মুক্তিযুদ্ধ

১৯৭১ শৈশবের চোখে মুক্তিযুদ্ধ |||| সদেরা সুজন || পর্ব ১

শৈশবের চোখে মুক্তিযুদ্ধ

১৯৭১ শৈশবের চোখে মুক্তিযুদ্ধ |||| সদেরা সুজন || পর্ব ১

১৯৭১ সালে বয়স কত-ই-বা হবে। সাত কিংবা আট। বলতে গেলে শৈশবের চঞ্চলতা নিয়ে বিহঙ্গের মতো চষে বেড়াতাম গ্রামের এ বাড়ি থেকে ও বাড়ি। স্কুল, লেখাপড়া, খেলাধুলা, দুরন্তপনা আর গ্রামের অন্যান্য সমবয়সী শিশুদের সঙ্গে ছোটখাটো মারামারি হানাহানি করেই যাচ্ছিল সময়। বাঁদর আর সাপ নাচ দেখার জন্য গোপাল নগরের ওপর দিয়ে যাওয়া জেলা বোর্ডের রাস্তার ওপর দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতাম খাওয়া-নাওয়া ভুলে। সাইকেলের পুরোনো টায়ার দিয়ে রিং চালাতাম, কখনো বাঁশ দিয়ে গাড়ি বানিয়ে চালাতাম কিংবা সুপারি গাছের ঝরে পড়া ডাল দিয়ে একজন অন্যজনকে টেনে নিয়ে যেতাম। আবার কখনো সাপুড়ের সাপের খেলা, কখনো বাঁদর নাচ দেখে বাড়িতে ফিরতাম।

ইউনিয়ন পরিষদের কর্ম চারি আলী চাচা কেরোসিনের টিন কিংবা কাঁসার কিছুতে শব্দ করে বাজাত আর বলতেন, ‘খবর আছে খবর’। ইউনিয়ন পরিষদের কোনো নোটিশ কিংবা জরুরি কোনো ঘোষণা এভাবেই জানাতেন আর আমরা শিশুরা তার পেছনে পেছনে এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে চলে যেতাম। তখন মফস্বলে মাইক ছিল না। ছিল এক ধরনের চোঙ্গা যা দিয়ে চলত প্রচারাভিযান। সেই চোঙ্গা দিয়ে কোনো যাত্রাগান কিংবা ঘোড় দৌড়ের প্রচার করা হতো।

পুকুরের কোণা থেকে এঁটেল মাটি তুলে ছোট ছোট মারবেলের মতো গুলি তৈরি করে কখনো রোদে শুকিয়ে কিংবা খড় জ্বালিয়ে গুলিগুলো শক্ত করতাম। এই মাটির গুলি কিংবা রেললাইন থেকে ছোট ছোট সুন্দর সুন্দর পাথর সংগ্রহ করে গুলতি দিয়ে পাখি শিকার করতে বের হতাম। যদিও জীবনে একটি পাখির পালকও স্পর্শ করতে পারেনি আমার গুলতি থেকে ছোড়া গুলি দিয়ে। শুধু একদিন গুলতি দিয়ে আমাদের একটি ছাগলকে লক্ষ্য করে পাথর ছুড়েছিলাম। ঠিকই পাথরটা আমাদের ছাগলের চোখে লেগেছিল। ছাগলটিকে টেনে টেনে তিন মাইল হেঁটে পশু হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলাম। কোনো কাজ হয়নি। পশু হাসপাতালের সার্জন ছিলেন না। একজন কমপাউন্ডার বসে বসে ঘুমাচ্ছিলেন। তাকে ছাগলের বিষয়ে বলার পর একটু রাগত স্বরে বলতে গেলে একটি ছাগল বিষয়ক রচনাই বলে দিলেন আর তার সঙ্গে হাসপাতালের পিয়ন যা বলেছিল তা মনে হয় পশু ডাক্তারও এত কিছু বলতেন না। অবশ্য ছাগলকে আহত করার পুরস্কার হিসেবে বাবা আমাকে এমন মার দিয়েছিলেন যে, তিন দিন জ্বরে অসুস্থ হয়ে বিছানায় ছিলাম।

প্রজাপতি আর ফড়িং ধরা ছিল আমার অভ্যাস। ফড়িংয়ের লেজে সুতা বেঁধে ওড়াতাম। আজ সেসব কথা মনে হলে ফড়িংয়ের জন্য কষ্ট হয়। আর এখন প্রবাসে মালিকেরা বলতে গেলে দড়ি বেঁধে আমাদের কাজ করাচ্ছেন। তখন আমাদের বাড়ির দুদিকে কোনো বাড়িঘর ছিল না। ছিল দিগন্ত প্লাবিত বিশাল এলাকা জুড়ে ধানের খেত। কী সুন্দর লাগত কখনো সবুজের পথ চলা আবার কখনো সোনালি ধানের খেতে বাতাসের ঢেউ। মধ্যে দিয়ে বয়ে গেছে কিন্নি গাঙ (ছোট নদী) আর রেললাইন। শুধু বর্ষার মৌসুমে কিন্নি গাঙে পানি থই থই করত কিন্তু শুকনো মৌসুমে পানি থাকত না। এসব ধানের জমিতে শুকনো মৌসুমে অন্য কোনো চাষ হতো না। আর এখন তিল পরিমাণ জায়গা খালি নেই। চারদিকে বড় বড় রং-বেরঙের চোখ ধাঁধানো ভবন আর রকমারি খেত হচ্ছে। ওই সময় এসব জমিতে হাজার হাজার গরু-মহিষ-ছাগল বিচরণ করত। দৃষ্টির সীমানা পর্যন্ত শুধু এসবই দেখা যেত। এসব গরু-মহিষের সঙ্গে থাকত রাখালেরা। রাখালরা কত সুন্দর সুন্দর গান গাইত আর কত রকমের খেলায় মত্ত থাকত। আমরাও রাখালদের সঙ্গে মারবেল (গুলি), ডাংগুলি, কাবাডি কিংবা ছেঁড়া কাপড় দিয়ে তৈরি বল দিয়ে খেলতাম।

স্কুল থেকে ফেরার পথে আমরা সহপাঠীরা রেলগেটে দাঁড়িয়ে থাকতাম কোনো ট্রেনের অপেক্ষায়। কখনো ঢাকা-সিলেটগামী উল্কা কিংবা মালবাহী ট্রেনের নিচে পয়সা রেখে দিতাম আর সেই পয়সার ওপর দিয়ে ট্রেনটি চলে যেত। দূরে দাঁড়িয়ে থেকে দেখতাম পয়সাটা কী করে মুহূর্তে চ্যাপ্টা হয়ে যায়। ট্রেন চলে যাওয়ার পর সেই গরম চ্যাপ্টা পয়সা নিয়ে খেলা করতাম। রেলগেটের পাশের বিশাল আমগাছ থেকে রেললাইনের পাথর ছুড়ে কাচা আম পাড়া, গাছের ওপর থেকে পাখির বাসা ভেঙে পাখির বাচ্চা নিয়ে খেলা করা, সাইকেল চালানো, আখ খেত থেকে আখ ভেঙে খাওয়া, রেমান চাচার দোকান থেকে বাবার নাম বলে বাকিতে এক আনার বিস্কুট কিংবা লজেন্স কিনে খাওয়া, পেয়ারা গাছ থেকে পেয়ারা খাওয়াসহ এ রকমের কত কিছু নিয়ে সময় যাচ্ছিল। রাজনীতির কিছুই বুঝতাম না তখন।

১৯৭১ সালের অসম্ভব কষ্ট, কান্না ও দুঃখ-বেদনার দিনগুলো মিশে আছে আমার জীবনে। সে সময়টা ছিল দুঃসহ দুর্দিনের বেদনাময় অধ্যায়। বাড়িঘর-সোনার সংসার ছেড়ে কী করে মানুষ পথবাসী হয়, কী করে ঝড়ে বিধ্বস্ত নীড়হারা পাখির মতো ঘরদোরহীন পথের মানুষ হয়ে উদ্বাস্তুর মতো আশ্রয় নিয়েছিলাম ভারতের শরণার্থী ক্যাম্পে। অচেনা অজানা ভিন্ন দেশে ভিন্ন পরিবেশে নতুন জীবন সংসার। সংক্ষেপে তুলে ধরার চেষ্টা করব যদিও অর্ধ শতাব্দীর পাশাপাশি হয়ে যাচ্ছে ফলে বয়স আর প্রবাস জীবনের কষ্ট-ক্লান্ত বিরতিহীন কাজের কারণে অনেক কিছুই স্মৃতির ভান্ডার থেকে হারিয়ে গেছে।

হঠাৎ করেই যেন চারদিকে যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব। মিছিল মিটিং, বড় বড় জলপাই রঙের গাড়ি আর দানবের মতো পাকিস্তান আর্মি দেখে ভয়ে কম্পমান সময়। বড়দের মুখ ছিল ঈশানকোণের মেঘের মতো কালো। কারও কাছে কোনো প্রশ্ন করা ছিল নিষিদ্ধ। তাঁরা নিজেরাই ছিলেন বিমর্ষ, ভয়ে ভীত। আকাশ ফাটানো মাটি কাঁপানো মহা বজ্রপাতের দীর্ঘস্থায়ী শব্দে জেট বিমানগুলো উড়ে যেত মাথার ওপর দিয়ে। শমসের নগর বিমানবন্দরে পাক বাহিনীর অসংখ্য বোমা নিক্ষেপই আমাকে জানিয়ে দিল দেশে ভয়াবহ যুদ্ধ লেগেছে। আমাদের বাড়িতে বেড়াতে এসেছিল ফেঞ্চুগঞ্জের ইন্দানগর ইন্দেশ্বর চা বাগানের মালিক পক্ষের সন্তান আমার পিসাত ভাইবোন বাপ্পাদা, শিবু, কুমকুমদি পূরবীদি। বাপ্পাদা-শিবুসহ গ্রামের ছেলেরা মিলে আমরা বাড়ির সামনে ডাংগুলি খেলছিলাম। হঠাৎ করে বিকট শব্দ করে একসঙ্গে বেশ কয়েকটি বিমান উড়ে গেল দ্রুতগতিতে মাথার ওপর দিয়ে। মুহূর্তে চোখের পলকে বিকট শব্দে একের পর এক প্রকম্পিত করে বিস্ফোরিত হয়েছিল বোমাগুলো। সঙ্গে সঙ্গে সারা গ্রামে কান্নার রোল শোনা যাচ্ছিল। সকলেই ভয়ে কাঁদা শুরু করেছিল। কারণ তখন গ্রামের অধিকাংশ বাড়ির পুরুষেরাই বাড়িতে ছিলেন না।

পরে শুনেছি, শমসেরনগর বিমানঘাঁটিতে বোমা মেরে ধ্বংস করে দিয়েছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী। বাবাসহ গ্রামের সবার মুখে শুধু ফিসফিস করে কথাবার্তা চলছিল। সর্বত্রই যেন এক অস্বাভাবিকতা বিরাজ করছিল। সন্ধ্যা হলেই গ্রামের সব পুরুষ মানুষ আমাদের বাড়িতে এসে জমা হতো। আমাদের বাড়িতে দুটি রেডিও ছিল একটি ছিল ঠিক বড় বাক্সের মতো বড়, সম্ভবত ফিলিপস কোম্পানির হবে, অন্যটি ছিল খুবই ছোট সাইজের। গ্রামের সবাই চলে আসত বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা আর আকাশবাণীর বাংলা সংবাদ শোনার জন্য। খুব নিচু শব্দে রেডিও থেকে কী যেন সংবাদ শুনত সবাই। বড় ভাই বাবুল তখন শ্রীমঙ্গল কলেজের ছাত্র ও ছাত্রলীগ নেতা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব যখন শ্রীমঙ্গলে এসেছিলেন বক্তৃতা দিতে, শ্রীমঙ্গলের ছাত্রলীগ নেতা এম এ রহিম, আবদুল মান্নান, নির্মলেন্দু দেব, মনতোষ পাল ভানুসহ আমার বড় ভাই বঙ্গবন্ধুর সফরসঙ্গী হয়ে বেশ কয়েক জায়গায় গিয়েছিলেন। বড় ভাই বাড়িতে এসে বঙ্গবন্ধুর গল্প করতেন আর আমরা ভাইবোনরা মিলে তা শুনতাম। আমাদের বাড়িতে একটি সাইকেল ছিল। সেটাতে স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়িয়ে বড় ভাই সারা ভানুগাছ বাজার ঘুরতেন।

যুদ্ধ বলতে কী জিনিস এর আগে কখনো দেখিনি। ফলে যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব আমার কাছে তখন খারাপ লাগেনি। কারণ হঠাৎই স্কুল বন্ধ হয়ে গেল। লেখাপড়া নেই, বড়দের ধমক নেই। ঘুমঘুম চোখে কবিতা মুখস্থ করতে হবে না কিংবা বাবার হাতে জালি বেতের মারও খেতে হবে না। বলতে গেলে মুক্ত ও স্বাধীন। যুদ্ধের ভয়াবহতা আর যুদ্ধে যে এত মানুষ মরে, সেটা তো জানতামই না। (চলবে)

বিঃদ্রঃ লেখাটি এর পূর্বে বাংলাদেশে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত হয়েছে

সদেরা সুজন: প্রধান নির্বাহী সিবিএনএ, কানাডা।


সর্বশেষ সংবাদ

দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com

সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

সংবাদটি শেয়ার করুন