পূর্ব প্রকাশের পর… ধা রা বা হি ক
যুদ্ধের স্মৃতি কথা ৭ | সুশীল কুমার পোদ্দার
সময় আপন গতিতে এগিয়ে চলে। বাবা আসাম থেকে নিজের আপনজনদের কাছে যাবার জন্যে চেষ্টা করে যান। খুঁজে খুঁজে নিজের আত্মীয় স্বজনের কাছে চিঠি লেখেন। কিন্তু চিঠির কোন উত্তর আসেনা। আর আসবেই বা কেন ? অনিশ্চয়তায় মাঝে এতো বড় একটা সংসারের দায়িত্ব কেবা নিতে চায়। যখন স্বচ্ছল আত্মীয় স্বজনেরা মুখ ফিরিয়ে নেয় তখন একদিন আমাদের এক দরিদ্র আত্মীয়ের কাছ থেকে চিঠি আসে। চিঠি পড়ে বাবা আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন। ঘর ছোট তাতে কি আমরা একসাথে জড়িয়ে থাকবো, প্রয়োজনে দুমুঠো ভাত ভাগ করে খাবো। বাবা চিঠি পড়েন আর মার চোখ জলে ভেসে যায়। এবার প্রস্তুতির পালা। আমাদের গন্তব্য পশ্চিমবঙ্গের গঙ্গারামপুর।
এ পাহাড়, এ মাটি, এ জনপদ ছেড়ে যেতে আমার বড় কষ্ট হয়। চারিদিকে সবুজের সমারোহ। তার মাঝে সরু রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে আমাদের বাস। অনেক চড়াই উৎরাই অতিক্রম করে বাস এসে থামলো বিরাট এক স্রোতস্বিনী নদী তীরে। ভয়ঙ্কর উথাল পাতাল ঢেউ। ঢেউ গুলো গর্জন করে ভেঙ্গে পড়ছে । সেই তরঙ্গের মাঝে ফেরীর পিঠে চড়ে বসেছে আমাদের বাস। তরঙ্গের পর তরঙ্গ আঁছড়িয়ে পড়ছে ফেরীর গায়ে। আমরা ভিজে নেয়ে একাকার। পরে শুনেছি এ জনপদের নাম ধুবরী । আর উন্মত্ত নদের নাম ব্রহ্মপুত্র। আবারো চলা। চলতে চলতে কতো নাম না জানা জনপদ পেড়িয়ে আমরা পৌঁছলেম গঙ্গারামপুর । আমাদের দরিদ্র আত্মীয় আমাদের এগিয়ে নিতে এসেছেন। তিনি মা বাবাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েন।
দরিদ্রের পর্ণ কুটির। একখানা ঘর। তারি গা ঘেঁষে চালা দিয়ে, বাঁশের বেড়া দিয়ে বানানো হলো আমাদের অস্থায়ী নিবাস। ছোট্ট বাসা। মানুষজনে গিজ গিজ করে তাই সকালের আলো ফোটার সাথে সাথে বেড় হয়ে যাই মিশনারিদের নোঙর খানায়, ওখানে শিশু কিশোরদের সকালের খাবার দেয়। একটা মাঠের মধ্যে নেট দিয়ে ঘেরা একটা জায়গা। আমরা শতশত ছেলেমেয়ে বসে থাকি কখন খাবার দেবে তার প্রতীক্ষায় । বিরাট এক ডেস্কির মধ্যে কখনো সুজি কখনো খিচুরি রান্না হয়। সেই সুজির উপর খিচুরির উপর চকলেটের মতো এক জাতীয় গুড়ো ছিটিয়ে দেয়। আমরা পরম তৃপ্তিতে সে খাবার চেটে পুটে খেয়ে নেই। সীমানার বাইরে ভিড় করে তাকিয়ে থাকে অসংখ্য নিরন্ন মানুষ।
ম্যানকার চরের চেয়ে এখানে সাহায্যের পরিমাণ অনেক কম। বাবা সংসার চালাতে যেয়ে হিমসিম খেয়ে যান। অদূরে পূর্ণভাওয়া নদী। সে নদীতীরে দূরদূরান্ত থেকে শাল কাঠের লাকড়ি নিয়ে নৌকো আসে। সেই লাকড়ি ঘিরে গড়ে উঠেছে ছোট খাট একটা ব্যস্ত জনপদ। বাবা সিদ্ধান্ত নিলেন তিনিও কাঁটাবনের হাট থেকে শাল কাঠ নিয়ে আসবেন। বাবা নৌকা ভর্তি করে লাকড়ি নিয়ে আসেন। নদীতীরে থরে থরে সাজানো লাকড়ির পাহাড়। আমি সেই পাহাড়ের উপর বসে থেকে পাহারা দেই। দাদা চলে গেছেন দূরবর্তী এক গ্রামে এক দুরসম্পকীয় মামার বাড়িতে। ওখানে থেকে যদি ছাত্র পড়িয়ে কিছু উপার্জন করা যায়। দিদি একটা প্রেসে কম্পোজের কাজ শেখেন, অবসরে সুচের কাজ। সবাই চেষ্টা করছে ঘুরে দাঁড়ানোর । কিন্তু পরদেশে সব কিছু সহজ হয় না। লাকড়ির ব্যবসা লাভের মুখ দেখতে পারে না। রাতের অন্ধকারে ক্রমাগত চুরি হয়ে যায় লাকড়ি গুলো। বাবা হতাশ হোয়ে অন্য পথ খুঁজেন।
ছোড়দাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় একই গ্রামে যেখানে দাদা টিউশনি করেন। গ্রামটার বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে সাউতাল জনপদ। সেখানে তখনো পণ্য বিনিময় প্রথা বিদ্যমান। ছোড়দা এক মেসতো ভাইয়ের সাথে নেমে পড়েন এমনি এক পণ্য বিনিময় ব্যবসায়। মাথায় করে বিরাট এক ঝাঁকার মধ্যে ঝুরি, জিলাপি, বুন্দি, গজা নিয়ে চলে যায় সাউতাল পল্লীতে। মিষ্টি নেবেন মিষ্টি, হরেক রকম মিষ্টি। সাউতাল গৃহ বধূরা ছুটে আসে। মিষ্টির বিনিমেয়ে ঢ়ের ধান দিয়ে দেয়। দাদা ঝাঁকা ভর্তি ধান নিয়ে হাসি মুখে ঘরে ফেরেন। সে ধান জমা হয় এক গোলার মধ্যে। কিন্তু গোলা কখনো পূর্ণ হয় না। সে ধান খেয়ে ফেলে অদৃশ্য কিছু ইঁদুরে। এমনি করে এক কঠিন সময়ের মধ্যে বাবা দাদা যখন জীবন যুদ্ধ করে যাচ্ছেন আমি তখন ঘুরে বেড়াই উদ্দেশ্যহীন ভাবে। স্থানীয় আমার বয়সী ছেলেরা হৈ হৈ করে ফুটবল খেলে। আমি অদূরে দাড়িয়ে থেকে দেখি । ওরা বিরক্ত হয়। সুযোগ পেলেই সমস্বরে বিদ্রূপ করে – জয় বাংলার লোক, ঢেলা ঢেলা চোখ, রিলিফের চাল খেয়ে হোল বড়লোক…
চলবে…
যুদ্ধের স্মৃতি কথা ৭ | সুশীল কুমার পোদ্দার , ওয়াটারলু, কানাডা নিবাসী । ফলিত পদার্থ বিদ্যা ও ইলেকট্রনিক্স, মাস্টার্স, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় , বাংলাদেশ ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স, ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, পি, এইচ, ডি, ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। সিস্টেম ডিজাইন ইঞ্জিনিয়ারিং, ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স, ওয়াটারলু, বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডা ।।
এস এস/সিএ
দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com
সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন