পূর্ব প্রকাশের পর… ধা রা বা হি ক
যুদ্ধের স্মৃতি কথা ৩ | সুশীল কুমার পোদ্দার
কখনো হেঁটে কখনো দৌড়ে অজানা গন্তব্যের দিকে এগিয়ে চলেছি। পথের ক্লান্তিতে দিদিমা বার বার বসে পড়ছেন পথের মাঝে। বাবাকে জিজ্ঞেস করি আর কতো দূর। বাবা নীরব থাকেন। ক্ষণিক জিরিয়ে নিয়ে আবারো চলা। মধ্যাহ্নের সূর্য ঢলে পড়েছে। ক্লান্তি, তৃষ্ণা, ক্ষুধায় আমরা আর এগুতে পারছি না। একটা উঁচু ঢিবির পাশে আমরা সবাই বসে পড়লাম। ঢিবির উপরে একটা জীর্ণ কুটির। বেড় হোয়ে এলেন এক শীর্ণকায় দরিদ্র কৃষক। এক মুহূর্তে চির চেনা আত্মীয়ের মতো বাবাকে জড়িয়ে ধরলেন। ‘বাবু আপনারা এখানে। আমার কি সৌভাগ্য’। উনি উনার ছেলেদের ডেকে আনলেন। পরম সমাদরে নিয়ে গেলেন তাদের ক্ষুদ্র কুটিরে। বাবার চোখে জল। একশ্রেণীর মানুষ যখন সুযোগ সন্ধানী, চারিদিকে যখন অবিশ্বাস, সেখানে এখনো বিশ্বাস বেঁচে আছে। স্বল্প পরিচিত গ্রাম্য এ কৃষকের প্রতি শ্রদ্ধায় আমাদের মাথা অবনত হোয়ে এলো। ঝাঁকা ভর্তি করে আমাদের জন্য সিদ্ধ মিষ্টি আলু নিয়ে এলো উনার স্ত্রী। আমরা ভাইবোন পরম আনন্দে সেই আলু খেয়ে চললাম। ক্ষুধার পরিসমাপ্তি ঘটতেই মনে পড়লো দাদার কথা। দাদার জন্য একটা আলু বাঁচিয়ে রাখলাম। ঢিবির উপরে রাস্তার দিকে ঝুঁকে পড়া একটা আম গাছের ডালে বসে তাকিয়ে রইলেম পথের পানে ।
সেদিন অপরাহ্ণ বড় বেশী লাল। আকাশে আবীর মাখা মেঘ। হঠাৎ করে আবীর মাখা ধুলোর ভেতর থেকে বেড় হোয়ে এলেন আমার দাদা। সাড়া গাঁ কাদা মাখা। বিধ্বস্ত চেহারা, খোড়াতে খোড়াতে চলে যাচ্ছেন অন্য পথ ধরে। আমাদের চীৎকার শুনে বাবা দৌড়িয়ে এলেন। মিলন হোল পিতা পুত্রের, মা-ছেলের। আমরা সবাই দাদাকে জড়িয়ে ধরে আছি। দাদা, অঝরে কেঁদে চলছেন। মামাকে পাক সেনারা মেরে ফেলেছে, মামার পরিবার কোথায় চলে গেছে কেউ জানে না। দাদা এসব সংবাদ সংগ্রহ করেছেন গ্রামের উপকণ্ঠ থেকে। পথের মাঝে মিলিটারি দেখে, পানা পুকুরে কাদার মধ্যে লুকীয়ে থেকে জীবন বাঁচিয়েছেন। তার পর আমাদের না পেয়ে, পথে পলায়নপর মানুষগুলোকে জিজ্ঞেস করতে করতে এতো দূর এসেছেন। ইতিমধ্যে সন্ধ্যা পেড়িয়ে রাত চলে এলো। আমাদের বাড়ির উঠোনে কলাপাতায় খাবার দেওয়া হোল মোটা চালের ভাত আর মাস কলাইয়ের ডাল দিয়ে – যে স্বাদ কখনো ভোলার নয়।
খবর এলো গারোদাহ গ্রামে কোন পাক সেনা আসেনি। তাই সকাল হলেই আমরা ফিরে এলাম গ্রামে। জমিদার বাড়ী লুট হোয়ে গেছে। এক রাত্রের মধ্যে বাড়ীটি তার শ্রী হারিয়ে ফেলেছে। সবার মন ভেঙ্গে গেছে। রেডিওর কোন সংবাদ আর তেমন আশা জাগাতে পারে না। যারা লুট করেছে তাদের সাথে নিত্য দেখা হয়। ওরা ইচ্ছা মতো গাছ থেকে ডাব পেরে নিয়ে যায়, তেঁতুল গাছ কেটে জ্বালানী কাঠ বানায়। বাবা সকাল হলেই কোথায় যেন চলে যান। একটা কিছু প্রস্তুতি চলছে বুঝতে বাকী থাকে না।
ঘন ঘোর বর্ষা। আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি নামে। দিনের পর দিন একটানা ঝরে পড়ে সে বৃষ্টি। গৃহবন্ধী আমরা সারাদিন লুডু খেলে অলস সময় পার করে দেই। একদিন বৃষ্টি ধরে এলো। প্রতি রাতের মতো আমরা ঘুমিয়ে পড়েছি। রাত্রির দ্বিপ্রহরে আমাদেরকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলা হোল। আমাদের হাতে, কাঁধে মাথায় আবার সেই পুটুলি। প্রায়ান্ধকার বাইরের প্রকৃতি। ধান ক্ষেত, পাট ক্ষেতের মধ্য দিয়ে আমরা সন্তর্পণে হেটে চলেছি। বরদা দিদিমাকে পিঠে নিয়ে আগে আগে। ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি। পায়ের তলায় জল বাড়ছে। অদূরে নদীর জল কোথায় যেন ছলাৎ ছলাৎ করে ভেঙ্গে পড়ছে।
চলবে…
যুদ্ধের স্মৃতি কথা ৩ | সুশীল কুমার পোদ্দার , ওয়াটারলু, কানাডা নিবাসী । ফলিত পদার্থ বিদ্যা ও ইলেকট্রনিক্স, মাস্টার্স, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় , বাংলাদেশ ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স, ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, পি, এইচ, ডি, ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। সিস্টেম ডিজাইন ইঞ্জিনিয়ারিং, ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স, ওয়াটারলু, বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডা ।।
এসএস/সিএ
দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com
সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন