতাকামী জনগোষ্ঠীকে এ জন্যে কম মূল্যও দিতে হয়নি। বার বার রক্তাক্ত হয়েছে এই জনপদ। স্বাধীনতার বেদীমূলে হাসিমুখে জীবন উৎসর্গ করেছেন উত্তাল শমসেরনগরের জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে অগণিত আবাল বৃদ্ধবনিতা। মুক্তোকণিকার মতো এঁদের ত্যাগের মহিমায় আজও ঝলমল করছে শমসেরনগর তথা কমলগঞ্জ উপজেলার প্রতিটি ধূলিকণা।ইতিহাসের পাতায় পাতায় সেই গৌরবগাঁথা পরম যত্নে বিধৃত থাকার কথা হলেও প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের কাছে সেই গর্বিত ইতিহাস এবং ইতিহাসের সাথে সম্পৃক্ত বীর পুরুষদের কীর্তিগাঁথার অনেক তথ্যই থেকে যাচ্ছে অজানা। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির নিরন্তর হীন প্রচেষ্টার স্রোতে হারিয়ে যেতে বসেছে সব কিছু। হাইব্রিড দেশপ্রেমিক আর কথিত মুক্তিযুদ্ধাদের ভীড়ে প্রকৃত মুক্তিযুদ্ধারা আজ নিষ্প্রভ। বিক্ষত হচ্ছে কালজয়ী সব ইতিহাস আর এই ইতিহাসের সাথে সম্পৃক্ত অনেক সূর্য-সন্তানদের অসীম সাহস ও বীরত্বের গল্পও চাপা পড়ে যাচ্ছে বিস্তৃতির অতলে।
এম এ রহিম সেইসব সূর্য সন্তানদের অন্যতম। কৈশোর -যৌবনে কমলগঞ্জের কাদা-জল ,মনোমুগ্ধকর চাবাগানের সবুজ শোভার ছায়া-মায়া ও স্রোতস্বিনী ধলাই ,লাঘাটার কলধ্বনি শুনে বেড়ে উঠা মরহুম মোহাম্মদ খলিলুর রহমানের পুত্র এম এ রহিমের জন্ম শমসেরনগরে ১৯৫২ সালের ডিসেম্বরে। শমশেরনগরের রামচিজ রাম প্রাইমারী স্কুল ,শমসেরনগর এ এ টি এম বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয় ,হবিগঞ্জ বৃন্দাবন কলেজ এবং সর্বশেষ মৌলভীবাজার সরকারী কলেজে অধ্যয়ন করেন তিনি। ছাত্রাবস্থায়ই এম এ রহিম প্রগতিশীল ছাত্র সংঠন ছাত্র ইউনিয়নের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন।
মহান মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নেই এম এ রহিম অসীম সাহসী একটি ঘটনার মাধ্যমে শমসেরনগর তথা মৌলভীবাজারের আপামর জনগনের হৃদয়ের মনিকোঠায় নিজের অবস্থানটি পোক্ত করে নেন।
সে এক গা ছমছম করে উঠার মতো বিরল ঘটনা। ১৯৭১ সালের ৫ ই মার্চ বিক্ষুব্ধ ছাত্র জনতার একটি মিছিল শমশেরনগরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ শেষে চৌমুহনীতে অবস্থান নেয়। কাছেই পুলিশ ফাঁড়ি। অসীম সাহসী এম এ রহিম ,নারায়ন চন্দ্র দেবনাথ ,সৈয়দ নাজমুল ইসলাম লুকু এবং সৈয়দ জসিম উদ্দিন অকস্মাৎ ফাঁড়ির চৌহদ্দিতে প্রবেশ করে পাকিস্তানী পতাকা নামিয়ে এনে আগুনে পুড়িয়ে দেন এবং সেখানে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। সংগ্রামী জনতার বিপুল সমাবেশের কারনে পুলিশ কোন বাঁধা দেয়নি। এই বিরল ঘটনা মুহূর্তে গোটা পাকিস্তানে সংবাদ শিরোনাম হয়,চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয় সর্বত্র। ৬ই মার্চ এম এ রহিম ও নারায়ণকে পুলিশ গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে যায়। খবরটি জানাজানি হলে উত্তাল হয়ে উঠে শমসেরনগর তথা গোটা কমলগঞ্জ। বিস্ফোরোন্মুখ পরিস্থিতি মোকাবেলায় তাৎক্ষণিকভাবে তাঁদের স্থানান্তর করা হয় মৌলভীবাজার থানা হাজতে,অতঃপর জিজ্ঞাসাবাদ শেষে প্রেরণ করা হয় জেল হাজতে। এতে পরিস্থিতি আরও ঘুলাটে হয় উত্তাল হয়ে উঠে সমগ্র মৌলভীবাজার।
প্রতিদিনই বিক্ষোভ সমাবেশ চলতে থাকে সর্বত্র। ঘেরাও করা হয় মৌলভীবাজার মহকুমা হাকিমের কার্যালয়। হাজার হাজার বিক্ষুব্ধ মারমূখী জনতা এতে যোগ দেন। তাঁদের মুক্তির দাবিতে উচ্চারিত হতে থাকে গগন বিদারী শ্লোগান। পাঞ্জাবী অফিসার নাসিম ওয়াকার ছিলেন সে সময় মৌলভীবাজারের এস ডি ও। জনতা এ দু’জনকে মুক্তি না দিলে ঘেরাও প্রত্যাহার করবে না এমন অঙ্গীকার ঘোষণা করলে অনেকটা চাপে পড়েই নাসিম ওয়াকার তাঁদের মুক্তি দেওয়া হবে বলে ঘোষণা দিতে বাধ্য হন। ১৩ই মার্চ রহিম ও নারায়ন কে মুক্তি দেওয়া হলে ১৪ই মার্চ মুক্তিপ্রাপ্ত দুই ছাত্র নেতাকে নিয়ে শমশেরনগরে লাঠি মিছিল ও জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। তখন থেকে প্রতিদিনই মিছিল ও সমাবেশে মুখরিত হয়ে উঠে কমলগঞ্জের শমসেরনগর। স্মরণযোগ্য যে ,আমাদের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের সশস্ত্র যুদ্ধের প্রথম সূত্রপাত হয় এই শমসেরনগরেই আর এর নেপথ্য নায়ক ছিলেন জনাব এম এ রহিম ।
পাকিস্তান সরকার শমসেরনগর পুলিশফাঁড়িতে পাকিস্তানী পতাকা নামিয়ে পুড়িয়ে ফেলার ঘটনাটি মোটেই ভুলে যায়নি। ২৫সে মার্চ গণহত্যা শুরু হলে শমসেরনগর আরও বেশি তেঁতে উঠে। ২৭মার্চ হাজার হাজার মুক্তিকামী মানুষ বের করে লাঠি মিছিল। খবর পেয়ে ক্যাপ্টেন গোলাম রসূলের নেতৃত্বে এক প্লাটুন সৈন্য এসে বিক্ষুব্ধ জনতার উপর গুলি বর্ষণ করে ঘটনা স্থলেই নিহত হন সিরাজুল ইসলাম নামে এক বিক্ষোভকারী। স্বাধীনতার ঊষালগ্নে শমশেরনগরের সিরাজুল ইসলাম হচ্ছেন প্রথম কমলগঞ্জ থানার শহীদ মুক্তিযোদ্ধা যিনি দেশমাতৃকার জন্য জীবন উৎসর্গ করেন। ২৮শে মার্চ ১০হাজার বিক্ষুব্ধ জনতার সমাবেশ ঘটে শমশেরনগরে। বিভিন্ন সীমান্ত ফাঁড়ি থেকে ইপিআর এবং আনসার বাহিনীর সদস্যরাও এসেও জনতার প্রতিরোধে শরিক হন। ঐদিন বিকেল চারটায় আবারও ক্যাপ্টেন গোলাম রসূলের নেতৃত্বে একদল পাকসেনা কমলগঞ্জ থেকে এসে সমাবেশে হামলা চালানোর প্রস্তুতি নেয়। পথিমধ্যে মুক্তিযোদ্ধারা এম্বুশ স্থাপন করলে সেনাদের গাড়ির বহরটিকে সেই ফাঁদে ফেলে ক্যাপ্টেন গোলাম রসূলসহ বারজন পাক সেনা হত্যার মাধ্যমে সিরাজুল ইসলাম হত্যার প্রতিশোধ নেওয়া হয়।
হানাদার বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারা এ ঘটনায় ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে এবং প্রতিশোধ নিতে ২৯শে মার্চ শমশেরনগরে জঙ্গি বিমান দিয়ে ব্যাপক শেল বর্ষণ করে প্রচুর বেসামরিক মানুষকে হত্যা করা হয়। পরবর্তীতে এই জনপদের কর্তৃত্ব নিয়ে নির্বিচারে হত্যা ,নির্যাতন ,ধর্ষণ আর অগ্নি সংযোগ করে ধ্বংসলীলা অব্যাহত রাখে। পুরো নয় মাস ধরে চলে এই বর্বরতা আর এই বর্বরতার এখনো সাক্ষী হয়ে আছে শমসেরনগর বিমানবন্দরের বধ্যভূমি।
উল্লেখ্য যে ,দেশমাতৃকার শৃংখল মোচনের ব্রত নিয়ে এম এ রহিম সহ শমশেরনগরের অগণিত তরুণ -যুবা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহনকালীন ৪ নভেম্বর মৌলভীবাজার ৪নং সামরিক আদালতে রহিম ও নারায়ণকে হাজিরার নির্দেশ দিয়ে এক বিজ্ঞপ্তি জারী করা হয়। যুদ্ধে মগ্ন রহিম হাজিরা না দেওয়ায় পাক বাহিনী তাঁর পিতা হাজী খলিলুর রহমানকে চাতলাপুর রোডস্থ উনার বাস ভবন থেকে ধরে নিয়ে যায়। সাত দিন ধরে আর্মি ক্যাম্পে উনার উপর অমানুষিক নির্যাতন করে অর্ধমৃত অবস্থায় ছেড়ে দেওয়া হয়।
এম এ রহিম মুক্তিযুদ্ধের নয়টি মাস অসীম বীরত্বের সাথে ৪ নং ইকো সেক্টর ,কৈলাশহর সাব-সেক্টর ,কমলপুর সাব সেক্টর ও মাছিমপুর হেড কোয়ার্টারের অধীনে বীরের মতো লড়াই করে দেশ মাতৃকার শৃঙ্খলামোচনে অভাবনীয় অবদান রাখেন। মাত্র আটার বছর বয়সী তরুণ এম এ রহিমের মুক্তিযুদ্ধের কাহিনী স্বল্পপরিসরে বর্ননা করা অসম্ভব।
১৯৭৩ সালের নির্বাচন পূর্বকালীন সময়ে জনাব রহিম বঙ্গবন্ধুর আদর্শে উদ্বোদ্ধ হয়ে বাংলাদেশ ছাত্রলীগে যোগদান করেন পরবর্তীতে একই ধারায় বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের সাথে সম্পৃক্ত হন।
এম এ রহিম স্বাধীন বাংলাদেশে নিজেকে দেশপ্রেমের চেতনা ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শে সোনার বাংলা গড়ে তুলার ব্রত নিয়েছিলেন। নানা প্রতিকূল পরিবেশ এবং বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যা এই ব্রত পালনে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। কিছুদিন পিতার ব্যবসার সাথে জড়িত ছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর একপর্যায়ে ১৯৮৪ সালে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য ইংল্যান্ডে ফাঁড়ি জমান। একপুত্র ও চার কন্যা সন্তানের জনক এম এ রহিম দীর্ঘ তিন দশকেরও বেশি সময়কাল ধরে ইংল্যান্ডে বসবাস করছেন।
নিজের ব্যবসাপাতি দেখাশুনার ব্যস্ততা সত্ত্বেও তিনি বাংলাদেশের যে কোন সঙ্কটে ও দুঃসময়ে মানবিক হাত প্রসারিত করতে ভুল করেন না। জড়িত আছেন বিভিন্ন সামাজিক ,সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সাথে। বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ যুক্তরাজ্য ইউনিট কমান্ডের সাথে তিনি প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই জড়িত। বর্তমানে সংগঠনটির সদস্য সচিবের দায়িত্ব পালন করছেন।
যুক্তরাজ্যে ত্রিধা বিভক্ত কমলগঞ্জীদের তিনটি সংগঠনের সাথেই জড়িত আছেন ,তিনি প্রাচীনতম সংগঠন কমলগঞ্জ সমিতির সহসভাপতি ,কমলগঞ্জ ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশনের উপদেষ্ঠা ও যুক্তরাজ্যস্থ শমসেরনগর ওয়েলফেয়ার ট্রাষ্ট এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন।
২০০৯ সালে লন্ডনের ক্যামডেন বারা কাউন্সিল মুক্তিযুদ্ধের কমান্ডার হিসাবে তাকে সংবর্ধিত করে। ২০০৩সালে শমসেরনগর প্রশিকা মানবিক উন্নয়ন সংস্থা,২০০৯সালে কমলগঞ্জ উপজেলা পরিষদ ও ২০১৭সালে কমলগঞ্জ প্রেসক্লাব কর্তৃক মুক্তিযুদ্ধের অকুতোভয় সমর সৈনিক এম এ রহিম সংবর্ধিত হন।বর্তমানে এম এ রহিম তাঁর স্নেহময়ী মাতা মরহুমা সমরুন্নেছা চৌধুরীর নামে একটি ইসলামী বিষয়ক ট্রাষ্ট করার উদ্যোগ নিচ্ছেন। ব্যক্তি জীবনে তিনি অত্যন্ত বিনয়ী ,পরোপকারী ও ধার্মিক।
অসীম সাহসিকতা ,ঈর্ষণীয় বীরত্ব ও দেশ মাতৃকার প্রতি দায়বদ্ধতার অঙ্গীকার নিয়ে একাত্তরে মরণপণ লড়াই করে যে সব সূর্য সন্তান আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে সমৃদ্ধ ও মহিমান্বিত করেছেন ,এম এ রহিম তাঁদের পুরোভাগের একজন হলেও এই প্রচারবিমুখ মানুষটি এখনও রয়ে গেছেন পাদপ্রদীপের অন্ধকারে। স্বাধীনতার ছয়চল্লিশ বছর পরেও তাঁর এই কীর্তিগাঁথার মূল্যায়ন হয়নি বাংলাদেশে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির ধারায় আজ আসল ও নকল একই পাত্রে একাকার। কিছুতেই ছেঁকে আলাদা করা যাচ্ছে না,কোনটা আসল আর কোনটা নকল। কবে আসল তার মূল অবয়ব নিয়ে উদ্ভাসিত হবে ,এম এ রহিমরা কবে হবেন সত্যিকার অর্থে মূল্যায়িত -এটা দেখার জন্য হয়তো আরও অনেক কাল অপেক্ষা করতে হবে আমাদের।