ফিচার্ড লেখালেখি

রথযাত্রা লোকারণ্য ।।।।  সুশীল কুমার পোদ্দার

রথযাত্রা লোকারণ্য ।।।।  সুশীল কুমার পোদ্দার

করোনাত্তর এ বিদেশের মাটিতে বিশাল এক লোকারণ্য দেখার সুযোগ এলো। টরেন্টো নগরীর  ব্যস্ততম পথ অবরুদ্ধ করে বেড় হয়েছে বিশাল এক রথ যাত্রা। হাজার হাজার মানুষ উদ্বাহু নেচে চলেছে, মুখে হরে নাম হরে কৃষ্ণ। সুবেশীত তরুণ তরুণী সেলফী তোলায় ব্যস্ত। পরপারে এক পা এগিয়ে দেওয়া কিছু মানুষ রাস্তাকে ভগবান ভেবে সাষ্টাঙ্গ প্রণতি জানায় অশ্রুসিক্ত নয়নে। স্কুল জীবনে বাক্যকে টেনে ছেঁচড়ে সম্প্রসারিত করে আবেগের তুলিতে আঁচর কেটে কতো কিছুই না লিখে ফেলতাম। আজ মনে পড়ে তেমনি এক বাক্যকে

রথযাত্রা লোকারণ্য মহা ধুমধাম                                                                            ভক্তেরা লুটায়ে পথে করিছে প্রণাম                                                                                পথ ভাবে, ‘আমি দেব’, রথ ভাবে, ‘আমি’                                                                  মূর্তি ভাবে, ‘আমি দেব’ হাসে অন্তর্যামী

মানুষের জীবনে বিশ্বাস  মনোজগতের এক বিশাল স্থান দখল করে রেখেছে। এই বিশ্বাসের ভাইরাসে প্রতিবেশী মানবতা ভুলে অন্যের ঘরে আগুন দেয়, বিশ্বাসের প্রতিমা দেয় গুড়িয়ে। চোখের সামনে দাউদাউ করে জ্বলে দুখী মানুষের ঘর । ধর্মের বিশ্বাসে সে আগুনের উত্তাপে বিচলিত হয় না এককালের প্রগতিশীল মানুষেরা। এই ধর্মীয় বিশ্বাসে আমার বড় ভয়।  ধর্মীয় বিশ্বাস কি মানুষকে অমানুষ বানিয়ে ফেলে? চোখের সামনে কতো মানুষ অমানুষ হয়ে গেল ! যাদের এক সময় মানবতাবাদী মনে হতো, জীবনের অপরাহ্ণ বেলায় তারা দিন দিন দূরে সরে যাচ্ছে। তাই আজ এই  ধর্মীয় উন্মাদনায়  আপাত: ভক্তিরসে পরিপূর্ণ ভক্তদের দিকে আমি সংশয় নিয়ে চেয়ে থাকি। এদের মধ্যে ক’জন মানুষ আর ক’জন আপন ধর্মকে শ্রেষ্ঠ ভাবা চোখে ঠুসি পড়া ধার্মিক –  এ গণনা করতে যেয়ে আমি খেই হারিয়ে ফেলি।

রথের দীর্ঘ মিছিলের পাশাপাশি আমরা হেটে চলি। অনেক মানুষের মতো আমাদের গন্তব্য অন্টারিও লেকের নীলাভ জলরাশি  ঘেরা এক দ্বীপ ভূমি। যেতে হবে ফেরিতে চড়ে। মাথার উপর গনগনে আকাশ। টিকেট কাটার দীর্ঘ লাইনে দাড়িয়ে চাপে তাপে ঘর্মাক্ত হাজারো মানুষ। চোখে পড়ে  আমাদের উপমহাদেশের আজন্ম লালিত শৃঙ্খলা ভাঙ্গার গর্বিত ঐতিহ্য। কে কার আগে ফেরীতে চড়বে তার প্রতিযোগিতা। আমাদের পাশে এ দেশে বেড়ে ওঠা কিছু  মানব সন্তান। ওরা সেই প্রতিযোগিতায় হেরে যেয়ে পিছু হটে। ওঁদের পিছু হঠে যেতে দেখে মনে হয় আমাদের জীবদ্দশায় আমরা হয়তো মানুষ হতে পারব না।

পুর দ্বীপ জুড়ে উৎসব। অসংখ্য প্যান্ডেল। কোথাও পরিবেশিত হচ্ছে ভারতীয় সংস্কৃতির সমৃদ্ধ নৃত্যনাট্য, কোথাও  যোগ ব্যায়াম সম্পর্কে  সচেতনতা, কোথাও বুঝান হচ্ছে গীতার মাহাত্ম্য, আবার কোথাও  দোকানীরা বসেছে হরেক পণ্যসম্ভার নিয়ে। আমাদের ইকোনমী প্রাণ ফিরে পেয়েছে দেখে ভাল লাগে। ভাল লাগে লেকের নৈসর্গিক রূপ দেখতে  অসংখ্য ছোট বড় জলযানের ব্যস্ত চলাচল দেখতে। করোনা কালীন সময়ে ঐ জলযানগুলো যাত্রী অভাবে কুলে ছিল বাঁধা। অনেকে সর্বস্বান্ত হয়ে বাধ্য হয়েছে ওঁদের যৎসামান্য মূল্যে বিক্রি করে দিতে। ওঁদের জন্য অনুকম্পা জাগে। তাই এক টাকার আইসক্রিম ছ টাকায় কিনে আমরা অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখতে পেরেছি বলে কিঞ্চিত গর্ব বোধ করি।

চোখে পড়ে আদিগন্ত মানুষের লাইন। গন্তব্য বিশাল সামিয়ানায় ঘেরা মৌ মৌ সুঘ্রাণে আলোড়িত সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থান – রসুই ঘর। বিনা মূল্যে সুস্বাদু খাবারের স্বাদ নিতে হাজার মানুষ টাক ফাটা রৌদ্রের মাঝে দাড়িয়ে আছে। মনস্তাত্ত্বিক  কারণে বিনামূল্যে খাবারের স্বাদ অতুলনীয়  -তা সে খাবার যতো মুখে তোলার অযোগ্য হোক না কেন। আমরাও দাড়িয়ে যাই দীর্ঘ লাইনে আজকের ভ্রমণের উপরি পাওনা হিসেবে। সেন্টার আইল্যান্ডের শেষ প্রান্তে যেথায় লেকের জল আছড়ে পড়ছে বড় বড় ঢেউ তুলে – সেথায় আমাদের জন্য  অপেক্ষা করে থাকে আরও উপরি পাওনা। আমরা দৃষ্টিনন্দন উদ্যান পার হয়ে পৌঁছে যাই লেকের বুক চিরে গড়ে উঠা এক অনিন্দ্য সুন্দর স্থাপনার উপর। যেদিকে চোখে যায় নীলাভ জলের হাতছানি। ঝিরি ঝিরি বাতাস  আমাদের চিত্তলোক আন্দোলিত করে লেকের জলে মৃদু কম্পন জাগিয়ে তোলে। দশ সহস্রাধিক বছরের ইতিহাসে আঁচর কেটে চলে যায়  ছোট ছোট জলযান। এমনি করেই হয়তো  হাজার বছর আগে  ইরক্রুস (Iroquois ) , হুরন (Huron) আদিবাসীরা এসেছিল  ontario lake (lake of shining waters) এ ডিঙ্গি নৌকায় ভেসে । এমনি করে এইদিন ইউরোপিয়ান এসেছিল ভাগ্যান্বেষণে। অফুরন্ত জলের দিকে তাকিয়ে মনে বিস্ময় জাগে-  এই সেই জলধারা, যা হিমবাহের তুষার গলে  আজও বয়ে চলছে নিরবধি। এই সেই হ্রদ যার বুকে বেয়ে বয়ে চলেছে  গ্রেট লেকের সমস্ত জলধারা আটলান্টিকের বুকে মিলনের প্রত্যাশায়।

এবার ফেরার পালা। আবারও হাজার মানুষের ঢল।  ঠাকুরকে দর্শন করে, রসনা তৃপ্ত করে, প্রকৃতির শোভা দর্শন করে কেউ ক্লান্ত, কেউ উচ্ছ্বসিত। কানে আসে ভরাট গলায় আকর্ষণীয় কন্ঠাশ্রিত এক সন্ন্যাসীর বিবেকানন্দের কিছু বানী।  সেই আকর্ষণীয় কণ্ঠ আমায় ডেকে নিয়ে যায় সৌম্য দর্শন এক সন্ন্যাসীর কাছে। তিনি চোখ মুদে বলে চলেছেন  ঠাকুর রামকৃষ্ণের প্রতি বিবেকানন্দের সেই অনন্ত  জিজ্ঞাসা –

Did you see the god? You are talking God, God all the time. Where is the proof? Show me the proof!”

রামকৃষ্ণ সরল ভাষায় উত্তর দেন ” I am the proof”.  বিবেকানন্দ সেদিন সেকথা বুঝতে পারেননি । পরে তিনি রামকৃষ্ণের  সাহচার্যে এসে বুঝতে পেরেছিলেন – স্রষ্টার শ্রেষ্ঠ জীব মানুষ; সুতরাং মানুষের সেবার মাধ্যমে ঈশ্বরের সেবা করা সম্ভব।

বহুরূপে সম্মুখে তোমার ছাড়ি কোথা খুঁজিল ঈশ্বর?                                                 জীব-প্রেম করে যেইজন সেইজন সেবিছে ঈশ্বর।

পথে আস্তে আস্তে কথাগুলো মনের মাঝে বাজতে থাকে। পথের পাশে ছিন্ন বস্ত্রে বসে থাকে ক্ষুধার্ত মানুষ। কার্ড বোর্ডে হাতে লেখা ” I am hungry, I am homeless’ ওঁদের পাশ কাটিয়ে আমরা সামনে এগিয়ে চলি। একবার মনে হয় দুটো ডলার উঠিয়ে দেই ওঁদের হাতে। পরক্ষনে আমার বিচারী মন বলে ওঠে -ওরা নিশ্চয়ই ঐ টাকা দিয়ে নেশা করবে। অন্টারিও লেক ছেড়ে আমরা ছুটে চলি হাইওয়ে ধরে। বিকেলের সূর্য ঢলে পড়েছে দিগন্তে। স্টিয়ারিং এ হাত রেখে ক্ষণকাল আনমনে হয়ে ভাবি – ধার্মিক হওয়া হয়তো তেমন কঠিন কাজ নয়; কিন্তু মানবিক হওয়া অনেক কঠিন, অনেক কঠিন…


সুশীল কুমার পোদ্দার , ওয়াটারলু, কানাডা নিবাসী ।  ফলিত পদার্থ বিদ্যা ও ইলেকট্রনিক্স,  মাস্টার্স,  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় , বাংলাদেশ ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স,   ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, পি, এইচ, ডি,   ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। সিস্টেম ডিজাইন ইঞ্জিনিয়ারিং, ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স,  ওয়াটারলু, বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডা ।।

 



সংবাদটি শেয়ার করুন